প্রথমবার মেয়েকে নিয়ে একা দেশে গিয়েছি কানাডা থেকে, ১৫ মাস বয়স তখন তার। এরপর ছেলেকে নিয়েছি ৬ মাস বয়সে, তখন মেয়ে সাড়ে তিন বছর। এরপর আবার গিয়েছি যখন বাচ্চাদের বয়স এক বছর আর চার বছর। নানা কারনে একা ট্রাভেল করতে হয়েছে। নর্থ আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ বিশাল জার্নি। লম্বা সময় প্লেনে কাটাতে হয়। প্রায় ১৯ ঘন্টার বেশি। প্লেনের বদ্ধ জায়গায় জার্নি, বড়দের জন্যই কষ্টকর হয়ে যায়, আর বাচ্চাদের জন্য বলাই বাহুল্য। তার উপর মাঝখানের ট্রানজিটের সময় এক এক এয়ারলাইন্সে এক এক রকম। আমরা যারা দেশ থেকে এতটা দূরে থাকি, বাধ্য হয়ে অনেকসময় বাচ্চা নিয়ে একা ট্রাভেল করতে হয়। এক্ষেত্রে অনেকের অনেক রকম জিজ্ঞাসা থাকে। স্পেশালি যারা প্রথম এরকম লম্বা ট্রাভেল করবেন বলে প্ল্যান করছেন। তাই আমি আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি, যদি কারো কাজে লাগে।
বাচ্চাদের নিয়ে ট্রাভেলের ক্ষেত্রে প্রথমে যে জিনিসটা লাগে সেটা হলো মনোবল, যে আপনি পারবেন। শুরু থেকেই প্রচুর দু’আ করুন, যাতে আল্লাহ্ গোটা জার্নিটাকে আপনার জন্য সহজ করে দেন। বিশেষ করে একা হাতে এই লম্বা সময় জার্নি করতে হলে, আপনাকে মনে রাখতে হবে যে কষ্ট হবে, কিন্তু এটা অসম্ভব না। অন্তত সপ্তাহ খানেক আগে থেকে প্রস্তুতি নিন ব্যাগ গুছানোর। বাচ্চার জন্য কী কী লাগতে পারে তার একটা লিস্ট করে ফেলুন। কাপড়-চোপড়, ডায়াপার, ওষুধ, খাবারদাবার, স্ন্যাক্স, দরকারে খাবার পানি সবকিছুর একটা লিস্ট করে ফেলুন। লিস্ট ধরে ব্যাগ গুছান, তাহলে কোন কিছু বাদ পরার সম্ভবনা থাকবে না। যেহেতু ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে ওজনের একটা বিধিনিষেধ থাকে ( ইকোনমিতে ট্রাভেল করলে বয়সভেদে বাচ্চারা একটা থেকে দুইটা লাগেজ পায়), তাই পরিকল্পনা মাফিক জিনিসপত্র গুছালে অনেক কিছু সহজ হয়।
আপনার মনে হতে পারে এত কিছু সাথে নেয়ার দরকার কী, দেশে সবকিছু পাওয়া যায় এখন। সব পাওয়া যায় হয়ত, কিন্তু বাচ্চা যেসব জিনিসে অভ্যস্থ, তার জন্য সেগুলো নেয়া যুক্তিসংগত। যেমন ধরুন, ডায়াপার। সব ডায়াপার সব বাচ্চাকে স্যুট করে না। যে ডায়াপার র্যাশ ক্রিম আপনি বাচ্চার জন্য ব্যবহার করেন বা যেটাকে আপনার কাছে কার্যকর মনে হয়, জরুরী দরকারে সেটা আপনি হাতের কাছে নাও পেতে পারেন। যে বেবি সিরিয়াল বা বেবি ফুডসগুলো বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন, যা হয়ত সে পছন্দ করে খাচ্ছে, আপনি দেশে পৌঁছা মাত্রই তা জোগাড় নাও করতে পারেন। প্রথম বার দেশে ট্রাভেল করা বাচ্চাদের জন্য খাবার পানি (অন্তত শুরুতে কিছুদিন খাওয়ানোর জন্য হলেও) বেশ কাজের জিনিস। বাচ্চাকে আপনি দেশে নিয়ে একটা সময় পানি দিবেনই, কিন্তু তার আগে সে যদি আস্তে আস্তে জীবাণুর সাথে পরিচিত হয়, তাহলে শুরুতেই পেট খারাপের ধকল সহ্য করা লাগে না।
লাগেজ গুছানোর পর হ্যান্ড লাগেজ, ব্যাকপ্যাক বা ডায়াপার ব্যাগ গুছাতে পারেন সবার শেষে। খুব প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া অন্য কিছু সাথে না রাখাই ভালো। যে জিনিসগুলো খুব দরকার যাত্রাপথে, সেগুলো ছাড়া বাকিগুলো বড় লাগেজে নিয়ে নিন। হাত যত হালকা রাখতে পারবেন, তত আপনার জন্য ভালো। কারন পথে বাচ্চা সামলানোর মহান দায়িত্ব আপনাকেই একা পালন করতে হবে। কয়েকটা ব্যাগ না করে সম্ভব হলে একটা ব্যাগ নিন। হাত খালি রাখতে চাইলে ব্যাকপ্যাক নিতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে হ্যান্ড লাগেজ টানার চাইতে অনেকে পিঠে ব্যাগ ঝুলানো বেশি পছন্দ করেন। আবার ব্যাক পেইনের মতো সমস্যা থাকলে হ্যান্ড লাগেজও টানতে পারেন। কী নিবেন ব্যাকপ্যাকে? বাচ্চার পানির বোতল, স্ন্যাক্সস (শুকনো বেবি সিরিয়াল, ড্রাই ফ্রুটস, চিপস, কুকিজ এই ধরনের খাবার), পর্যাপ্ত ডায়াপার-ওয়াইপ্স, ব্রেস্টফিডিং করালে ব্রেষ্টফিডিং কাভার, প্যাসিফায়ার, বাচ্চার সবচাইতে পছন্দের খেলনা/বই/রং করার জিনিসপত্র (বয়স ভেদে), যাত্রাপথে দরকারি ওষুধ (টাইলানল/এডভিল, নাজাল স্প্রে, নাক বন্ধ হয়ে গেলে পরিষ্কার করার পাইপ, গ্যাসের ওষুধ), বাড়তি দুই এক সেট কাপড়, ছোট কম্বল, ছোট ট্রাভেল ব্যাগে বাচ্চার জন্য ডায়াপার র্যাশ ক্রিম, লোশন নিতে পারেন, আপনার জন্য ওষুধ (মাথা ধরা, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ, ইনহেলার, যার যা প্রয়োজন), টাকাপয়সা/ কার্ড রাখার পার্স, চ্যাপস্টিক, এবং অতিঅবশ্যই পাসপোর্ট। মোটকথা আপনার এই জার্নিতে লাগছে না, এমন কোন ভারী কিছু সাথে না রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
যাওয়ার দিন এয়ারপোর্টে আগে আগে যান। আপনার সিট বুকিং দেয়া থাকলে এইসময় বুকিং হয়। আপনার বাচ্চা ছোট হলে ব্যাসিনেট লাগলে এইসময় ওরা তা বন্টন করে। ব্যাসিনেট চাওয়ার ভিত্তিতে দেয়। নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যাসিনেট থাকে ফ্লাইটে। কাজেই কোন কারনে ফ্লাইটে ছোট বাচ্চার সংখ্যা বেশি হলে, আগে গেলে আগে পাবেন ভিত্তিতে ব্যাসিনেট দেওয়া হয়। এই ব্যাসিনেটগুলোর একটা নির্দিষ্ট ধারণ ক্ষমতা থাকে। বাচ্চার বয়স বেশী হলে কিংবা নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যেই ওজন বেশী হলে ব্যাসিনেট পাবেন না। ২ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য দুই রকম বসার ব্যবস্থা থাকে। এক হলো ল্যাপ সিট, যেখানে বাচ্চার জন্য আলাদা সিট থাকে না। বাচ্চা বাবা বা মায়ের কোলে বসে যেতে হবে, এক্ষেত্রে পুরো টিকেটের টাকা নয়, বরং অল্প কিছু টাকা দিতে হবে। ব্যাসিনেটের সুবিধা পাবেন সাথে। দুই হচ্ছে বড়দের মতন বসার সিট, সেক্ষেত্রে আপনাকে ফুল টিকিটের দাম পরিশোধ করতে হবে। হালকা পাতলা বাচ্চা অনায়াসে বাবা-মায়ের কোলে বসে যেতে পারে। বাচ্চা বয়সের তুলনায় ভারী কিংবা বড় হলে ব্যাসিনেট কোন কাজে আসে না। কাজেই কোন কারনে ব্যাসিনেট না পেলে হা হুতাশ করার কোন কারন নেই। সেক্ষেত্রে আপনি সিট বুকিং এর সময় রিকোয়েস্ট করতে পারেন পাশে খালি সিট আছে, এমন কোন সিটে আপনার বসার ব্যবস্থা করা যায় কিনা। তাহলে বাচ্চা ঘুমালে আপনি অনায়াসে পাশের খালি সিটে রেখে দিতে পারবেন। এটা এয়ারপোর্টে করা না গেলে, আপনি প্লেনে কেবিন ক্রু-দের রিকোয়েস্ট করে দেখতে পারেন। সাধারনত সিট খালি থাকলে ওরা ব্যবস্থা করে দিতে পারে।
এয়ারপোর্টে বাচ্চাকে বয়ে নেয়ার জন্য স্ট্রলার সাথে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে হালকা পাতলা সামার স্ট্রলার হলে সবচেয়ে ভালো। ভারী স্ট্রলার আপনার জন্য সমস্যার কারন হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে স্ট্রলারের ক্ষেত্রে মনে রাখবেন, এটা আপনাকে প্লেনের গেটে দিয়ে দিতে হবে। রিকোয়েস্ট করতে পারেন, আপনি প্লেন থেকে নেমেই সেটা দরজা থেকে নিতে পারেন কিনা। তা না হলে ওরা ওটা লাগেজ সেকশনে পাঠিয়ে দিলে, আপনাকে সেটা আপনার শেষ গন্তব্যে গিয়ে মেইন ব্যাগেজের সাথে ব্যাগেজ বেল্ট থেকে সংগ্রহ করতে হবে, ট্রানজিটে পাবেন না। তবে কোন কোন এয়ারপোর্টে যেমন দুবাই এয়ারপোর্টে বাচ্চাদের বয়ে নেয়ার জন্য স্ট্রলার পাওয়া যায় এয়ারপোর্টে যেটা আপনাকে এয়ারপোর্টে নেমে সংগ্রহ করতে হবে। তবে কোন কারনে বেশী সংখ্যক ফ্লাইট এক সাথে ল্যান্ড করলে এবং বাচ্চাদের সংখ্যা বেশী হলে, এই স্ট্রলারগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে না। ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে আপনার ব্যাক পেইনের সমস্যা না থাকলে বেবি ক্যারিয়ার ইউজ করতে পারেন। বাচ্চাকে বুকের কাছে কিংবা পিঠে ঝুলিয়ে রাখার জন্য এগুলো বেশ কাজের। হাঁটতে পারার মতো বয়সী বাচ্চাদের (তিন প্লাস), হাঁটতে উৎসাহী করে তুলুন। এতে আপনার কষ্ট কম হবে। এই বয়সী বাচ্চাদের জন্য হ্যান্ড রিস্ট বেল্ট পাওয়া যায়, যার এক মাথা বাচ্চার হাতে বাঁধা থাকে, আরেক মাথা মায়ের হাতের কবজির সাথে লাগানো থাকে। এই ধরনের বেল্টগুলো বাচ্চা যাতে হাঁটতে হাঁটতে খুব বেশী দূর চলে যেতে না পারে তাতে বাধা দেয়।
বাচ্চা বুঝার মতো বয়স হলে যাত্রার আগে বাচ্চাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নিন। বাচ্চাকে বলেন আপনারা একসাথে অনেক দূরে যাবেন, রাস্তায় অনেক মজা হবে, এয়ারপোর্টে কে পৌঁছে দিতে যাবে, কারা আপনাদেরকে এয়ারোর্টে নিতে যাবে। বারবার বললে বাচ্চা আগে থেকে কল্পনা করবে এবং গোটা ব্যাপারটাকে মজা হিসেবে নিবে। রওনা হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে থেকে বাচ্চারা যাতে সুস্থ থাকে সেই চেষ্টা করবেন। অসুস্থ বাচ্চা এমনিতেই বিরক্ত করে। ঠাণ্ডা যাতে না লাগে আগে থেকে খেয়াল রাখেন। বাচ্চার যাতে পেট খারাপ না থাকে, কিংবা কন্সটিপেশন না হয়, তার চেষ্টা করেন। পেট ঠাণ্ডা থাকলে দেখবেন বাচ্চাও ভালো থাকবে। বাচ্চার টিকা আপডেটেড করে রাখেন। অনেকে ট্রাভেল করার আগে ট্রাভেল ক্লিনিকে নিয়ে বাচ্চাদের টিকা দেওয়ান সতর্কতা হিসেবে। আমি কখনো বাচ্চাদের দেওয়াইনি।
যাওয়ার আগে মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করবেন। আপনি নিজে ভালোমতো খাওয়া দাওয়া করবেন। দূর পাল্লার ভ্রমণে ডিহাইড্রেশন হতে পারে তাই পানি খাবেন প্রচুর। মনে রাখবেন, আপনি পরিশ্রমী হলে, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারলে, বাচ্চা সামলানো সহজ হবে আপনার জন্য। কম বয়সী বাচ্চারা প্লেন টেক অন-অফের সময় কানের উপর প্রেশার পরে বলে প্রচুর কান্নাকাটি করতে পারে। এময় বাচ্চাকে ব্রেষ্টফিডিং করান, মুখে ফিডার দিন বা প্যাসিফায়ার দিন। ইনফ্যান্ট সিটবেল্ট দিবে আপনাকে, যেটা আপনার সিটবেল্টের সাথে একটা ছোট এক্সট্রা সিটবেল্ট হিসেবে লাগাতে হবে। এটার মাধ্যমে বাচ্চা আপনার কোলে একটা নিরাপদ অবস্থানে থাকবে। খালি টেক অন-অফের সময়ই না, প্লেন মাঝ আকাশে মাঝেমাঝেই এয়ার পকেটের মধ্যে পড়ে। এরকম দূর্যোগের মধ্যে নির্দেশ থাকে সিটবেল্ট বাঁধার, এরকম প্রতিবারেই আপনাকে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তার ইনফ্যান্ট সিটবেল্টটাও বেঁধে ফেলতে হবে। এমনকি এই সময়গুলোতে বাচ্চা ব্যাসিনেটে ঘুমালেও তুলে কোলে নিয়ে ইনফ্যান্ট সিট বেল্ট বাঁধতে হয়। কেভিন ক্রু-রা এসে চেক করে যায়। বাচ্চার সিকিউরিটির জন্যই এটা দরকার। প্লেনে জরুরী অবস্থায় কী করতে হবে, তার নির্দেশ শুরুতেই ছবিসহ বলে দেয়। খুব ভালোমতো খেয়াল করবেন। ইনফ্যান্ট লাইফ জ্যাকেট আপনাকে শুরুতেই সিটের নীচে রাখতে দিয়ে যাবে। যে কোন জরুরী অবস্থায় যেমন অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার কিংবা লাইফ জ্যাকেট পরার ক্ষেত্রে আগে নিশ্চিত করবেন, আপনারগুলো আপনি ঠিকমতো ব্যবহার করছেন। কারন আপনি নিরাপদ থাকলেই আপনি বাচ্চাকে নিরাপদ রাখতে পারবেন। সিটবেল্ট সাইন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সিট বেল্ট বেঁধে রাখবেন।
ব্রেস্টফিডিং করা বাচ্চাদের জন্য সুবিধা হলো, কান্নাকাটি করলেই আপনি বাচ্চাকে ব্রেস্টফিড করতে দিতে পারেন। এজন্য ব্রেস্টফিডিং কাভার খুব জরুরী । এই কাভারগুলো বাচ্চা টান দিয়ে সরিয়ে ফেলতে পারে না। আপনি নিশ্চিন্তে ব্রেস্টফিড করাতে পারেন। এছাড়া অন্যসময় আপনি বাচ্চাকে প্যাসিফায়ার না দিলে যাত্রাপথে শান্ত রাখার জন্য দিতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে একটু আগে থেকে দিয়ে কিছুটা অভ্যস্থ করে নিতে হবে। বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে উৎসাহ দিন নিজের সিটবেল্ট নিজেকে বাঁধতে। তাহলে প্রয়োজনের সময় শুধু আপনাকে মনে করিয়ে দিলেই হবে, বেঁধে দিতে হবে না। ওরা ঘুমিয়ে পড়লেও উৎসাহিত করেন সিটবেল্ট বেঁধে ঘুমাতে, এতে দূর্যোগের সময় জাগিয়ে সিটবেল্ট বাঁধার ঝামেলা হবে না। বাচ্চার সবচাইতে পছন্দের স্ন্যাকস সাথে রাখুন পর্যাপ্ত পরিমাণে। ক্যান্ডি কিংবা জুস অন্যসময় বাচ্চাকে না দিলেও, কান্নাকাটির সময় গুলোতে দিতে পারেন। বাচ্চা শান্ত থাকবে। কিংবা বাচ্চাকে ভালো থাকার পুরষ্কার হিসেবে দিতে পারেন।
প্লেনের বাথরুমে বাচ্চাদের ডায়াপার পাল্টানোর চেইঞ্জিং স্টেশন থাকে। সাধারনত কমোডের উপরের দিকে ল্যাচ টানার সাইন থাকে। অনেক এয়ারলাইনে ছোট ডায়াপার ব্যাগ গিফট করে। কোন কারনে ডায়াপার শেষ হয়ে গেলে কেবিন ক্রু-দের কাছ থেকে চেয়ে নিতে পারবেন। হঠাত পিরিয়ড শুরু হলে, প্রস্তুতি না থাকলে, স্যানিটারি প্যাডও পাবেন। আপনি একা ট্রাভেল করলে, বাচ্চাকে কেউ দেখার না থাকলে, বাথরুমে যাওয়ার সময় কেবিন ক্রুদের সাহায্য চাইতে পারেন। অনেক বাচ্চাই ফ্লাইটে ক্রমাগত কাঁদতে থাকে। আপনি সামনের সিট না পেলে করিডোরের পাশের সিটে বসার চেষ্টা করবেন। এতে বাচ্চাকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করা সহজ হবে। এরকম হাঁটাহাঁটি আপনার জন্যও ভালো। এতে হাতে পায়ে ভালো রক্ত চলাচল করে। পানি, জুস, হালকা স্ন্যাক্স আপনার আর বাচ্চাদের জন্য চেয়ে নিতে পারেন প্রয়োজনে। লিকুইড ছোট দুধের কৌটাও চাইতে পারেন দরকারে। খাবার গরম করার ব্যবস্থা থাকে প্লেনে। কেবিন ক্র-দের বললে ওরা করে দেবে। মোটকথা যে কোন প্রয়োজনে চুপ করে না থেকে কেবিন ক্রু-দের সাহায্য চাইবেন। যাত্রাপথে সহযাত্রীরাও সচরাচর সাহায্য পরায়ণ হয়।
বাচ্চাকে যতক্ষণ সম্ভব ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারেন। যতক্ষণ জেগে থাকবে, ততক্ষণ ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন। বাচ্চাকে খেলনা দিন খেলতে, গল্প শোনান, বই পড়ে শোনান। বড় বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখতে অন্যসময় স্ক্রিন টাইম না দিলে প্লেনে দিতে পারেন। বয়স উপযোগী বাচ্চাদের কার্টুন, গেইমস বা সিনেমা থাকে। ছেড়ে দিতে পারেন। বড় বাচ্চারা এগুলা নিয়েও কিছু সময় ব্যস্ত থাকে। বাচ্চা কান্নাকাটি, জেদ করতে পারে এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অল্প কাজেই (নিজে খাবার খেলে, ছোট ভাই-বোনের দেখাশোনা করলে) উৎসাহ দিন অনেক, প্রচুর হাই-ফাইভ দিন, বারবার বলুন আপনি কতটা গর্বিত ওকে নিয়ে। অর্ধেক কাজ এমনিতেই আদায় হয়ে যাবে। প্লেনে বাচ্চাদের সময় কাটানোর জন্য ছোট কিটস গিফট করে অনেক সময়ই, ওখানেও এক্টিভিটিজ থাকে নানারকম।
ট্রানজিটে কেয়ারফুল থাকবেন। অনেক সময় অল্প সময় ট্রানজিট হলে বাচ্চা সাথে নিয়ে দৌড়াতে হয়। পাসপোর্ট এবং বাচ্চা সাবধান। যে ব্যাগে পাসপোর্ট থাকবে, সেটা খুব সাবধানে রাখবেন। কোন কারনে পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে আপনি এয়ারপোর্টে আটকা পড়বেন। বাচ্চা এটা সেটাতে মুখ দেয় কিনা খেয়াল রাখবেন। ওয়েট টিস্যু খুব ভালো কাজে দেয় যে কোন জিনিসে জীবাণু নিষ্ক্রিয় করতে । লম্বা সময় টানজিট হলে কোন একটা চুপচাপ নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বের করবেন। এয়ারপোর্টে লাউঞ্জ থাকে। পেইড লাউঞ্জে আপনি অনায়াসে বাচ্চাকে নিয়ে সময় কাটাতে পারেন। ফ্যামেলি লাউঞ্জ থাকে কোন কোন এয়ারপোর্টে, কিডস কর্নার থাকে। এগুলো ঘুরে দেখতে পারেন। কিছু এয়ারপোর্টে সালাতের রুম থাকে। সেখানে বাচ্চাকে নিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে পারেন। ব্রেস্টফিডিং রুম থাকে প্রায় প্রতি এয়ারপোর্টে, সেখান থেকে ব্রেস্টফিড করিয়ে আনতে পারেন। খাবার দোকান থাকে, খাবার কিনে নিতে পারেন। হালাল কিনা জিজ্ঞেস করে নিতে পারেন আগেই। অনেক সময়ই লম্বা ট্রানজিটে ফুড কুপন দেয়। সংগ্রহ করে নিতে হয়। টুকটাক কেনাকাটাও করতে পারেন এয়ারপোর্টের ডিউটি ফ্রি দোকান থেকে। আগে থেকে ব্যবস্থা করা থাকলে অনেক এয়ারলাইন্সে ৮ ঘণ্টার বেশি ট্রানজিটে হোটেলের ব্যবস্থা থাকে। সেক্ষেত্রে এয়ারপোর্ট থেকে আপনাকে গাড়িতে হোটেলে পৌঁছে দিবে আবার ফিরিয়ে আনবে। আপনাকে নিজ দায়িত্বে সেই গাড়ী ধরতে হবে। হোটেল পেলে সুবিধা হচ্ছে বাচ্চাদের নিয়ে বিশ্রাম করে আবার ফিরতে হবে। ট্রানজিটে ওই শহরের ভিসা থাকলে আপনি শহর ঘুরে বেড়াতে পারেন।
গন্তব্যে পৌঁছানোর পর আপনাকে ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ নিতে হবে। অনেক এয়ারপোর্টে পোর্টার সিস্টেম থাকে। আপনি একা ট্রাভেল করলে এরা আপনাকে লাগেজ সংগ্রহ করতে সাহায্য করবে। আশেপাশে কাউকে না পেলে এয়ারপোর্টে কর্মরত লোকদের সাহায্য নিন। এয়ারপোর্ট এমন একটা জায়গা যেখানে আপনি জিজ্ঞেস করলে যে কোন ধরনের সাহায্য পাবেন। এমনকি যাত্রাপথে সাধারনত লোকজন বেশ সহযোগী হয়। বাচ্চা নিয়ে যেকোন ধরনের সমস্যায় আপনি কেবিন ক্রু থেকে শুরু করে এয়ারপোর্টে কাজ করে এমন লোকদের কাছে সাহায্য চাইতে পারেন। আমাকে এখন পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পরতে হয়নি।
বাবা-মায়েদের জন্য টিপসঃ
- যদি বাচ্চার জন্য ল্যাপ সিট নেন, ৬ মাসের বড় বাচ্চার জন্য ব্যসিনেটের চেয়ে পাশে একটা অতিরিক্ত খালি সিট যোগাড় করতে পারলে বেশি ভালো হয়
- বাচ্চার পছন্দের হালকা পাতলা খেলনা বা এক্টিভিটিজ সাথে রাখেন। বয়সে বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ট্রাভেলের এক সপ্তাহ আগে থেকে এগুলো দিবেন না, যাতে ট্রাভেলের সময় সেগুলোকে আকর্ষণীয় মনে হয়।
- পছন্দের স্ন্যাক্স দিয়ে ব্যস্ত রাখতে পারেন। দুই একটা ললিপপ বা ক্যান্ডি টাইপ জিনিস রাখতে পারেন পুরষ্কার অথবা বিপদের বন্ধু হিসাবে।
- একা ট্রাভেল করলে, এয়ারপোর্টে যেখানেই যাবেন, বাচ্চাকে সাথে নিয়ে যান। দরকার হলে বাথরুমেও। নিশ্চিত করবেন যেন বাচ্চা নিরাপদ আছে।
- বাচ্চাকে প্রয়োজনীয় ফোন নম্বর মুখস্থ করিয়ে দিন, অথবা বাচ্চার জামার সাথে কোন কারনে বাচ্চা হারিয়ে গেলে কোন নাম্বার বা ঠিকানায় যোগাযোগ করতে হবে, সেগুলো ট্যাগ করে সাথে দিন।
- যে বয়সেরই হোক, বাচ্চার সাথে গল্প করুন। হাঁটতে শেখা বাচ্চাদের বোঝান ট্রাভেলটা মজার কিছু, এটা একসাথে মজা করে শেষ করবেন।
- বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়লে (জ্বর বা পেটব্যাথা) টুকটাক দরকারি ওষুধ সাথে রাখবেন, যাতে আপনি চট করে খাইয়ে দিতে পারেন। সাথে না থাকলে কেবিন ক্রু বা এয়ারপোর্ট অথরিটির সাহায্য নেন।
- বাচ্চা ট্যানট্রাম করলে ধৈর্য্য ধরুন। মনোযোগ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করুন। বাচ্চা হাঁটতে পারলে তাকে মাঝেমাঝে করিডোরে হাঁটতে দিন।
- ধৈর্য্য, ধৈর্য্য এবং ধৈর্য্য। ধৈর্য্যের কোন বিকল্প নেই। পরিস্থিতি যাই হোক আপনার মাথা ঠাণ্ডা রাখবেন।
লম্বা সময় প্লেন যাত্রা ক্লান্তিকর। বড়দের জন্য যেমন, বাচ্চাদের জন্যও তাই। আপনি শারিরীকভাবে সুস্থ থাকলেই সম্ভব গোটা জার্নিটা পার করা। ভ্রমণের কয়দিন আগে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, পুষ্টিকর খাবার খান। মোট কথা এনার্জি লেভেল ভালো রাখার চেষ্টা করেন। বাচ্চা নিয়ে ট্রাভেল করাটা একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা যেটা সুখকর হোক কিংবা না হোক, নিঃসন্দেহে আপনার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবে।