আমরা মায়েরা অনেক “অদৃশ্য” কাজ করি সারাদিন। অদৃশ্য কারন সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে না চোখে দেখা যায়, না ঠিক বোঝা যায়। এই যেমন ঘরের ভেতর হাঁটতে হাঁটতেই বাচ্চার খেলনা, কাপড় যেগুলো এখানে সেখানে পরে থাকে, জায়গা মতো রাখলাম (কতক্ষণ পর দেখা যাবে সব ভোজবাজির মতো এবার হাজির হয়েছে!)। লিভিং রুমে ঢুকে কুশনগুলো গুছিয়ে রাখলাম। কিচেনে কাজের ফাঁকে ফাঁকে সিঙ্কের (যা সহজে খালি হবে না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ) কিছু হাঁড়িকুঁড়ি ধুয়ে ক্লিন করলাম। সকালে যেমন সব পর্দা সরিয়ে আলোর আসার সুযোগ করে দিলাম, তো সন্ধ্যার আগেই সব পর্দা টেনে বাতি জ্বালালাম। কিংবা ঘুমাতে যাওয়ার আগে বিছানায় যেতে যেতেই হাতের নাগালের মধ্যে যা পেলাম গুছালাম। হাজারো কাজ। খুব বেশী হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম হয়ত না। কিন্তু এই কাজগুলো ছাড়া চলেও না। এবং সবসময়ই এগুলো চলতেই থাকে। এই ধরনের কাজগুলো সবসময়ই অদৃশ্য থাকে। সবাই যেহেতু এগুলা দেখে অভ্যস্থ, আলাদা আর কোন ভ্যালু এড করে না। এরকমই তো হবার ছিল। এবার এগুলোর জন্য যেহেতু পয়সা খরচও হচ্ছে না, এ আর এমন কি।
আম্মুকে দেখতাম, কোথাও গেলে বাসায় ঢুকে মাত্র কাপড় ছাড়ার আগে কিচেনে ঢুকে খাবার ব্যবস্থা করবে। যাতে বাকিরা কাপড় ছাড়তে ছাড়তে খাবারটা এসে রেডি পায়। এরকমই তো হবে। আলাদা করে কিছু মনে হয় নি। উল্টা বিরক্ত হয়েছি, এসেই কেন কিচেনে ঢুকতে হবে। এখন আমিও তাই করি। আমি অবশ্য চেইঞ্জ করে এসে ঢুকি। যাতে এটলিষ্ট খাবারটা সময়মত পায় সবাই। এগুলো অদৃশ্য কাজই বৈকি।
কার কখন ডাক্তার লাগবে। কার কি ওষুধপত্র লাগবে। কে কি পরবে। কার কোথায় যাওয়া প্রয়োজন। কাকে কাকে বাসায় বলতে হবে। দাওয়াতে কি রান্না হবে। কোন জিনিসটা কোথায় রাখতে হবে।কাকে কি দিতে হবে। সব সময় মতোই হয়ে যায়। সবই অদৃশ্য ব্যাপার স্যাপার।
বড়দাগের কাজগুলোর সাথে কমপেয়ার করলে অদৃশ্য কাজের লিস্টি অনেক অনেক বড়। কারন এগুলো চলমান প্রক্রিয়া। একের পর এক আসতেই থাকি। টু ডু লিস্ট করে কুলানো যাবে না। এগুলো চলেতেই থাকে। এই যে ঘর গুছালাম, তার মানে এই না, এটা ছবির মতো গুছানোই থাকবে। ছোট ছোট হাতগুলো খেলনা গুলো আবার টেনে নামাবে। বই অগোছালো করবে। ড্রয়ার থেকে কাপড়গুলো অর্ধেক বাইরে থাকে, অর্ধেক কোনক্রমে ঝুলে থাকবে। ঘরভর্তি চায়ের মগ, আধ খাওয়া পানির মগ জায়গা জায়গা থেকে কালেক্ট করতে থাকতে হবে। অদৃশ্য কাজের লিস্টি শেষ হবার না।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই অদৃশ্য রিপেটেটিভ কাজগুলো মেয়েরা সবসময়ই না হলেও বেশীরভাগ সময়ই করতে ভালোবাসে। যেগুলো বেশীরভাগ সময়ই ছেলেদের মাথার উপর দিয়ে যায়। পর্দা, বিছানার চাদর তো পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে, ধুতে হবে কেন। কিংবা বাসার ফার্নিচার এত অদলবদলের কি হল (অথচ বদলালে, ভালো হয়েছে তো!) । কিংবা নতুন একটা তোয়ালে/ র্যাকেরই বা কি দরকার পড়লো। এই যে মেয়েরা এগুলো কেউ বলে দেয়া ছাড়া নিজ থেকে করে, এটা আল্লাহ্র একটা রহমত। আল্লাহ্ মেয়েদের ব্রেইন এভাবেই প্রোগ্রাম করেছেন যে মেয়েরা ঘরের-বাইরের অদৃশ্য কাজগুলো ফেলে রাখতে পারে না।
এই অদৃশ্য কাজগুলো আসলে এক একটা স্টিচ। নকশীকাঁথা বোনার মতো এক একরকমের নকশা গড়ে তোলে। ভরাট বুননে এক একটা গল্প তৈরি হয়। এক একটা সংসারের গল্প। নানান রকম, বৈচিত্র্যময়। একদম কারো সাথে হয়ত কারোটা মিলবে না। কিন্তু আমরা একজন আরেকজনেরটা বুঝতে পারবো। অনুভূতির জায়গাতে অনেক মিল থাকবে। আমি যেমন আমার মায়েরটা মনে করি এখন, কোন এক সময়ই হয়ত আমার মেয়ে মনে করবে। আমরা জীবনগুলো আগলে রাখি। অনেক অনেক কিছুর চাইতে এই আগলে রাখাটা অমূল্য।