মহামারী আমাদের জীবনে নিঃসন্দেহে অনাকাঙ্খিত ও অভাবনীয় ঘটনা। সাধারণত প্রতি শতকে একবার এমন ঘটনা ঘটে, তাই স্বাভাবিকভাবেই সন্তানের বাবা-মা’রা অপ্রস্তুত থাকেন। এই অপ্রস্তুতি সত্ত্বেও মহামারি চলাকালীন সময়ে আমাদের লক্ষ্য থাকে এরকম-
১. সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকা
২. স্বাস্থ্যবান থাকা
৩. দৈনন্দিন রুটিনে মহামারীজনিত ক্ষতি কমানো
৪. মানসিক স্বাস্থ্যের তত্ত্বাবধান
৫. মহামারী পরবর্তী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহন
বেঁচে থাকা
সাধারণত মহামারী আসে উচ্চমাত্রার সংক্রমণ ক্ষমতা নিয়ে। এই সময়টা তাই বাবা-মা এবং সন্তান উভয়ের জীবনের জন্য হুমকির কারণ। এজন্য আমাদের প্রথম লক্ষ্য থাকে সংক্রমণ থেকে বেঁচে থাকা। এই লেখা যখন লিখছি, তখন সারা পৃথিবী কভিড-১৯ এর ছোবলে লন্ডভন্ড হয়ে আছে। চীন থেকে সংক্রমন শুরু হয়ে ২১ হাজারের (২৬ মার্চ, ২০২০) বেশি মানব সন্তানের জীবন ছিনিয়ে নিয়েছে। ঠিক কোথায় এবং কখন এই মহামারী থামবে সে নিয়ে কারো কোন ধারণা নেই।
এরকম অনিশ্চয়তার সময়ে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা ও সে অনুযায়ী কাজ করতে পারার যোগ্যতা। অতএব, মাথা ঠান্ডা রাখুন বা অন্তত ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করুন।
সাধারণত মহামারীর তান্ডবের সময় এর কোন সুচিকিৎসা বা প্রতিষেধক থাকে না, তাই এরকম সময়ে প্রতিরোধ-ই সবচেয়ে ভাল পন্থা। বর্তমান সময়ে করোনা বা কভিড-১৯ এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অতএব সম্ভাব্য সকল প্রতিরোধমূলক পন্থায় আমরা নিজেদের এবং বাচ্চাদের এর সংক্রমণ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে পারি।
কভিড-১৯ প্রতিরোধ:
শিশু বা বয়স্ক সবার জন্য প্রতিরোধের সাধারন উপায়গুলো এরকম:
১. ভীড় এড়িয়ে চলা, যেটাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে Social Distancing (সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা)
২. আক্রান্ত বা অসুস্থ ব্যক্তি থেকে দূরে থাকা
৩. নিয়মিত হাত ধোয়া। এক্ষেত্রে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়ার কথা বলা আছে। বাচ্চারা হয়তো এটা করতে চাইবে না, তাই তাদের হাত ধোয়ার সময় তাদের পছন্দের গান বা ছড়া বলে সময়টাকে দীর্ঘায়িত করা যায়।
৪. যেসব বাচ্চা একেবারেই হাত ধুতে চায় না, তাদের হাত ধোয়ার সাথে একটা পুরষ্কারকে সম্পর্কিত করা যেতে পারে, যেমন হাত ধোয়ার পর তাকে একটা চকোলেট দেয়া, বা পুতুল দেয়া ইত্যাদি।
৫. চোখ, নাক, মুখ ও কানে হাত দেয়া থেকে নিজে বিরত থাকা এবং বাচ্চাকে বিরত রাখা। বাচ্চার চুল বেঁধে রাখা, চোখ, নাক ও মুখ পরিষ্কার করে দেয়ার মাধ্যমে বারবার হাত দেয়া থেকে বিরত রাখা যায়। এছাড়া বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখা, হাত দেয়ার খারাপ দিক সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলা যায়। তবে এজন্য রাগ করা, বকা দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৬. পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমুল ও ভিটামিন সি যুক্ত খাবার গ্রহণ করা। সম্ভব না হলে ভিটামিন-সি সাপ্লিমেন্ট (যেমন সিভিট) গ্রহণ করা।
৭. বাচ্চা যেখানে হাত দেয় (যেমন বাসার দরজার হাতল, টেবিল, বেসিন) এসব স্থান বারবার স্যানিটাইজ বা জীবাণুমুক্ত করা
৮. সম্ভব হলে বাচ্চার খাবার প্লেট, গ্লাস, টয়লেট আলাদা করা।
৯. সম্ভাব্য সকল উপায়ে বাচ্চাকে যেকোন প্রকার অসুস্থতা থেকে বাঁচিয়ে রাখা, কারণ অসুস্থতা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে।
১০. সর্বোপরি নিজের বাসায় অবস্থান করা। বাংলাদেশের বাস্তবতায় বাচ্চাদের বাসায় অন্তরীণ করে রাখা খুব কঠিন, তবুও এটা করতে হবে, কারণ এর মাধ্যমে আপনার শিশুকে এই সংক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন। এবং যদি আপনার সন্তান এর মাঝে আক্রান্ত হয়ে থাকে, তবে সংক্রমণ ছড়ানোও নিয়ন্ত্রন করতে পারেন।
শিশু আক্রান্ত হলে কী করবেন?
আগেই বলেছি এখন পর্যন্ত কভিড-১৯ এর কোন প্রতিষেধক নেই, তাই জ্বর সর্দি-কাশি নিয়ন্ত্রন করাই প্রধান কাজ। এজন্য জ্বর বেড়ে গেলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ এর কথা বলছেন ডাক্তাররা। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল ও ভিটামিন সি গ্রহণ এবং বিশ্রাম করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যদি শ্বাস কষ্ট হয়, তবে ডাক্তার বা হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া যায়। যেহেতু করোনা সংক্রমণের চিকিৎসা সব হাসপাতালে নেই, তাই সরকার নির্ধারিত হাসপাতালে যাওয়া যেতে পারে। এই লেখায় হাসপাতাল ও হেল্প লাইনের তথ্য বিস্তারিত আছে।
শিশু অন্য কোন রোগে আক্রান্ত হলে?
আপনার শিশুর যদি অ্যাজমা বা ডায়াবেটিস থাকে তাহলে কভিড-১৯ তার জন্য বেশ খারাপ অবস্থা নিয়ে আসতে পারে। তাই বাচ্চার ব্যাপারে সতর্ক হোন যাতে সে কোনভাবেই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসতে না পারে। তার শারীরিক অবস্থার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন এবং অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে ভর্তির প্রস্তুতি রাখুন।
স্বাস্থ্যবান থাকা
সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা এবং বাসায় আবদ্ধ (Quarantine) থাকার কারণে আমাদের নিয়মিত হাটাচলার কার্যক্রম ব্যাহত হয়, যার ফলে শরীর খারাপ করার সম্ভাবনা থাকে। এসময় স্বাস্থ্যবান থাকার ৩টি পর্যায় আছে:
১. সুষম খাবার: যথাসময়ে খাবার গ্রহণের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ, যথেষ্ট পরিমাণে পানি পান জরুরী। এসময় ডাক্তাররা কুসুম গরম পানি পানের কথা বলেন।
২. ইনডোর ব্যায়াম/খেলাধুলা: বাসার অভ্যন্তরে বাচ্চার সাথে বিভিন্ন হালকা ব্যায়াম ও খেলায় অংশ নিন। আবদ্ধ সময়ে বাচ্চাকে ব্যায়ামে অভ্যস্থ করাতে পারেন।
৩. পরিচ্ছন্নতা: যেহেতু সবাই বাসায় আবদ্ধ থাকবেন, বাসা আগের চেয়ে বেশি নোংরা হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই বাচ্চার মা’র পাশাপাশি বাবারও বাসার কাজে হাত লাগানো উচিত। বাসায় কাজের লোক আসা বন্ধ করলে শিশুর পিতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। সেইসাথে বাচ্চাকেও বাসার কাজে যুক্ত করুন। এর মাধ্যমে তার সময়ও ভাল কাটবে।
এছাড়া শারীরিক সমস্যা না থাকলে নিয়মিত গোসল করা উচিত।
দৈনন্দিন রুটিনে মহামারীজনিত ক্ষতি কমানো
১. বাচ্চার পড়াশুনার রুটিন: এসময় বাচ্চার স্কুল বন্ধ থাকায় তার পড়াশুনায় যে ছন্দপতন ঘটবে তার জন্য বিকল্প পরিকল্পনা নিন। বাচ্চাকে নিয়ে প্রতিদিন একই সময়ে পড়তে বসুন। যতটা সম্ভব তার জন্য পড়াশুনাকে আনন্দময় করুন। তাকে আঁকাআকি করার সুযোগ করে দিন। তার সাথে ক্রাফটিং করতে পারেন। এ সংক্রান্ত নতুন আইডিয়া পেতে ইউটিউব ও ইন্টারনেটের সহায়তা নিন।
২. বাচ্চার খেলার রুটিন: বাচ্চার জন্য খেলাধুলায় শারীরিক ও সামাজিক দুটি দিক আছে। মহামারী এদুটি বিষয়কেই প্রভাবিত করে। তাই বাসাতেই বাচ্চাকে খেলার ব্যবস্থা করে দিন। এক্ষেত্রে বাচ্চার বাবা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আর এ সময় বাচ্চাকে আত্মীয়-স্বজন, বাচ্চার বন্ধুদের সাথে ফোনে/ভিডিও কলে কথা বলার সুযোগ করে দিন।
এসময় বাচ্চার স্ক্রীন টাইম বেড়ে যেতে পারে। একে কড়া হাতে দমন না করে পরিস্থিতি বুঝে প্রতিক্রিয়া দেখান।
মানসিক স্বাস্থ্যের তত্ত্বাবধান (Stress Management)
ভয় স্বভাবতই সংক্রামক। আপনার ভয়, মানসিক অস্থিরতা, পরিবারের জন্য দুঃশ্চিন্তা সবই আপনার বাচ্চাকে প্রভাবিত করবে। বাচ্চার মানসিক পরিপক্কতার উপর নির্ভর করবে সে আপনার মানসিক অবস্থাকে কীভাবে অনুধাবন করবে।
- এসময় আপনি নিজে আপনার মনের অবস্থার নিয়ন্ত্রন নিন এবং বাচ্চার মানসিক অবস্থাকেও ভাল রাখুন।
- যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করুন। তার মাঝে সহানুভূতি (Compassion) জাগ্রত করুন।
- বাচ্চাকে বাসার দৈনন্দিন কাজে যুক্ত করুন। এতে তার মাঝে দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পাবে।
- বাচ্চা বাসায় আবদ্ধ থেকে জ্বালাতন (Tantrum) করলে সেটা অস্বাভাবিক না, তাই তার আবেগ বুঝে তার সাথে কথা বলুন।
- ভয় না পেয়ে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করে দরকারি কাজ করে যাওয়াই এর একমাত্র পথ।
মহামারী পরবর্তী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহন
যে কোন মহামারী সমসাময়িক জনগণের জীবন ধারায় গভীর প্রভাব ফেলে। কভিড-১৯ ও আমাদের জীবনে বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলবে। যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা পরিবর্তনকে আমাদের জন্য ইতিবাচক বানিয়ে নিতে পারি, বা অন্ততপক্ষে চেষ্টা করতে পারি।
১. আমরা এখনো নিশ্চিতভাবে জানি না কভিড-১৯ কখন কিভাবে থামবে এবং আমরা কবে নাগাদ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবো। বাচ্চারা যখন স্কুলে ফিরবে, তখন তারা হয়তো জানতে পারবে তাদের কোন সহপাঠি, শিক্ষক বা পরিচিতজন মহামারির শিকার হয়েছে। এজন্য বাচ্চাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে, যাতে তারা হঠাৎ মানসিকভাবে আঘাত না পায়।
২. ধর্মীয় কারণে পরিচ্ছন্নতা আমাদের জীবনাচরণের অংশ। তবুও এর প্রয়োগে বর্তমানে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সেটা ভবিষ্যতেও চলমান রাখা যায়।
৩. কভিড-১৯ পরবর্তী দুনিয়ায় সম্ভবত প্রযুক্তির ব্যবহার আরো প্রবল হবে এবং এখনকার যেসব নৈতিক ও আইনী প্রশ্ন অনেক প্রযুক্তিকে ঠেকিয়ে রেখেছিলো, তা আর থাকবে না। এরকম সময়ে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা (privacy) আরো বিপদের মুখে থাকবে। আবার দুরশিক্ষন, ঘরে বসে কাজ করার মতো অনেক ভালো প্রযুক্তির ব্যবহার জোরালো হবে। সেইসময় বাচ্চাদের প্রযুক্তির ব্যবহার (Adoption) নিয়ে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৪. মিনিমালিজম (Minimalism) বা প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যয় : মহামারীকালীন আমাদের স্বাভাবিক জীবনাচরণ সংকুচিত হয়ে আসে। আমরা সর্বনিন্ম আয়েসে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি এবং খাবার থেকে শুরু করে সবকিছুর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করি। বর্তমান শতাব্দির ভোগবাদী জীবন যে পৃথিবীর উপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করেছে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বিপদ ডেকে আনছে সেটা নিয়ে কারোর দ্বিমত নেই এবং পরিতাপের বিষয়, এটা বদলের কোন চেষ্টাও নেই। মহামারী আমাদের গভীরভাবে চিন্তা ও পরিবর্তন চর্চা করার সুযোগ এনে দিয়েছে। পরবর্তীতে আমরা এই মিনিমালিজম নিজেদের জীবনে অব্যাহত রাখতে পারি।
এছাড়াও এই বিপর্যয়ের পরে বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থবিরতা (Recession) দেখা দেবে। বিশেষ করে পর্যটন ও এর আশেপাশের অর্থনৈতিক খাতগুলোতে অনেক ছাটাই হবে। দেশের পোশাক শিল্পখাতে এরমাঝেই বিপর্যয়ের আভাস দেখা দিচ্ছে। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে আমরা আর্থিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে পারি।
তথ্যসূত্র:
১. কীডজ হেলথ
২. হপকিন্স মেডিসিন
৩. সুষমা রেজা’র ফেসবুক লাইভ
৪. পলিটিকো
৫. অন্যান্য
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সাবরিনা আফরোজ
MBBS, MPH
লেকচারার, ঢাকা কমিউনিটি মেডিসিন কলেজ
ছবি কৃতজ্ঞতা: Pixabay