প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা নিয়ে মায়েরা আগের চেয়ে বেশি সচেতন হচ্ছেন। পিপিডি (পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন), বেবি ব্লু এই শব্দগুলো এখন বেশ আলোচনায় আসে। পিপিডির ক্ষেত্রে খুব সিরিয়াস হলে ডাক্তারের পরামর্শ তো নিতেই হয় তবে, মুসলিম মায়েরা ইসলামের জ্ঞান ও আমলকে কিভাবে এই সময়ে কাজে লাগিয়েছেন সেটা নিয়ে জানার সুযোগ বেশ কম। এই উদ্দেশ্যে আমরা মাতৃত্ব ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে একটা উদ্যোগ নিয়েছি প্রসব পরবর্তী সময়টা মুসলিম মায়েরা ইসলামের আলোকে কিভাবে মোকাবেলা করেছেন তা জানতে। আমরা তাদের নিচের প্রশ্নগুলো করেছিলাম। তাদের উত্তরগুলো কেস স্টাডি আকারে আমরা এই লেখায় তুলে ধরেছি। কেস স্টাডির শেষে আমাদের কিছু কথা রেখেছি।
প্রশ্নগুলো হচ্ছেঃ
১। যারা প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতায় ভুগেছিলেন তাদের সেই সময় কী ধরনের মানসিক সমস্যা হতো? এই ধরণের সমস্যা হতো কি – বাচ্চার প্রতি ভালবাসা নেই বা কম মনে হওয়া, আশপাশের মানুষকে অসহ্য লাগা, স্বামীর সাথে ঝগড়া হওয়া, শুধু বাচ্চাই গুরুত্বপূর্ণ মায়ের নিজের জীবন না, বাচ্চার প্রতি বিরক্তি বা ঘৃণা জন্মানো, আগ্রাসী চিন্তা এমনকি আত্মহত্যা বা বাচ্চাকে শারীরিক ভাবে ক্ষতি করার কথা মাথায় আসা?
২। কী ধরণের পদক্ষেপ নেয়ায় আপনি ভালো বোধ করেছিলেন?
৩। সেই সময় আল্লাহর সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল ও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য আপনি কী করতেন?
৪। আপনার স্বামী/পরিবারের মানুষদের সহযোগিতা কেমন ছিল? আপনি কি তাদের বিষয়টা বোঝাতে চেষ্টা করে তাদের সহযোগিতা চেয়েছিলেন?
৫। আপনি কি নিজের খেয়াল রাখতেন, যেমন সময়মতো খাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম, প্রতিদিন গোসল, চুল আঁচড়ানো ইত্যাদি?
৬। আপনি কি এই সমস্যার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন?
৭। পরবর্তী প্রেগন্যান্সীতে কী ধরণের পদক্ষেপ আগে থেকে নিলে এমন সমস্যা এড়ানো যাবে বা কম হবে বলে আপনি মনে করেন?
৮। আগে থেকেই যদি প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা নিয়ে জানা থাকে তাহলে কি উপকার হবে বলে মনে করেন? যদি আপনার আগে থেকে পড়াশুনা থাকে তাহলে কোন ধরণের লেখাগুলো বেশী উপকারী হয়েছিল বলে মনে করেন (যেমন: কেস স্টাডি, বেসিক কারণ, প্রতিকার ইত্যাদি)?
এবার আসুন দেখি কিছু মুসলিম মায়েদের উত্তর কেমন ছিল।
কেস স্টাডি ১ঃ রুসাফা জাহান
আমার মেয়ে হয় ৩.১.২০১৯ তারিখে আলহামদুলিল্লাহ। আমি এবং আমার স্বামী দুইজনই ডাক্তার। প্রেগনেন্সির সময় থেকেই আমার অনেক রকম শারীরিক সমস্যা ছিল। যেমন, বমি, খাবারে অরুচি, সব জয়েন্ট এ ব্যথা, কোন রকম পজিশনেই ১০/১৫মিনিটের বেশি থাকতে পারতাম না, ঘুমাতে পারতাম না। নরমাল ডেলিভারির জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। ৩০ঘন্টা লেবার পেইন নিয়েও যখন বাবুর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল তখন সিজার করানোর সিদ্ধান্ত নেই।
আমি আল্লাহর সিদ্ধান্তেই সন্তুষ্ট ছিলাম। এরপর আমার ব্রেষ্ট ফিড করাতেও সমস্যা হয়, প্রচুর খাবার খাওয়ার পরেও পর্যাপ্ত ব্রেষ্ট মিল্ক আসতো না। তখন থেকেই আমার খুব খারাপ লাগত। বাবু কান্না করলে মনে হত ও আমাকে সহ্য করতে পারছে না। সারাক্ষণ দুধ মুখে নিয়ে থাকত। আমিও ওকে নিয়ে বসে থাকতাম।
বাসার সবাই বাবুকে নিয়ে চিন্তা করত। আমার যে একটা অপারেশন হয়েছে, আমারও যত্নের প্রয়োজন তা বুঝত না। তবে আমার স্বামী খেয়াল রাখত আমার। প্রেগনেন্সির সময় আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, সে যখন বাসায় থাকত আমি অনেকটা ভালো থাকতাম।
নিজের যত্ন নেয়ার চেষ্টা করেছি। বাবুকে কেউ কোলে নিলে সময় নিয়ে বসে খেয়েছি, গোসল করেছি।
বেশি খারাপ লাগত কেউ এসে উপদেশ দেয়া শুরু করলে। কিছু বলতাম না, পরে কান্না করতাম। বিশেষ করে বাবু দুধ পাচ্ছে না ঠিক মত এই কথা বললে মনে হত এটা আমারই দোষ! কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগত না। অসহ্য লাগত। তবে বাবুর উপর কখনো কোন নেগেটিভ অনুভূতি হয়নি।
আল্লাহর কাছে অনেক দুআ করেছি, সালাত শুরু হওয়ার পর যখনই ওয়াক্ত হয়েছে নিয়মিত সালাত আদায় করার চেষ্টা করেছি। আল্লাহ কে শুধু বলেছি, আল্লাহ সহজ করে দাও, আমি অসহায়।
আমার এই বিষয়ে আগে থেকে জানা থাকায়, স্বামীকে বুঝিয়ে বলা, আর স্বামীর সাহায্য পাওয়া এই বিষয়গুলো আমাকে অনেক সাহায্য করেছে আলহামদুলিল্লাহ। বিভিন্ন কেস স্টাডি গুলোই এই ডিপ্রেশন সম্পর্কে জানতে বেশি হেল্প করেছে।
কেস স্টাডি ২ঃ উম্ম নাওয়ার
যে সমস্যা গুলোর কথা লেখা আছে সেগুলো হয়নি। তবে, মনে হতো আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। আমি আর কিছুই করতে পারবোনা৷ অনেক রেস্টলেস লাগতো। ঘুম হতোনা। বাচ্চা ঘুমালেও ঘুম আসতোনা৷
আমার স্বপ্ন ছিলো আমি ইসলাম ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করবো৷ তাজউয়ীদে ইজাজা নিবো। আরবী ভাষা শিখবো। বাচ্চাদের ভালোভাবে মানুষ করবো। সব কিছুই অসম্ভব মনে হচ্ছিলো৷ আর আমার বাচ্চা ছিলো কলিক। ঘুমাতো কম, অনেক কষ্ট হয়েছে। বাচ্চার বাবা আমাদের সাথে থাকতোনা। অন্য শহরে থাকতো। খুব মনে কষ্ট পেতাম উনি নিজের কিছু আরাম ছাড়তে চাইতোনা। আবার উনি জানতো আমার স্বপ্নগুলোর কথা। কিন্তু আমাকে আমার জীবনের লক্ষ্যগুলো অর্জন করার জন্য সহযোগিতা করতোনা৷ বাচ্চা হবার পর কষ্ট, স্ট্রেস কিছুই ওনার গায়ে লাগেনি। আমি মায়ের বাসায় ছিলাম। উনি যখন বলতেন বাচ্চা হবার পর টাইম দিচ্ছিনা, নিজের যত্ন নিচ্ছিনা তখন অনেক কষ্ট পেতাম।
বাচ্চার কয়েক মাস বয়সে ঝগড়া হয়েছিলো। আমার বাচ্চাটা খাওয়া, ঘুম, কান্না এসব নিয়ে সমস্যা করতো যেটা ওর স্বভাবগত কিন্তু সেটা আমার শ্বশুড়বাড়ির অনেকে বুঝতোনা। আমার হাজব্যান্ডও বুঝেনি এবং শ্বশুড়বাড়ির অনেকের কথা শুনে আমাকে এমন উপদেশ দিতো যা বাচ্চার সাথে খাটেনা। সব মিলিয়ে মা ঠিক ভাবে পালে নাই, শেখায় নাই অনেকটা এমন মনোভাব দেখাতো অনেকে। বাচ্চা হবার পর মায়ের সাথে কয়েকবার অনর্থক রাগ করেছিলাম। যেমন, আমার মা খুব গুছানো স্বভাবের না। সব এলোমেলো দেখলে আমার খুব ডিপ্রেসড লাগতো। রাগ হলে বাচ্চাকে কারো কাছে দিতাম না। কিন্তু বাচ্চার উপর কখনো রাগ হয় নাই।
বাবুর কয়েক মাস হবার পর আমি কোর’আন এর তাফসীর পড়া শুরু করি একটা ইভেন্ট এর সাথে যোগ দিয়ে। এর পর আস্তে আস্তে ভালো লাগতে থাকে। মনে হচ্ছিলো আমি পারবো সব কিছু।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ভালো ছিলোনা৷ আমার নামাজ পড়তে খুব কষ্ট হতো। রেগুলার ডায়াপার দেয়াটা ব্যয়বহুল ছিলো। শ্বাশুড়ি, ননাস সবাই না দেয়ার পক্ষে ছিলো। পাক নাপাক ইস্যু, ঘুম কম হওয়ায় ফজর মিস এসব কারনে অনেক ডিপ্রেসড থাকতাম আর খুবই দুর্বল ছিলাম।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ভালো হবার কোন উদ্যোগ নেইনি। অনেক ডিপ্রেশনে থাকলে আমি কিছুই করতে পারিনা।
ডিপ্রেশন এর বিষয়ে মা বাবা, শ্বশুড় শ্বাশুড়ি এদের কাউকেই কিছু বলিনি। ওনারা এগুলো ঠিক বুঝবেনা মনে হতো। আমার মা আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। তবে, আমার হাজব্যান্ডকে বলেছি। বলতো, খাওয়া দাওয়া ঘুম ঠিক রাখতে। বাচ্চাকে বেশি কোলে না নিতে। আমি কোলের অভ্যাস করে ফেলছি এগুলো বললে আরো কষ্ট পেতাম। ডিপ্রেসড থাকলে যে ঘুম হয়না, খাওয়া যায়না এগুলো বুঝতো কিনা জানিনা। বুঝলেও এগুলোই বার বার বলতো। আমার মা এত কষ্ট করার পরও কেন জানি মার সাথে রেগে চিল্লাচিল্লি করতাম।
নিজের খেয়াল মোটামুটি রাখতাম। বেসিক কাজগুলো করতাম যেমন গোসল, খাওয়া এসব৷ তবে, গোসল টাইমলি করতাম না। মাঝে মাঝে গভীর রাতেও গোসল করেছি। বাবুর জন্য টাইম পেতামনা তাও না। ইচ্ছা করেই এমন করতাম। আর স্ক্রীন দেখতাম অনেক।
অনেক আগে ডিপ্রেশন এর জন্য ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। হাইপোথাইরয়েড এর জন্য অনেক ডিপ্রেশনে ভুগেছি। নতুন করে আর ডাক্তার দেখানো হয়নি। আমার থাইরয়েড গ্ল্যান্ড এর অবস্থাও খারাপ ছিলো ডেলিভারীর পর।
পরবর্তী প্রেগন্যান্সীতে কী ধরণের পদক্ষেপ আগে থেকে নিলে এমন সমস্যা এড়ানো যাবে বা কম হবে এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে চাই, প্রেগন্যান্সি নিয়ে আগে থেকে জানা প্রয়োজন। শুধু বইয়ের কথা না; বাস্তব জীবন থেকে জানা যে মানুষ কিভাবে এটা পার করে, কী কী সমস্যা হয় ইত্যাদি। আমি প্রেগন্যান্সির পর কী কী হতে পারে কিছুই জানতাম না। আর অন্যদের সাথেও আলোচনা করলে, সব গুছিয়ে প্ল্যান করে রাখলে উপকার হয়।
আগে থেকে জানা থাকলে কিছুটা উপকার হবে ইনশাল্লাহ। সবাই হেল্প করলে, পর্যাপ্ত রেস্ট নিলে, নিজের জন্য কিছুটা বিনোদন এর ব্যবস্থা করতে পারলেও অনেকটাই ভালো থাকা যায়। আরেকটা বিষয় দেখলাম আমাদের দেশে মানুষ বাবুদের নিয়ে পড়াশোনা করতে চায়না। নবজাতকের ঘন ঘন পরিবর্তনগুলো নিয়ে মায়েরা জানেনা। তখনও ডিপ্রেশনে পরে। দ্বিতীয় বাবুর পর আলহামদুলিল্লাহ আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি।
২য় পর্ব দেখুন এখানে।