আমার যাইনাবকে কন্সিভ করার ১.৫মাস পরে আমার ওয়ালিমা হয়। আলহামদুলিল্লাহ ফার্স্ট ট্রাইমেস্টারের হাতে গোনা কয়েকদিন ছাড়া আর তেমন খারাপ লাগা কাজ করেনি। শুরু থেকেই নরমাল ডেলিভারির জন্য দুয়া করতাম। সব কিছু সহজ স্বাভাবিকই ছিল আলহামদুলিল্লাহ।
১৯ সপ্তাহের দিকে আম্মু,ভাই-ভাবীর সাথে চিটাগাং গেলাম। আমার হাজবেন্ড যাননি। আমরা বিমানবন্দর স্টেশান থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম। তাই হালকা একটু দৌড়ে উঠতে হয়েছিল। চিটাগাং এ বাসায় যেয়ে ফ্রেশ হতে গিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে দেখলাম আমার সালোয়ার জুড়ে ব্লিডিং এর দাগ! অনেক ভালো পরিমাণেরই ব্লিডিং হয়েছিল কিন্তু পুরো জার্নির সময়টায় আমি কিছুই বুঝিনি। তখনো যেহেতু বাবুর মুভমেন্ট বোঝা শুরু করিনি তাই খুব ভয়ে ছিলাম। তখনই প্রথম বুঝলাম মাতৃত্ব আসলে কী! কিভাবে যে রাতটা পার করেছিলাম আল্লাহ জানেন। পাগলের মতো দুয়া করে যাচ্ছিলাম।
পরেরদিন আলট্রাসাউন্ড করাতে গেলাম। বেডে শুয়ে শুয়ে দুয়া পড়ে যাচ্ছিলাম শুধু ভয়ে। আমি ডাক্তার জানার পর ম্যাডামটা আমাকে স্ক্রিন থেকে সব দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। বাবুর হার্টবিট যখন শুনলাম সেই মুহুর্তটা আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মত না! বাবুর হাত পা নাড়াচাড়া ও দেখতে পাচ্ছিলাম। কোন প্রব্লেম ছিল না। প্লাসেন্টাও নরমাল পজিশানে ছিল। ম্যাডাম ব্লিডিং এর কারণ ধরতে পারলেন না। হয়ত স্ট্রেসের জন্য হয়েছিল। এরপর আলহামদুলিল্লাহ ভালোই কাটে।
আবার ঢাকা ব্যাক করলাম। ঢাকায় আসার পর আলহামদুলিল্লাহ ভালোই ছিলাম। আমার পিচ্চি শুরু থেকে প্রায় ৩২/৩৩ সপ্তাহ পর্যন্ত breech position এ ছিল। শেষ পর্যন্তও এই পজিশানে থাকলে তো নরমাল ডেলিভারী হবে না। খুব ছটফট লাগতো। ইউটিউব ঘেঁটে ব্যায়াম দেখতাম । কিন্তু হাঁটা ছাড়া আর কিছুই করতাম না, তাও মাঝে মাঝে। ৩১ সপ্তাহেও এমনিওটিক ফ্লুইড লেভেল অনেক ভালো ছিল, ১৫.৪ সেমি।
মাতৃত্ব ব্লগে এক আপুর লেখা পড়েছিলাম যে আপুর বেবি ৩৬ সপ্তাহেও breech ছিল, আপু হাঁটা, স্কোয়াট এগুলোর পাশাপাশি দুইটা জিনিসের কথা উল্লেখ করেছিলেন, আজওয়া খেজুর আর জমজম পানি। এই দুইটা জিনিস আমি একেবারে মাথায় গেঁথে নিলাম। ৩৫ সপ্তাহ থেকে রেগুলার আজওয়া খেতাম। আর জমজম এর পানি তো আমার জন্য সব সময় জীবন রক্ষাকারী। পাশাপাশি শুরু থেকে সকালে সুরা ফাতিহা পড়ে পানি খেতাম। আমার জেস্টেশন্যাল ডায়বেটিস ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণে ছিল, শুধু একবারই ল্যাব টেস্টে বেশি ছিল। আমার বিশ্বাস সূরা ফাতিহার বরকত এটা। যাই হোক রেগুলার সূরা ফাতিহা দম দিয়ে পড়া আর জমজমের পানি খেতাম। আমি নিজেই অনুভব করতাম যে বাবু cephalic পজিশানে এসে গেছে।
দেখার জন্য ৩৭ সপ্তাহের মাঝামাঝি (২ এপ্রিল) আরেকটা আল্ট্রাসাউন্ড করাই। ম্যাম বলেছিলেন আমার সব কিছু ঠিক আছে, পজিশন ঠিক হলে নরমাল ডেলিভারী চেষ্টা করা যাবে। আলহামদুলিল্লাহ ২রা এপ্রিল পজিশান তো cephalic দেখলাম, কিন্তু তখন ফ্লুয়িডের পরিমাণ দেখলাম অনেক কমে গেছে, ৫.৬ সেমিতে এসেছে (শেষের দিকে এমনিতেই কমে, বাড়ার সম্ভাবনা কম)। কিন্তু বাবুর movement আলহামদুলিল্লাহ সবসময়ই ঠিকঠাক ছিল। করোনার কারণে বেশি একটা বের হতেও চাচ্ছিলাম না। আমার ডাক্তারকে জানালাম, রিপোর্ট শুনে উনি চেম্বারে আসতে বললেন।
আমি বুঝে গিয়েছিলাম উনি গেলে সিজারের ডেট দিয়ে দিবেন। কিন্ত আমার মন টানছিলোনা। বাবুর movement এত ভালো, সেই সাথে ওর হার্টবিটও চেক করে দেখতাম একদম ঠিকঠাক আছে। আমি আর গেলাম না।
২ তারিখ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত মনে হয় না কোন গ্লাস পানি বাদ গেছে যেটায় সুরা ফাতিহা পড়ে খাইনি। সাথে জমজম আর আজওয়া ছিল। পাশাপাশি আমি একটা সাপ্লিমেন্ট খেতাম যেটা ফ্লুয়িডের পরিমাণ বাড়াতে কিছুটা হেল্প করতে পারে হয়তো। প্রচুর পানি খেতাম, সেই সাথে অন্য লিকুইডও খেতাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আল্লাহর কালামের শিফার উপর যে ফ্লুইড লেভেল বাড়বে। আর রিপিট আলট্রাসাউন্ড করিনি। আমার EDD ছিল ২০ এপ্রিল। ১৮ তারিখ রাত তিনটায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। কেমন জানি একটা হালকা চিন চিনে ব্যাথা হচ্ছিল। বাথরুমে যাওয়ার প্রেশার আসছিল।
এরপর যখন দেখলাম ব্যাথাটা কোমড় থেকে তল পেটে আসছে তখন বুঝলাম এটা লেবার পেইন। কিন্তু অনেক হালকা ছিল। ভেবে নিলাম আরও অনেক সময় আছে। বাসায় আগেই কিছু বলিনি। শুধু হাসবেন্ড আর ভাবি কে জানালাম (আমি বাবার বাসায় ছিলাম, হাজবেন্ড চাকরির জন্য সুনামগঞ্জ ছিলেন)। সারাদিন এমনই গেল। খুব হালকা পেইন। কিন্ত কন্ট্রাকশনের সংখ্যা বাড়ছিল। আসরের পরে ব্যাথাটা আগের চেয়ে কিছুটা বাড়লো। হঠাৎ চেক করে দেখলাম মিউকাস প্লাগ আসছে, তখন বাসায় জানালাম। হাসপাতাল ব্যাগ আগেই রেডি ছিল। আম্মু,ভাইয়ার সাথে হসপিটালে গেলাম।
আলহামদুলিল্লাহ একটুও টেনশান হচ্ছিল না। দুয়া পড়ে যাচ্ছিলাম। যখন হাসপাতালে গেলাম ওই রিপোর্টটা নেয়া হয়নি। যাই হোক,ডাক্তার চেক করলেন। ২সেমি এর মতো সারভিক্স ওপেন হয়েছে। তখন সন্ধ্যা ৭টা। এরপর ডিউটি ডাক্তার ম্যামকে ফোনে আমার নাম বলে ব্রিফ করার সময় ম্যাম সাথে সাথে বলে উঠলেন ওর তো oligohydramnios ছিল। ডিউটি ডাক্তার এটার জন্য রাগ করলেন যে কেন আমি শেষ রিপোর্ট আনিনি। আমি বললাম আমি এখনই একটা আলট্রাসাউন্ড করাবো। উনি বললেন এখন হবে না, করলে নিজের রিস্কে (উনি এরপর সম্পূর্ণ লেবার প্রক্রিয়ায় অনেক সহযোগী ছিলেন যদিও)। লেবার রুমের সিস্টার আমার কথা শুনে সাথে সাথে রেডিওলোজী ডিপার্টমেন্টে ফোন দিলেন। ম্যাম তখনই বের হয়ে যাচ্ছিলেন, সিস্টার অনুরোধ করে উনাকে আটকালেন।
আমি দেরী না করে আলট্রাসাউন্ড করাতে গেলাম। আমি জানতাম না যে ফ্লুইড কত, 8 এর নিচে হলে আমার আর নরমাল ডেলিভারী করাবে না হয়ত। দুয়া পড়তে থাকলাম। আল্লাহর কালামের উপর ভরসা ছিল। আলহামদুলিল্লাহ! ফ্লুয়িডের পরিমাণ ৯.৪সেমি যেখান ১৫.৪ থেকে কমে ৫.৬ তাও আবার এই শেষে, সেখানে শেষ সময়ে ৫.৬ থেকে ৯,৪ এ আসা মিরাক্যল ছাড়া কিছুই না!
আল্লাহর কালামের, জমজমের পানির যে কত বরকত, সেটা লেবার রুমে আবার টের পেলাম। আমার কল্পনার চেয়েও আল্লাহ সব সহজ করে দেন যেন এই দুয়া করতাম। আলহামদুলিল্লাহ ফলও পেয়েছি। আমার ডিউটি ডাক্তার আর সিস্টার যেন দৃঢ়সংকল্প ছিলেন আমার নরমাল ডেলিভারী করায় ছাড়বেন আমি হাল ছাড়লেও তারা ছাড়বে না। ডাক্তার আপু আমাকে হাঁটতে বলে দিলেন আর ব্যাথা আসলে স্কোয়াট করতে বললেন। আমি তাই করলাম। হাঁটি আর দুয়া পড়ি।ব্যা থা বেড়ে যাচ্ছিল। আমি মুখ দিয়ে একটা আওয়াজও করিনি। উল্টা রুমে সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলাম, ডাক্তার, নার্স সবাই অবাক! রাত ১০টার দিকে ব্যাথা অনেক হয়ে গেল। আর হাঁটা পসিবল ছিল না। চুপচাপ শুয়ে ছিলাম। তাও আওয়াজ করিনি। Breathing Exercise করে যাচ্ছিলাম (এই লেখায় Breathing Exercise এর বর্ণনা আছে)।
আমার ডাক্তার রাত ১১.১৫এর দিকে আসেন। করোনার জন্য উনি ইমার্জেন্সী ছাড়া আসেন না। উনি এসে চেক করে পানি ভেঙে দিলেন। তখন পর্যন্ত ৪ সে.মি খুলেছে। এরপর পিটোন চালু করা হলো। ব্যাথা ক্রমশ বাড়ছে। একসময় কেমন কোমড় ছিঁড়ে আসার আর প্রচুর টয়লেটের বেগ আসতে থাকলো। ডাক্তার আপু বলে দিলেন এরপর এমন ব্যাথায় যেন পুশ করি। ব্যাথার মাঝে আবার আরাম লাগছিল। আমি শুরুতে বুঝতে পারছিলাম না পুশ করাটা। এরপর কয়েকটা সুন্দর পুশ করার পরে ১৯তারিখ রাত ১২.৩০মিনিটে পুট করে আমার সোনাটা দুনিয়াতে চলে এলো। সব ব্যাথা ভুলে গেলাম সোনাটাকে পেয়ে (এপিসিওটোমি লেগেছিল)।
আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলবো-
১/ নরমাল ডেলিভারির জন্য সবচেয়ে জরুরি নিজের মানসিক জোর। পজিটিভ থাকবেন আর প্রচুর দুয়া করবেন।
২/ লেবার পেইন অনেক বেশি হবে। আপনি এটার জন্য শুরুতে বেশি চিৎকার করে ফেললে পরে এনার্জি একটু কম পাবেন। চিৎকারে কিন্তু ব্যাথা কমে না। পেইন মেনেজমেন্টে Breathing exercise খুব উপকারী।
৩/ সব চেষ্টার পরেও ইমার্জেন্সী বলে একটা কথা থাকে। সেখানে সিজার লাগলে কোনভাবেই নিজের মনকে ছোট করবেন না। বাবু আর আপনার সুস্থতাই সবচেয়ে বড়।
আল্লাহ সব মায়েদের গুনাহ মাফ করে দিন।
(লিখেছেন: উম্মে যাইনাব)
ছবি কৃতজ্ঞতা: Freepik