বছর ঘুরে আবার এসেছে পবিত্র রামাদান মাস। এ মাসে রোজা (আরবি- সিয়াম, ইংরেজি- Fasting) পালন করা হল ইসলাম ধর্মের একটি ফরজ বিধান, তা আমরা সবাই জানি। শুধু মুসলিমরাই না, পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মে, সব সভ্যতায়ই এর প্রচলন আছে।
ধর্মীয় কারণ ছাড়াও কিন্তু মানুষ ফাস্টিং করেছে যুগ যুগ ধরে। যেমন, প্রাচীন গ্রীস, মিশর, ভারত, চীন সহ বিভিন্ন দেশে ‘না খেয়ে থাকা’ বা ফাস্টিং কে একটি চিকিৎসার উপায় হিসেবে ধরা হতো। এক গ্রীক দার্শনিক এর মতে, ‘অসুখ হলে খাওয়া মানে, অসুখ কেই খাওয়ানো।’
এ তো গেল প্রাচীন কালের কথা। বর্তমান কালেও এই ফাস্টিং নিয়ে বিজ্ঞান মহলে আলোড়ন দেখে গিয়েছে। আপনারা অনেকেই হয়তো ওজন কমানোর একটি পন্থা হিসেবে ফাস্টিং এর কথা শুনে থাকবেন, যাকে বর্তমানে পশ্চিমারা ‘ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ নাম দিয়েছে। এই ফাস্টিং নিয়ে এখন গবেষণা হচ্ছে প্রচুর, আর ফলাফলও আসছে বিস্ময়জনক! এটি একাধারে হার্ট, ব্রেইন, কিডনি সহ গোটা শরীরের জন্য উপকারী।
এখন হয়তো আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, এই ফাস্টিং এর কি আসলেই এত উপকারিতা আছে? উত্তর হল- আছে তো বটেই, একে প্রায় সর্বরোগের ওষুধ বলা যায়। আপনি যদি একটু ইন্টারনেট এ নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন। বর্তমানে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, ক্যানসার ইত্যাদির মত বড় বড় রোগের চিকিৎসায় এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
সম্পাদকের নোটঃ এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় করোনা সময়ে, যেখন মহামারির কারণে সেবারের রমজান অন্য সব বারের থেকে আলাদা ছিল। তাই এখানে করোনার কথা বেশ কয়েকবার এসেছে।
শুধু তাই না, গবেষণায় দেখা গেছে যে ফাস্টিং এর ফলে শরীরের ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব! মাত্র তিনদিনের ফাস্টিং আপনাকে নতুনের মত ঝকঝকে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দিতে পারে। তাছাড়া ফাস্টিং এর কারণে শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রদাহ হ্রাস পায়, হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রায়। ফাস্টিং এর বিভিন্ন মেকানিজমের মধ্যে অন্যতম হল অটোফেজি, যে উপায়ে ক্ষুধার্ত কোষগুলো তার অভ্যন্তরীণ ক্ষতিকর উপাদানগুলো ভক্ষণ করে ফেলে।
এখন আপনি আবারও প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে মুসলিমরা রামাদানে এক মাস রোজা রাখলে কি এত সব উপকারিতা পাবে? উত্তর হল, পেতে পারে আবার না ও পারে। কারণ, উপকারিতার পরিমাণ নির্ভর করে খাবারে পরিমাণ আর পুষ্টিমানের উপর।
এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয় হল, পশ্চিমাদের ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং আর মুসলিমদের রোজা কিন্তু পুরোপুরি এক না। কেননা রোজায় পানি ও খাবারের পাশাপাশি আরো কিছু শারীরিক ও আধ্যাত্মিক বিধি নিষেধ রয়েছে, যা ফাস্টিং এ নেই। আবার ফাস্টিং এ সময়ের সাথে খাবারের পরিমানও বেঁধে দেয়া হয়, আর তা হল স্বাভাবিক চাহিদার প্রায় ২৫-৬০%; কিন্তু রোজার ক্ষেত্রে এমন বাধ্যবাধকতা নেই।
ঠিক এই কারণেই মুসলিমদের রামাদান নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে সেগুলোর ফলাফল এক না। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে এক মাস রোজা রাখার পর অনেকের ওজন বেড়ে গেছে! আবার রামাদানে মানুষের কাছ থেকে বদ হজম, বুকে জ্বালাপোড়া ইত্যাদি সমস্যার কথাও শোনা যায় প্রচুর। এর কারণ হল এই যে, সারাদিন না খেয়ে থাকার পর ইফতারে অতিরিক্ত খাওয়া হয়ে যায়, আর খাবার গুলোও সাধারণত স্বাস্থকর হয় না। রোজা ভেঙ্গেই এক গাদা চিনি দেয়া ঠান্ডা শরবত, ভাজাপোড়া, বিরিয়ানি- কোনোটাই উপকারী না, বরং খুবই ক্ষতিকর।
তাহলে সুস্থ থাকতে কি খাবেন রোজার দিনগুলোতে? নিচের টিপস গুলো মেনে চলুন, আশা করি ভালো ফল পাবেন।
১. পরিমাণ বুঝে খাওয়া
রোজা কিংবা রোজার বাইরে, পরিমাণ বুঝে খাওয়ার কোনই বিকল্প নেই। বাড়তি যে কোনো কিছুই খারাপ, আমরা সবাই জানি। তবু বেশির ভাগ মানুষই এক বসায় খাবার বেশি খেয়ে ফেলে। ফলে ইফতারের পর শরীর নাড়ানোই কষ্ট হয়ে যায়, সাথে দুনিয়ার ক্লান্তি ভর করে।
এরকম হলে কিন্তু লাভবান হবেন না এতটুকুও। খালি পেটে হুট করে এত গুলো খাবারের চাপ পাকস্থলী কে দিলে সেখানেই শরীরের সব শক্তি খরচ হবে, খাবার থেকে শক্তি পেতে ঢের দেরি।
এ বিষয়ে নবীজি (সাঃ) এর কথাই যদি বলি, তিনি পেটের এক ভাগ খাবার, এক ভাগ পানি ও আর এক ভাগ বাতাস দিয়ে ভড়তে বলেছেন। নিঃসন্দেহে এটি খুবই কার্যকরী উপদেশ, পেটে হজম ক্রিয়া ঠিকভাবে সম্পন্ন হতে হলে একটু খালি জায়গা ও কিছুটা তরল প্রয়োজন। অনেকে তিন ভাগের এক ভাগ কতটুকু হয় তা নিজে থেকে বুঝতে নাও পারেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ইসলামী বিশেষজ্ঞের মতে তা হল আধ মুদ (দুই হাত এক সাথে মিলিয়ে যতটুকু ভরা যায় তাকে এক মুদ বলে)। অন্য ভাবে বলা যায়, প্রায় ৪০০ মিলি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন বাটিতে যা আটবে তাই। এটা বৈজ্ঞানিক ভাবেও সঙ্গতিপূর্ণ, কেননা একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির পাকস্থলীর আয়তন প্রায় ১.৫লিটার।
খাবার খাওয়ার আগেই যদি এক গ্লাস পানি খেয়ে নেন, তাহলে আপনার জন্য পরিমিত খাওয়া আরো সহজ হয়ে যাবে। সেইসাথে যদি খাবার একটু বেশি সময় ধরে, বেশি বার চিবিয়ে খান, তাহলে তা আরো উত্তম। এতে করে হজম ভালো হবে ও একটি হরমোনের কারণে আপনি অল্প খেয়েই তৃপ্তি (satiety) বোধ করবেন।
আরো ভালো হয় যদি ইফতার কে দুভাগে ভাগ করে খান- পানি আর হালকা কিছু মাগরিবের নামাজের আগে, বাকিটা নামাজ পড়ে এসে। এতে পেট একটু বিশ্রাম পাবে, আপনিও ক্লান্ত হয়ে যাবেন না।
প্রথম দিকে কম খেয়ে থাকা কষ্টকর লাগতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, অল্প কদিনেই অভ্যাস হয়ে যাবে। এটা আমার কথা না, বিভিন্ন গবেষণার পর বিজ্ঞানীদের ভাষ্য। আপনার শরীরই খাপ খাইয়ে নিবে নানা উপায়ে, আপনি টেরও পাবেন না। খালি আপনার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কষ্ট এতটুকুই।
২. ইফতারে কি খাবেন, কতটুকু খাবেন
বুঝতেই পারছেন, যাই খান না কেন পরিমাণে কম খেতে হবে। কিন্তু তাতে কি পুষ্টির ঘাটতি থেকে যাবে? থাকতে পারে, যদি আপনি ঠিক মত খাবার নির্বাচন না করেন।
আমাদের শরীরের জন্য কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট এসব খুবই জরুরি। একই সাথে ভিটামিন আর মিনারেলসও দরকার, যদিও তা পরিমাণে অল্প। যদি সবরকম খাবার প্লেটে থাকে, তাহলে আপনার কোন চিন্তা নেই।
ইফতারিতে আপনার প্লেটের ১/৪ ভাগ কার্ব, ১/৪ ভাগ প্রোটিন (প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ উভয়ই), ও বাকি ১/২ ভাগ রান্না বা সেদ্ধ সবজি ও কাঁচা ফল-সালাদ দিয়ে যেন পূর্ণ থাকে। পূর্ণ মানে কিন্তু আবার উপচে পড়া বুঝানো হয়নি! একই সাথে থাকা চাই এক গ্লাস দুধ বা দুধ জাত যে কোন খাবার। এখানে ফ্যাটের কথা বলা নেই, কারণ খাবারের থেকে ও রান্নার তেল থেকেই তা এমনিতেই চলে আসবে।
এখন যে আইটেমই আপনি খান না কেন, কোন সমস্যা নেই যদি এই অনুপাত ঠিক রাখেন। এবার চলুন আমাদের দেশে প্রচলিত ইফতার আইটেম গুলোর ব্যবচ্ছেদ করে দেখি-
- শরবত: প্রথমেই অনেকে ঠান্ডা শরবত খেয়ে ইফতার শুরু করেন, যেটা একদম উচিত না। হঠাৎ ঠান্ডা জিনিস পেটে পড়লে সেই ধক পেট সহ্য নাও করতে পারে। আবার ঠান্ডা লেগে যাওয়ারও সুযোগ থাকে। আর প্রচুর চিনি দেয়া হলে সেটা হুট করে রক্তে সুগার বাড়িয়ে দিলে মাথা ঝিমঝিম করতে পারে।
- ছোলা: এটি উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ ডাল জাতীয় খাবার, যাতে রয়েছে প্রচুর ক্যালোরি আর ফাইবার। ইফতারে এটি খেতেই পারেন নিশ্চিন্তে, তবে অবশ্যই পরিমাণে কম। আধ কাপেই পেয়ে যাবেন প্রায় ১২০ কিলো ক্যালোরি। অনেকের বাদামি ছোলা হজম করতে সমস্যা হয়, তারা সাদা কাবলি ছোলা খেয়ে দেখতে পারেন। সবচেয়ে ভালো হয় কাঁচা ছোলা ভিজিয়ে রেখে খেলে, এতে বিভিন্ন রকমের উপকারী এনজাইম আছে, যা অন্য খাবারে পাবেন না।
- ভাজাপোড়া: পেঁয়াজু-বেগুনি-চপ সহ আরো অনেক পদের ভাজাপোড়া ছাড়া বাঙালিদের ইফতার যেন হয়ই না! কিন্তু খালি পেটে এগুলো একদমই অস্বাস্থ্যকর। তেল শোষণের কারণে এগুলোর ক্যালোরির পরিমান অনেক বেশি। যেকোন একটি আইটেম টেবিলে রাখতে পারেন, খেলে সামান্যই খাবেন। আর অবশ্যই বাইরে থেকে এসব কিনে এনে খাওয়ার দরকার নেই। একই তেলে বহুবার খাবার ভাজা হলে তা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
- মিষ্টি খাবার: রমজান আসলেই অলিতে গলিতে বসে যায় জিলাপির দোকান। চিনিতে ভরপুর এসব জিলাপি, বুন্দিয়া আপনাকে এক গাদা ক্যালোরি ছাড়া কিছুই দিবে না। এর বদলে মিষ্টি কিছু খেতে হলে দুধের তৈরি হালকা মিষ্টি কিছু খেতে পারে। ফ্রুট কাস্টার্ড, ফালুদা, দই ইত্যাদির ভেতর থেকে একটি পদ টেবিলে রাখতে পারেন।
- চিড়া: সবাই না, তবে অনেকেই ইফতারে চিড়া ভিজিয়ে খান। খুবই উপকারী খাবার, বিশেষ করে গরমে। এর সাথে ফল, বাদাম, দই মিলিয়ে আরো সুস্বাদু করে খেতে পারেন। এরকম এক বাটি খেলে আর কিছুই লাগবে না ইফতারে।
- ফল-সালাদ: ওগুলো ইফতারে খুবই দরকার। আর কিছু না হলেও আমাদের দেশে খেজুর রাখা হয় ইফতারে, যেটা খুবই ভালো অভ্যাস। খেজুর অল্পতেই আপনাকে প্রচুর শক্তি দিবে। ডায়বেটিসের রোগীরাও নির্ভয়ে খেতে পারেন। আর সুন্নত মানতে চাইলে, পানির বদলে খেজুর দিয়েই রোজা ভাঙতে পারেন। খুব ভালো হয় কাঁচা খেজুর জোগাড় করতে পারলে, সেটা যেমন উপকারী তেমনি সুস্বাদু।
- ভাত: অনেক ভাত খেতেই পছন্দ করেন ইফতারে। এতে চিন্তার কিছু নেই। সবজি, মাছ, সালাদ ইত্যাদি দিয়ে পরিমাণ মত ভাত খেলে উপকার পাবেন।
- পোলাও-বিরিয়ানি: খালি পেটে এসব একেবারেই খাওয়া উচিত না। মাগরিবের পরে সামান্য খেতে পারেন, তাতেও তারাবীহ পড়ার সময় ক্লান্তি বোধ করার আশঙ্কা থাকে।
- হালিম, স্যুপ: হালিম প্রচন্ড ভারী খাবার। তবে সামান্য খেলে ক্ষতি নেই। ইফতারে যেকোন স্যুপ টেবিলে রাখতেই পারেন। তবে খালি পেটে খুব বেশি গরম কিছু খাবেন না। সহনীয় তাপমাত্রায় এনে খাবেন।
রান্নার পদ্ধতিতে একটু পরিবর্তন আনলেই কিন্তু অনেক সময় অস্বাস্থ্যকর খাবারকে স্বাস্থ্যকর বানানো যায়। যেমন, ডুবো তেলে না ভেজে সেঁকা তেলে ভাজলে তেল কম ঢোকে। একই জিনিস স্টিম করে বা বেক করে খেলে আরো উপকারী। একটু শুকনা মরিচ কম দিলেই তা বুক জ্বালাপোড়া কমিয়ে দেয়। সবজি বড় টুকরা করলে ভিটামিন কম নষ্ট হয়, শাকের ক্ষেত্রে ছোট কুঁচি করলে হজম দ্রুত হয়। অর্থাৎ, পরিবারের সবার সুস্বাস্থ্য অনেকটাই গৃহিনীর হাতে। তাই রান্না করতে হবে বুদ্ধি করে।
এবার হয়তো লকডাউনের কারণে অনেক বাসার ইফতারের টেবিলে আগের মত হরেক পদের জৌলুস নেই। কারো কারো হয়তো অর্থাভাবে আরো করুণ অবস্থা। সারাদিনে পেটে কিছুই যায়নি, এমন মানুষের সংখ্যাও এবার কম না। তাই সামর্থ থাকুক আর না থাকুক, সবারই উচিত এবারের ইফতার একদম সাধারণ রাখার চেষ্টা করা।
৩. সেহরি কেন খাবেন, কী খাবেন
অনেকে সেহরি খেতে চান না, যেটা একদমই উচিত না করা। সারাদিনে চলার জন্য শক্তি পেতে হলে সেহরি খেতেই হবে। কেউ কেউ রাতে ঘুমের আগে একবারে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, যেটা আরো ক্ষতিকর। ঘুমের আগে এরকম প্রতিদিন খেলে হজমে তো সমস্যা হবেই, সাথে শরীরে মেদও বাড়বে।
এখন আসি সেহরির খাবারের কথায়। তার আগে আপনার জানা জরুরি একটি জিনিস- গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (glycemic index, GI)। আমরা যে কার্ব খাই, তাকে শরীরের ব্লাড সুগার বাড়ানোর ক্ষমতার উপরে ভিত্তি করে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়- হাই এবং লো জিআই ফুড। যেগুলোর হাই জিআই সেগুলো রক্তে দ্রুত সুগার সাপ্লাই দেয়, আর লো গুলো উল্টো। এখন সেহরিতে আপনার খেতে হবে লো জিআই খাবার, যাতে তা সারাদিনে ধীরে ধীরে এনার্জি দেয়।
এই খাবার গুলোর উদাহরণ হল হাই ফাইবার বা খাদ্য আঁশ সমৃদ্ধ খাবার- ওটস, লাল চালের ভাত, সবজি, লাল আটার রুটি ইত্যাদি। কেউ কর্ন ফ্লেক্সও খেতে পারেন, মিষ্টি বিহীন গুলো। যারা সাদা চালের ভাত খান, তারাও তা খেতে পারেন, সমস্যা নেই। তবে সাথে ফাইবার এর উৎস (যেমন, সবজি, শাক, সালাদ) ও কমপ্লেক্স প্রোটিন (যেমন, ডিম) রাখতে পারেন। এগুলো ভাঙতে সময় নেয়, তাই পেট বেশিক্ষণ ভরা থাকবে।
অনেকে হয়তো জানেন না, সেহরিতেও খেজুর খাওয়া সুন্নত। তাই ঘুম থেকে উঠে আর কিছু খেতে না ইচ্ছা হলেও একটা খেজুর ও একটু পানি অন্তত খাবেন।
৪. ডিহাইড্রেশন ঠেকাতে কি করবেন
রোজায় একটা জিনিষ নিয়ে ভয় থেকেই যায়, তা হল ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা। বিশেষ করে গরমের দিনে এই ভয়টা থাকে বেশি। কিন্তু যদি পানি ও খাবার ঠিকমত খান, তাহলে ভয়ের কিছু নেই।
ইফতারের পর থেকে সেহরি পর্যন্ত দেড় লিটার পানি পান করার চেষ্টা করবেন। ফলের জুস, দুধ, স্যুপও এর অন্তর্ভুক্ত; তবে চা, কফি না। এসব ক্যাফেইন জাতীয় খাবার আপনার শরীরে পানির চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। তাই যদি খেয়েই থাকেন কিছুটা, তার পর পানির পরিমাণ ও বাড়িয়ে দিতে হবে।
খাবারের ভেতর চিনি ও লবণ ডিহাইড্রেশনের অন্যতম নিয়ামক। এক গ্রাম চিনি শোষিত হতে তিন গ্রাম পানি প্রয়োজন। আর লবণের ভেতর যে সোডিয়াম থাকে, তা পানির চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। পটাসিয়াম সমৃদ্ধ ফল যেমন কলা, খেজুর ইত্যাদি সোডিয়ামের ঠিক উল্টা কাজ করে, তাই সেহরিতে এগুলো খুবই দরকার।
অতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিন আর ফ্যাটও ডিহাইড্রেশন এর উদ্রেক করে, এজন্যই রিচ ফুড খেলে তৃষ্ণা বেশি বোধ হয়।
৫. ইমিউনিটির কথা মাথায় রাখুন
অবশ্যই এই করোনা নামক মহামারির সময়ে আপনি চেষ্টা করবেন আপনার ইমিউনিটিকে মজবুত করতে। আগেই বলেছি, রোজা ইমিউনিটিকে আরো মজবুত করে। একই সাথে খাবারের পুষ্টি উপাদান, বিশেষত ভিটামিন ও মিনারেলও জরুরি।
ইমিউনিটি বাড়াতে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া বাড়িয়ে দিতে পারেন, যেমন- লেবু, মালটা, আপেল, পেয়ারা, পেঁপে, ডিম, দুধ, শাক, সবজি ইত্যাদি। তাছাড়া আমাদের খাদ্যনালিতে উপস্থিত উপকারী ব্যাকটেরিয়া (প্রোবায়োটিক) বৃদ্ধিতে বেশি ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার, বাদাম, বীজ, দই (বিশেষত টকদই) ইত্যাদি খেতে হবে।
এছাড়াও শহরের মানুষদের ভিটামিন-ডি এর অভাব থাকেই, যা কিনা ইমিউনিটি বৃদ্ধি ও রোগ নিরাময়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই একটু বাসার ছাদে গিয়ে রোদ লাগান শরীরে প্রতিদিন। আর হালকা সর্দি-জ্বর দেখা দিলে হাসপাতালে না দৌড়ে প্রথমে আদা, লবঙ্গ, লেবু, চিকেন সুপ, মেন্থল বা গরম ভাপ- এগুলো টোটকা অবলম্বন করুন, এদের প্রত্যেকেরই কিছু ওষুধি গুণ অবশ্যই আছে।
ইমিউনিটি বৃদ্ধিকারী খাবার
অনেকে ভিটামিন-সি, জিঙ্ক, ভিটামিন ডি ইত্যাদি সাপ্লিমেন্ট সাথে রাখেন, সেটা করতে পারেন, কিন্তু সেটা সবার জন্য জরুরি না। আর সেগুলো সেবনের আগে ডোজ সম্পর্কে ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে নিবেন।
ইমিউনিটিকে বুস্ট করার জন্য আরো কার্যকরী পন্থা হল হাদিসে বর্ণিত বিশেষ বিশেষ ওষুধি গুণসম্পন্ন খাবার গুলো খাওয়া। যেমন, কালোজিরা, মধু, খেজুর, দুধ, বাদাম, গোলমরিচ ইত্যাদি। এর ভেতর কালোজিরা কে নবীজি বলেছেন ‘মৃত্যু ব্যতীত সব রোগের ওষুধ’। বর্তমান পরিস্থিতেও কিন্তু এটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ এতে রয়েছে কুইনাইন ও নাইজেলাডিন, যা কিনা করোনার ওষুধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিভিন্ন সুন্নাহ ফুড
৬. হেলদি লাইফস্টাইল
পুষ্টি মানেই শুধু খাওয়া দাওয়া না, বরং এটা আপনার পুরো লাইফস্টাইল এর উপর নির্ভরশীল। এজন্যই ঘুম ও ব্যায়ামের কথা আমরা সবসময় বলি।
রোজা রেখে বেশির ভাগ মানুষ সঠিক ভাবে স্লিপ ম্যানেজমেন্ট এ ব্যর্থ হন। অনেকে ইচ্ছা করেই ঘুমিয়ে দিন পার করতে চান। এতে রোজার উপকারিতা তো পাবেনই না, বরং ক্ষতি হবে বেশি। বিশেষ করে ভরা পেটে ঘুমালে সারাদিন খারাপ লাগবে, বদহজম হবে।
রোজা অবস্থায় বেশি কাজ করা যায় না, তাতে পিপাসা লেগে যায় বলে। কিন্তু বেশি শুয়ে বসে থাকলে, কায়িক শ্রম কিছুই না করলে যা খেলেন, তার বেশির ভাগ উপাদানই শরীরের কাজে লাগবে না। বিজ্ঞানীদের মতে, ক্ষুধার অনুভূতি (hunger pang) আমাদের শরীরে কয় ঘন্টা পর পর এলার্মের মত বাজতে থাকে। যদি আপনি কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে ঐ অনুভূতি টেরই পাবেন না। লক ডাউনে অনেকেই ঘরে বসেই দিন পার করছেন। কিন্তু ঘরে বসে কি এ সময়ে প্রোডাক্টিভ কিছু করা যায় না? ভালো বই পড়ুন, হোম গার্ডেনিং করুন, ইবাদাত বাড়িয়ে দিন। এসবের আরেকটি ভালো দিক আছে, তা হল এগুলো স্ট্রেসমুক্ত থাকতে সাহায্য করে। করোনা ঠেকাতে পর্যাপ্ত ঘুম ও স্ট্রেসমুক্ত হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আর অবশ্যই হাঁটাহাঁটি করবেন, পারলে হালকা ব্যায়াম। নাহলে শরীর আড়ষ্ট হয়ে থাকবে। তারাবীহ নামাজ এর আগে হালকা স্ট্রেচিং করে নিলে নামাজ দীর্ঘ সময় নিয়ে ভালোভাবে পড়তে পারবেন। এই রামাদানে নিজেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিন- নিজেকে আরো ফিট বানানোর চ্যালেঞ্জ। ইবাদাত বলুন কিংবা চাকরি, বেঁচে থাকার জন্য সব ক্ষেত্রেই ফিটনেস জরুরি।
রামাদানকে বলা হয় রহমতের মাস, নিজের বদ অভ্যাস গুলো বদলে ফেলার উত্তম সুযোগ। রোজা তো রাখবেন কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার উদ্দেশ্যে। সেই সাথে নিজেকে একটু পরিবর্তন করে যদি সুস্থতাও পাওয়া যায়, তাহলে তো আরো ভালো, তাইনা?
(ফারিহা মুশাররাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ নিউট্রিশন এন্ড ফুড সাইন্সের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী)
ছবি: Dr. Axe, VeryWell