শিশুদের “হাতেখড়ি”- বাঙলা এ শব্দটির ব্যাখ্যা হলো ‘আনুষ্ঠানিকভাবে কোন কিছু শুরু করা’। তবে প্রচলিত অর্থে শিশুদেরকে বর্ণ পরিচয় শেখানোর পদ্ধতিকে হাতেখড়ি বলা হয়। আবার হাতেখড়ির মাধ্যমে শিশুদের পড়াশুনা শুরু করার প্রথম পদক্ষেপ নেয়া হয়। এতে তার আভিধানিক ও প্রচলিত- দুই অর্থেরই মান থাকে। যেহেতু হাতেখড়ি হলো শিশুদেরকে পড়াশুনার সাথে পরিচিত করানোর প্রথম পদক্ষেপ সেহেতু হাতেখড়ি সম্পর্কে জানার আগে পড়াশুনা বা শিক্ষা ও এর প্রক্রিয়া-উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা সুগঠিত ও সুবিস্তৃত রাখা চাই।
শিক্ষা, বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা (গ্রাজুয়েশন, পোস্ট গ্রাজুয়েশন, পিএইচডি) প্রসার লাভ করে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর। আগে যেখানে মানুষ সর্বোচ্চ ১৫/১৬ বছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ করতো সেখানে ২০-২৪ বছর পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে শুরু করে।(১) আগে যেখানে ১৭ বছরেই বিয়ে করে সংসারের দায়িত্ব নিতে শুরু করতো সেখানে সরকারি চাকরি নিয়ে ২৫ বা ২৭ বছরে দায়িত্ব নিতে শুরু করে।
মূলত তারপর থেকেই বিশ্বব্যাপী পড়াশুনা ‘সরকারি চাকরি’ কেন্দ্রিক হয়ে উঠে।(২) আর এই জ্ঞানতত্ত্ব প্রসারের সাথে সাথে অর্থাৎ পড়াশুনা চাকরিকেন্দ্রিক হয়ে উঠাতে বেশিরভাগ মানুষ পড়াশুনার মূল লক্ষ্য থেকে সরে যায়। বিশেষ করে উপমহাদেশের সাধারণ মানুষ মোহাবিষ্ট হয়ে পরে। তাদের জরাজীর্ণ, আটপৌড়ে জীবনে সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা হয়ে উঠে তাদের নির্ভরতার কেন্দ্রবিন্দু যাকে ছোঁয়ার একমাত্র হাতিয়ার হলো ” প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা”। যদিও এখন অনেকেই শিক্ষার এই গৎবাঁধা নিয়ম থেকে বের হতে চাইছে এবং মা শা আল্লাহ শিক্ষার আসল অর্থ অনুধাবন করতে শুরু করেছে।
এই সরকারি চাকরির মোহ থেকে সরে এসে যদি বাস্তবিকই পড়াশুনাকে ব্যবচ্ছেদ করে শিক্ষার আসল অর্থ অনুধাবন করি, তাহলে দেখা যাবে পড়াশুনা মূলত মানুষের অন্তরের জীর্ণতা দূর করে এবং পরিচয় করায় পৃথিবীর প্রশস্ততার সাথে। পুরো প্রক্রিয়াটি মানুষের অন্তরে আলো জ্বালায়। সম্পূর্ণ কুরআনের বেশিরভাগ আয়াত শুধুই বান্দার সাথে আল্লাহর সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে, অন্তরের নানা রোগ ও তার প্রতিষেধক নিয়ে আলোচনা করে, আত্মশুদ্ধির দিকে আহ্বান করে।
মহাপন্ডিত সক্রেটিস মানুষকে সবার আগে নিজেকে জানার আহ্বান করে বলেছেন, ‘Know thyself (নিজেকে জানো)’ । সাঈদ আবুল হাসান আলী নদবী ১৯৬৭ সালে ‘দারুল উলূম নাদওয়াতুল উলামা’- এর শিক্ষাবর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তালিবানে ইলমের উদ্দেশ্যে যে বয়ান রাখেন সেখানে তিনি ‘ইখলাস ও ইখতিসাস’(৩) বিষয়ে বলেন, প্রিয় বন্ধুগণ! আজ এখানে হৃদয়ের কাগজে ঈমানের কালি দিয়ে এই মহাপ্রতীজ্ঞা লিখে নাও, আমাকে উত্তম থেকে উত্তম হতে হবে এবং এজন্য যত ত্যাগ ও কোরবানী, যত সাধনা ও মোজাহাদা প্রয়োজন তা করতে হবে, করতেই হবে। এটা তোমার কাছে আমার দাবী নয়, তোমার কাছে তোমারই আত্মার দাবী।
কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কোন গ্রন্থাগার মানুষ তৈরী করে না, বরং নিজের যোগ্যতা এবং চেষ্টা-সাধনা ও মেহনত-মোজাহাদার মাধ্যমে মানুষ নিজেই গড়ে উঠে এবং প্রতীষ্ঠা লাভ করে।”(৪)
অর্থাৎ, শিক্ষা মানুষের নিজেরই অন্তরের চাহিদা পূরণের জন্য অপরিহার্য মৌলিক চাহিদা। মানুষের নিজেরই ফিতরাত তাকে শিক্ষার মুখাপেক্ষী করে। আর শিক্ষার ফলে ব্যাক্তি নিজের যতটুকু উৎকর্ষ সাধন করবে সেটা কোন লাইব্রেরী কিংবা প্রতিষ্ঠান তাকে দিবে না, নিজেকে অর্জন করে নিতে হবে। আর কীভাবে অর্জন করতে হবে সেই পন্থাটুকু শুধু শিখতে হবে শিক্ষক বা কোন প্রতিষ্ঠানের অধীনে থেকে। তবে, এটুকু মনে রাখতে হবে যে জীবনের সকল স্তরের চাহিদা পূরণ করার সাধ্য কোন প্রতিষ্ঠানের নেই। প্রতিষ্ঠান শুধু পড়াশুনার সাথে একটি বন্ধন জুড়ে দিতে পারে মাত্র।
১৯৬৭ সালে দারুল উলূম নাদওয়াতে সাঈদ আবুল হাসান আলী নদবী পত্রস্থ বক্তব্য প্রদান করেন। যেখানে তিনি বলেছেন,’ একটি সফল নিসাবে তালীম(৫) তার শিক্ষার্থীকে শুধু যোগ্যতার একটি স্তরে উন্নীত করে যাতে সে গ্রন্থসম্ভার ও জ্ঞানভান্ডার থেকে কল্যাণজনক ফল ও সিদ্ধান্ত আহরণ করতে পারে।’(৬)
এখন পর্যন্ত এতোটুকু পরিষ্কার যে, শিক্ষা মানুষের নিজস্ব চাহিদা পূরণের হাতিয়ার। জৈবিক এবং মৌলিক এই ফিতরাত মানুষকে টেনে আনবে শিক্ষার কেন্দ্রে, মানুষ তার মনের খোরাক ও জীবনের নানা প্রয়োজন পূরণে বারবার ফিরে আসবে শিক্ষার দিকে।
এই ব্যাখ্যানুসারে পড়াশুনা হয়ে উঠে অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম। শিশুরা নিজেরই চাহিদা পূরণে বারবার প্রত্যাবর্তীত হবে বইয়ের দিকে। বইয়ের সাথে তাদের এই সম্পর্ক গড়ে তুলা কিংবা হাতেখড়ির শুরুটাও হবে তেমনি মজার, আর যদি হয় মজার তাহলে তা শুরু করতে বাবা মায়ের কষ্ট হওয়ার কথাও অনেক কম। কিন্তু প্রচলিত পন্থায় দেখা যায় হাতেখড়ি দেয়াটাই সবথেকে কষ্টসাধ্য বিষয়। এর সহজতম উপায়টা তাহলে কেমন? পরবর্তী পর্বে তা আলোচনা করবো, ওয়ামা তাওফিকী ইল্লা বিল্লাহ।
তথ্যসূত্র
১) BBC- ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২-এ Richard Fisher কর্তৃক সম্পাদিত BBC Family এর ‘Why teenagers aren’t what they used to be’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে।
২) আব্দুল্লাহ – কাজী ইমদাদুল হক
৩) ইখলাস – একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন; ইখতিসাস – কোন একটা বিষয়ে বিশেষত্ব অর্জন
৪) জীবন পথের পাথেয় – আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারকাতুহুম কর্তৃক সংকলিত
৫) নিসাবে তালীম – শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যসূচী
৬) জীবন পথের পাথেয় – আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারকাতুহুম কর্তৃক সংকলিত