গর্ভকালীন ও প্রসবোত্তর পা ব্যথাঃ প্লান্টার ফ্যাসিয়াইটিস

প্রেগ্ন্যান্সি এমন একটা সময় যখন স্বাভাবিক হাঁটা চলা, কাজ কর্ম সব কিছুতেই  অসুবিধা তৈরি হয়। যে আপনি অনায়াসে সিঁড়ি ভাংতে পারতেন, দৌড়ে দৌড়ে কাজ করতে পারতেন, ঠায় দাঁড়িয়ে নানান পদের রান্না করতে পারতেন, সেই আপনিই প্রেগ্নেসিতে সিঁড়ি দেখলে পালাতে চাইবেন, দৌড়ানো তো দূরের কথা, হাঁটাহাঁটি করতেও পায়ে ব্যাথা পাবেন। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করলে তো সেই পা নিয়ে আর নড়াচড়াই করতে পারবেন না।

এইসব অসুবিধা তৈরি হবার বিশেষ কিছু কারণ আছে যা প্ল্যান্টার ফ্যাসিয়াইটিস নামে পরিচিত। এবং এর প্রতিকারও আছে। এই লেখায় গর্ভাবস্থা ও প্রসবোত্তর পা ব্যথা বা প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস এর আদ্যোপান্ত নিয়ে কথা বলবো।

প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস কী

আমাদের পায়ের গোড়ালি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত কিছু টিস্যু আছে যেগুলো এই দুইয়ের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে। এই টিস্যুগুলোর নাম প্ল্যানটার ফ্যাসিয়া।

পায়ের পাতার নীচে থাকা এই টিস্যুগুলো যদি ফুলে যায় বা জ্বালা পোড়া করে, তখন প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়।গর্ভবতী ও সদ্য মা হওয়া নারীদের মাঝে এটি বেশ কমন।

কেন হয় প্ল্যানটার ফেসিয়াইটিস

যে সকল কারণে গর্ভবতী নারীদের প্ল্যানটার ফেসিয়াইটিস হয় তা হচ্ছে-

১। রিলাক্সিন হরমোনের প্রভাবঃ

প্রেগ্ন্যান্সিতে হবু মায়ের প্লাসেন্ট্রা থেকে রিলাক্সিন নামে একটি হরমোন নিঃসৃত হয়।এই হরমোন গর্ভবতীর শরীরের লিগামেন্টকে শিথিল করে তোলে যেন প্রসবের সময় প্রয়োজনীয় নমনীয়তা তৈরি হয়। তবে, প্রসবে সাহায্য করতে গিয়ে এই হরমোন হবু মায়ের অন্যান্য অঙ্গ যেমন পা, কোমর- ইত্যাদিকেও শিথিল করে দেয় যার ফলে মায়ের শরীরে ব্যথা, ব্যালেন্স কমে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয়।

এই রিলাক্সিন হরমোন গর্ভবতীর পায়ের পাতার পেশিকেও শিথিল করে দেয় যা থেকে প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস তৈরি হয়।

২। গর্ভাবস্থায় বাড়তি ওজনঃ

 স্বাভাবিকভাবেই একজন গর্ভবতী নারীর শরীরে অনেক বাড়তি ওজন যোগ হয়। এই বাড়তি ওজনের চাপ পড়ে পায়ের উপর। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে ওজন যখন অনেক বেড়ে যায়, সেই ওজন এর ভার বহন করতে গিয়ে পায়ের ফেসিয়া টিস্যুতে চাপ পড়ে এবং তা থেকে প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস দেখা দেয়।

৩। ওভারপ্রোনেশন বা পায়ের পাতা সমতল হয়ে যাওয়াঃ

 প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস হবার আরেকটি কারণ হচ্ছে পায়ের পাতা সমতল হয়ে যাওয়া, যাকে বলা হয় ওভারপ্রোনেশন (Overpronation) যা সাধারণভাবে ফ্ল্যাট ফিট (Flat Feet) নামেও পরিচিত।

অতিরিক্ত ওজনের চাপের কারণে পায়ের বাঁকগুলো সমতল হয়ে যায় ও হাঁটার ভঙ্গি বদলে যায়। ফলস্বরূপ, প্ল্যানটার ফেসিয়াতে চাপ পড়ে প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস দেখা দেয়।

এই প্রধান কারণগুলো ছাড়াও অন্যান্য যে কোন কাজ যাতে পায়ের উপর চাপ পড়ে, বা লম্বা সময় পায়ে রুপর ভর দিয়ে কাজ করতে হয় কিংবা পায়ের গঠন ভিন্ন হয়- এসব কারণেও প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস দেখা দিতে পারে।

প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস এর লক্ষণসমুহ

প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস এর কিছু সাধারন লক্ষণ বা উপসর্গ আছে। সেগুলো হচ্ছে-

১। পায়ের গোড়ালির নীচে ব্যথা ও জড়তা অনুভুত হওয়া যা পায়ের পাতার মাঝামাঝি জায়গাতেও অনুভূত হতে পারে।

২।দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে বা ঘুম থেকে উঠে মেঝেয় পা ফেললে পায়ের পাতায় ব্যাথা হওয়া। এটি কিছুক্ষণ হাঁটলে এমনিতেই ঠিক হয়ে যায়।

৩। পায়ের পাতার কিছু অংশে চাপ দিলে ব্যাথা লাগে আবার বাকি অংশে ব্যথা লাগে না।

৪। দীর্ঘসময় হাঁটা, দাঁড়ানো বা ব্যায়াম করলে পায়ে ব্যাথা হওয়া।এই উপসর্গগুলো প্রেগ্নেন্সির সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পায় কারণ দিনে দিনে গর্ভবতীর ওজনও বৃদ্ধি পায়, শরীরে রিলাক্সিন এর প্রভাব তৈরি হয়, ওয়েডেমা (Oedema) বেড়ে যায়। তবে প্রসবের পর এটা আস্তে আস্তে ঠিক হতে থাকে।

প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস এর প্রতিকারঃ

প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস এর প্রতিকার হিসেবে নিম্নোক্ত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।

ঘরোয়া প্রতিকার

প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস এর চিকিৎসায় ঘরোয়া পদ্ধতিগুলোর সমাদর বেশ উচ্চ পর্যায়ের, এই পদ্ধতির সাফল্যের হারও ভালো। এই চিকিৎসায় প্রায় ৯০% রোগীর অসুবিধা ১০ মাসেরও কম সময়ের মাঝে নিরাময় হয়েছে বলে জানা গেছে।

ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে নীচের কাজগুলো করতে পারেন-

১। প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিন ও পায়ে চাপ পড়ে এমন কাজ এড়িয়ে চলুন। যেসব কাজ দাঁড়িয়ে করতেন সেগুলো বসে বা শুয়ে করা যায় কিনা চেষ্টা করুন। মোট কথা, পায়ের উপর চাপ কমান।

২। ঘুমানোর সময় পা আপনার হৃদপিণ্ডের উচ্চতার চেয়ে ৬ ইঞ্চি উপরে তুলে রাখুন- এভাবে ১৫ মিনিট থাকুন। এতে রক্ত সঞ্চালন উন্নত হবে। এই কাজের জন্য বিছানায় শুয়ে পায়ের নীচে বালিশ দিয়ে রাখতে পারেন।

৩। ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে দিনে ৩-৪ বার পায়ে ঠাণ্ডা পানি বা বরফ লাগাতে পারেন।

৪। ঘুমানোর সময় পায়ে স্প্লিন্ট বেঁধে নিতে পারেন।

৫। খুব ভালো মানের নরম ও আরামদায়ক জুতা পরবেন যেটা আপনার পা-কে সাপোর্ট দেবে, এতে পায়ের বাঁকগুলো চাপের মুখে পড়বে না।

ব্যায়াম

প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস প্রতিকারে ব্যায়াম খুব কার্যকরী বলে বিবেচিত। ঘরে বসেই সহজ কিছু ব্যায়াম করলে এক্ষেত্রে উপকার পেতে পারেন।

১।পায়ের পাতা বাঁকা করা- ঘুম থেকে উঠে পায়ের পাতা আপনার চেহারার দিকে বাকিয়ে আনুন, তিন পর্যন্ত গুণে ছেড়ে দিন। এভাবে ১০ বার করুন। এতে করে ঘুম থেকে উঠার পরে পা ফেললে যে কষ্ট হতো তা কমবে।

পায়ের পাতা বাকা করা

২। মাসাজ- পায়ের পাতায় মাসাজ করুন, এটাও আপনাকে আরাম দেবে।

৩।পায়ের আঙ্গুল বাঁকানোর ব্যায়াম- এখানে সংযুক্ত ছবির মতো করে পায়ের পাতা না নাড়িয়ে কেবল আঙুলগুলো যতটা সম্ভব ছড়িয়ে দিন, তিন পর্যন্ত গুণে আবার স্বাভাবিক করুন।

এভাবে ৫ বার বা আরও বেশি করুন। এটাও ঘুম পরবর্তী অস্বস্তি থেকে আরাম দেবে।

পায়ের আংগুল বাকানো ও ছড়ানো

৪। পায়ের গোড়ালি উঁচু করা- ঘুম থেকে উঠে বিছানার কোনায় বসুন, পায়ের পাতা ফ্লোরে রাখুন। এখন, পায়ের আঙ্গুল মেঝেয় রেখে শুধু গোড়ালি উঁচু করুন, আবার আগের মতন পুরো পাতা ফ্লোরে রাখুন। আবার পায়ের আঙ্গুল মেঝেয় রেখে গোড়ালি উপরে তুলুন। এভাবে দ্রুত ৩০ বার করুন।

এবার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ান এবং দাঁড়িয়ে এটা আরও ৩০ বার করুন।

এই ব্যায়ামটি প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিসের উপশমে খুবই আরামদায়ক হয়।

(ভালোভাবে বোঝার জন্য সংযুক্ত ছবি দেখুন)

পায়ের গোড়ালি উচু করা

৫। পায়ের আঙ্গুল স্ট্রেচ করা- মেঝেয় বসে পা সামনের দিকে প্রসারিত করে দিন, এবার পায়ের বড় আঙ্গুলগুলো ধরে নিজের দিকে টানুন। এভাবে ধরে রাখুন ১৫-৩০ সেকেন্ড।

এরপর ছেড়ে দিন ও আবার করুন। এই ব্যায়াম প্রতি পায়ে তিন-চারবার করুন। আরাম পাবেন।

পায়ের আংগুল স্ট্রেচ করা

৬। দেয়ালের সাথে পা স্ট্রেচ-

দেয়ালের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ান। এবার দুই হাত দেয়ালে রাখুন, যেন হাত আপনার চোখের সমান্তরালে থাকে। এবার ডান পা এক ধাপ পেছনে নিন ও পায়ের গোড়ালি মেঝেয় থাকা অবস্থায়ই সামনে থাকা বাম পা এমনভাবে বাঁকান যেন পেছনের ডান পায়ে টান পরে। এভাবে ১৫-৩০ সেকেন্ড থাকুন।এবার অন্য পায়েও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করুন।

এখন স্বাভাবিক হন।

এভাবে পুরো প্রক্রিয়া আরও দুই তিনবার করুন।

 দেয়ালের সাথে পা স্ট্রেচ করা

এই ব্যায়ামগুলো নিয়মিত করলে আপনার প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস এর উপশম হবে আশা করা যায়।

প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস চিকিৎসায় ঔষধ

এতক্ষণ ঘরোয়া যেসব প্রতিকার বর্ণিত হয়েছে, সেসবের পাশাপাশি আপনাকে ওষুধ খেতে হতে পারে, যদি সমস্যা খুব বেশি হয়।

তবে, ওষুধ খাবার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, নিজের পছন্দে যে কোন ব্যথানাশক খাওয়া যাবে না, বরং ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

অপারেশন

 প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস যদি খুব বেশি হয়, ছয় মাসের বেশি সময় ধরে এই রোগ থাকে ও আপনার দৈনন্দিন কাজে বাঁধা সৃষ্টি করে, তবে অপারেশন করতে হতে পারে।

তবে এই সিদ্ধান্ত কেবল ডাক্তার নেবেন।

পরিশেষে বলা যায়, প্ল্যানটার ফ্যাসিয়াইটিস কোন জটিল রোগ নয়। নিয়মিত ব্যায়াম, লাইফস্টাইল ঠিক রাখা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে যত্ন নিলে এ থেকে আরাম পাওয়া যায় এবং প্রসবের পর নিয়মিত যত্নে এটি আস্তে আস্তে উপশম হয়ে যায়। আর খুব জটিল হলে ডাক্তারের পরামর্শ তো রইলই।

তাই ভয় না পেয়ে প্রেগ্ন্যান্সি উপভোগ করুন ও নিয়মিত নিজের যত্ন নিন।

আরো পড়ুন: প্রসব পরবর্তী পা ফোলা নিয়ে আমাদের আর্টিকেল দেখতে পারেন।

তথ্যসূত্র

১।Plantar fasciitis

২।Plantar Fasciitis in pregnant Mums

৩।Plantar Fasciitis Develops in Pregnant Women

৪।Quick and Easy Excercises to Treat Plantar Fasciitis


লেখাটি রিভিউ করেছেন:
ডাক্তার ফারহানা আফরোজ,
মাতৃত্ব অনলাইন ক্লিনিক
এপয়েন্টমেন্ট নিন