২০১৮ সালের রমাদান মাস চলছে। কিছু দিন থেকে কিছুটা দূর্বলতা অনুভব করছি। সেদিন সম্ভবত ১৪/১৫ রোযা, ইফতার করার পরই বমি হলো। ইফতারির ভাজাপোড়ার গন্ধ সহ্য হচ্ছেনা। যেহেতু, আগে থেকেই আমরা এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তাই বুঝতে দেরি হলো না। তারপর প্রেগন্যান্সি টেস্টের কীট নিয়ে বাসায়ই পরীক্ষা করে ফেললাম। আলহামদুলিল্লাহ, রেজাল্ট পজিটিভ।
যেহেতু বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম, তাই আমার হাজবেন্ড ফযরের পরই তার এক ডাক্তার বন্ধুকে কল দিয়ে জানালেন। উনি কিছু পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি কিছু মেডিসিন দিলেন, যেন আমার দূর্বলতা কাটে।
শুরুর দিকে তো মর্নিং সিকনেস থাকে অনেকেরই। আর আমি রোযাও রাখছিলাম। দুটো একসাথে মিলেই হয়তো দূর্বলতাটা বেশি ছিলো। সারাদিন মাথা উঁচু করতে পারতাম না। সে সময়টা দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাসায় একা থাকতে হতো। আলহামদুলিল্লাহ, আমার আম্মু- আব্বু এই সংবাদটা শোনার কিছুদিন পর আমার কাছে চলে আসেন।
ঢাকা থাকতে আমার কয়েকবার ব্লিডিং দেখা দিলো, কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। আবারও আমার হাজবেন্ড উনার বন্ধুর সাথে পরামর্শ করলেন, উনি বললেন আল্ট্রাসাউন্ড করতে। আব্বু- আম্মুর সাথে যেহেতু কয়েকদিন পরই উনাদের বাসায় চলে যাবো তাই সেখানে গিয়েই ডাক্তার দেখানোর ইচ্ছা ছিলো।
প্রথম ট্রাইমিস্টারে ডাক্তাররা জার্নি করতে নিষেধ করেন। কিন্তু আমার যেতেই হবে এজন্য ট্রেনকে বেছে নেওয়া হলো, কারণ বাসের থেকে ট্রেনের ঝাঁকি কিছুটা কম। ঈদের কিছুদিন আগে একটা কেবিন নিয়ে আমি, আম্মু আর আব্বু বাসায় চলে এলাম।
তার কিছুদিন পর প্রথমবার ডাক্তারের কাছে গেলাম। আমার ব্লিডিং হচ্ছে শুনে আল্ট্রাসাউন্ড করতে বললেন। রিপোর্ট নরমাল, আলহামদুলিল্লাহ। বাবুর হার্টবিট এসেছে। তবে মিসক্যারেজ যেন না হয় সেজন্য মেডিসিন দিলেন এবং ইনজেকশন নিতে বললেন ৮টা সপ্তাহে ১টা করে।
আমার শুরু থেকেই ইচ্ছা ছিলো নরমাল ডেলিভারির। আমি যে ডাক্তারকে দেখাতাম উনার কাছে আমার প্রায় সব চাচী, ফুফু, আমার বড়বোনের সি-সেকশন হয়েছে। আর এখনকার ডাক্তাররা নরমাল ডেলিভারি করাতে চান না ইত্যাদি ইত্যাদি শুনতে শুনতে আমার দ্বিতীয় চেকআপের সময় আমি উনাকে বললাম আমি নরমাল ডেলিভারি করতে চাই। উনি আস্বস্থ করলেন নরমালে যদি হয়, তাহলে উনি নরমালেই করাবেন।
ইতোমধ্যে এই বিষয়গুলো নিয়ে টুকটাক পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছিলাম। আমি নরমাল ডেলিভারি চাই, কিন্তু ভয়ের জায়গা ছিলো এপিসিওটপি. অনেকের মতো আমিও ভাবতাম আমাদের নানী-দাদীর কত কত বাচ্চা নরমালে হয়েছে তাদের তো এগুলো লাগেনি, তাহলে আমাদের কেনো! এই বিষয়টা নিয়ে পরিচিত এক ডাক্তার আপুর সাথে কথা বললাম। উনি বললেন, ‘আগের সময়ের তুলনায় এখনকার সময়ে বাচ্চার মৃত্যুর হার অনেক কমেছে। তাছাড়া এটা নরমাল ডেলিভারিতে এটা স্বাভাবিক, হতে পারে। বড় বাচ্চা নরমালে হওয়াতে গেলে সাইড কাটলে সহজেই ডেলিভারী হয়।’ এই আলোচনার পর থেকে মেন্টালি প্রিপারেশন নিতে থাকলাম। কারণ, নরমাল ডেলিভারি যেহেতু চাই, এটা মেনে নিতে হবে। আগে থেকে মেন্টালি প্রিপারেশন থাকলে কষ্টের জিনিসওগুলোও বেশ সহজ হয়ে যায়।
যখন আমার সাত মাস প্রেগন্যান্সি চলছে, তখন একজন ডাক্তারের ভিডিও থেকে জানতে পারলাম, খেজুর খাওয়ার কথা। এইসময় রেগুলার খেজুর খেলে জরায়ুর মুখ নরম হয়। যেটা নরমাল ডেলিভারি হতে সাহায্য করে। রেগুলার নিয়ম করে খেজুর খাওয়া শুরু করলাম। আরো জানতে পেরেছিলাম বিভিন্ন ধরনের এক্সারসাইজ করার কথা। সেসময় যে ভিডিও গুলো দেখেছি, সবগুলোতে বলা ছিলো, নিজের ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে তারপর করতে। কিন্তু আমার ডাক্তার এমন কিছু করতে বলেননি। আবার যেহেতু নরমাল ডেলিভারি চাই, তাই টুকটাক এক্সারসাইজ করতাম। কিন্তু শেষের কয়েকমাস নিয়মিত ত্রিশ মিনিট করে হাঁটতাম।
আমার ফুফুর তিন বাচ্চা, সবগুলো নরমাল ডেলিভারি। ফুফু আমাকে বেশ উৎসাহ দিতেন। বারবার বলতেন, “নরমাল ডেলিভারি হলে কষ্ট হবে, অনেক ব্যথা হবে আর সেটা সহ্য করতে হবে। যদি সহ্য করতে না পারিস, নরমাল ডেলিভারি করতে পারবিনা।“ এই কথাগুলো আমাকে বেশ সাহায্য করেছে কষ্ট সহ্য করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে, আলহামদুলিল্লাহ।
নরমাল ডেলিভারি জন্য আমার পক্ষে যা যা করা সম্ভব ছিলো আমি করেছি। আরো একটা জিনিস যেটা অনেক অনেক বেশি করেছিলাম, সেটা হচ্ছে ‘দুআ’। আল্লাহর কাছে খুব খুব করে দুআ করতাম, যেন সব সহজ হয় আমার জন্য। কতজনের তো কত সমস্যা হয় ডেলিভারির সময়, বাচ্চার মাথা আটকে যায়, প্ল্যাসেন্টা বের হয়না, কতকিছু। আমার যেন সহজ হয়ে যায়। কষ্ট সহ্য করেও যেন নরমাল ডেলিভারি হয়। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমার জন্য অনেক সহজ করে দিয়েছিলেন।
৩৮ সপ্তাহ। চেকআপে গেলাম। আল্ট্রাসাইন্ডে EDD আসলো ১৫ জানুয়ারি। আর সেদিন ছিল ১২ জানুয়ারি। বাবুর ওয়েট এসেছে ৩ কেজি ৩০০গ্রাম+। ডাক্তার দেখে বললেন, “বাচ্চা হয়তো ২/৩ দিনের ভিতরই হয়ে যাবে। আর যদি না হয় ১ সপ্তাহ পর আবার এসো।“
বাসায় ফিরলাম। রাত ১০ টার দিকে হটাত মনে হলো, পানির মতো কিছু বের হচ্ছে। চেক করে দেখলাম হালকা গোলাপী রং এর পানি। আগেই পড়েছিলাম এটাকে “শো” বলে। লেবার পেইন শুরু হওয়ার পূর্ব সংকেত। তারপরও এক ডাক্তার বোনের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলাম। আপু বললেন, ব্যাগ গুছিয়ে রাখতে, যেকোনো সময় হসপিটালে যেতে হতে পারে। আমি বেশ এক্সাইটেড ছিলাম। টুকটাক পড়াশোনা ছিলো তাই ভয় তেমন কাজ করছিল না। আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম কখন ব্যথা শুরু হবে আর আমার বাচ্চাটা দুনিয়াতে আসবে।
রাতে খেজুর আর যমযমের পানি পাশে নিয়ে ঘুমালাম। ভেবেছিলাম রাতেই হয়তো ব্যথা শুরু হবে। কিন্তু না! মাঝ রাতে বেশ কয়েকবার ঘুম ভাঙলো, ব্যাথা নেই। ফযরের সময় হলো। সামান্য ব্যথা আসা যাওয়া করছে, বুঝতে পারছি। লেবার পেইন একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর কয়েক সেকেন্ডের জন্য আসে। আবার চলে যায়। সময় যত যায়, ব্যথা বাড়তে থাকে আর ব্যথা আসা যাওয়ার গ্যাপ কমতে থাকে। সারাদিন যে ব্যথা আসা যাওয়া করেছে, তা আমার সহ্যসীমার মধ্যে ছিলো। সন্ধ্যার দিকে একজন মিডওয়াফকে ডেকে আনা হলো, যিনি এসে চেক করলেন আমার জরায়ুর মুখ কতটুকু খুলেছে। (আমি অবশ্য হসপিটালেই ডেলিভারি হোক চাচ্ছিলাম, কিন্তু ব্যথা বেশি না উঠা পর্যন্ত যেতে চাচ্ছিলাম না, কারণ ডাক্তার যদি বলে বসে সি-সেকশন লাগবে, সেই ভয়ে। যেহেতু আমার সব ঠিক ছিল, আলহামদুলিল্লাহ। তাই ভরসা পাচ্ছিলাম বাসার থাকার। মিডওয়াইফ চেক করে বললেন, রাতে ভিতর ডেলিভারী হয়ে যাবে, ইন শা আল্লাহ্।
রাত ১০ টা। তখনও যে ব্যথা আসছে সহ্য করছি। কষ্ট হচ্ছিলো, কিন্তু সহ্য করছিলাম। আমার ডাক্তারকে কল করলাম। উনাকে জানালাম আমার ব্যথা শুরু হয়েছে, তবে এখনো সহনশীল মাত্রাতেই আছে। হসপিটালে আসতে চাচ্ছি। উনি বললেন, চলে আসো।
কিন্তু কথা বলার পর, কিছু কারণে আমার আর মন সায় দিলো না হসপিটালে যাওয়ার। বারবার মনে হচ্ছিল, এখন গেলে হয়তো সি-সেকশন করে দিবে। ব্যথা অসহনশীল হয়ে গেলে যাবো। বাসায় জানালাম, আমি এখন যেতে চাইনা। আম্মু একটু খাইয়ে দিলো। আর আমি বারবার যমযমের পানি খাচ্ছিলাম। সবাইকে বললাম শুয়ে পড়তে। আমিও কিছুটা ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু ব্যথা উঠলেই জেগে যাচ্ছিলাম। আমার পাশে তখন আমার হাজবেন্ড ছিলো। তাই বাকীরা যে যার রুমে শুয়ে পড়েছে।
রাত দেড়টা বা ২টার কাছাকাছি। ব্যথা আর সহনীয় মাত্রায় নেই। আমার হাজবেন্ড আমার আম্মুকে ডাক দিলো। আম্মুকে বললাম, আমার নিচের দিকে চাপ আসছে। সবকিছু তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। চুপ থাকতে চেয়েও পারছিলাম না। অটোমেটিক মুখ দিয়ে ব্যাথার আওয়াজ বের হচ্ছে। (আমি ভেবেছিলাম হসপিটালে যাবো, আরো অনেকক্ষণ ব্যথা হবে তারপর বাবু হবে। আসলে অনেক বেশি ব্যথা সহ্য করতে হবে এটা মাথায় এমন ভাবে সেট হয়ে ছিলো, যে মনে হচ্ছিলো এর থেকেও আরো ব্যথা বাকী আছে।) কিন্তু একবারও সি-সেকশন করে ফেলি একথা মাথায় আসেনি, আলহামদুলিল্লাহ।
হসপিটালে পৌছালাম রাত ৩টার দিকে। আম্মু গাড়িতে থাকতেই ডাক্তারকে কল দিয়েছিলো। হসপিটালে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো, ডাক্তারকে ফোন দেওয়া হলো। উনি বলে দিলেন আমাকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যেতে। ডেলিভারি রুমের গেটেই আমার পানি ভেঙ্গে গেলো। মনে হলো আমার ব্যথা যেনো আগের থেকে কমে গেলো। বেডে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ডাক্তার আসা পর্যন্ত আমার আম্মু আমার পাশেই ছিলো। ডাক্তার আসার পর আম্মুকে থাকতে দেওয়া হলোনা। আমাকে অক্সিজেন আর স্যালাইন দেওয়া হলো।
ডাক্তার বললেন, ব্যথা যখন আসবে তখনই পুশ করতে। আমি চাপ দিতে থাকলাম। হাঁপিয়ে যাচ্ছি। একটু নিশ্বাস নিয়ে আবারও পুশ। দেখলাম ডাক্তার এপিসিওটমি করলেন, কিন্তু কোনো ব্যথা পেলাম না। আর এটা করার পরের চাপেই আমার ৩ কেজি ২০০ গ্রামের বাচ্চার জন্ম হলো, আলহামদুলিল্লাহ।
বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর হঠাত করেই আমার প্রচন্ড কাঁপুনি উঠলো। কোনো ভাবে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিনা। ডেলিভারি রুমে এমন কিছু ছিলো না, যেটা গায়ে দিয়ে আমাকে চেপে ধরবে। বারবার বলছি আমার আম্মুকে ডেকে দেন, কিন্তু তারা জানালেন সেটা সম্ভবনা। কাঁপুনির মধ্যেই সেলাই করা হলো। স্কিনের উপর সেলাইগুলোতে ব্যাথা পেয়েছিলাম। ৩/ ৪টা সেলাই লেগেছিলো। আমাকে রুমে দেওয়ার পরও কাঁপুনি ছিলো বেশ সময়। আম্মু কম্বল, কাঁথা নিয়ে গিয়েছিলো যেগুলো দিয়ে আমাকে চেপে ধরা হয়েছিলো যেন কাঁপুনি কমে। আলহামদুলিল্লাহ্ যে আমার নরমাল ডেলিভারী হয়েছে। আমার অনেক আত্মীয়রা এই খবরে অবাক হয়েছিলো। আল্লাহ্ আমার জন্য অনেক অনেক সহজ করেছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ্।
(মেইল ইনবক্স থেকে প্রাপ্ত)
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ হাফিংটন পোষ্ট ডট কম।
[এপিসিওটমি নিয়ে পড়তে পারেন আমাদের আর্টিকেল স্বাভাবিক প্রসবেও কি কাঁটাছেঁড়ার দরকার হয়? – এডমিন]