নভেম্বর ২৩, ২০২০। সেদিন আমার ৩৯ সপ্তাহ ২ দিন। ঠিক ভোর ৪.৩২ মিনিটে ঘুম ভেঙ্গে যায়। রাতে ২-৩ বার ঘুম ভেঙ্গে গেলেও মোটামুটি ভালোই ঘুম হয়। ওয়াশরুম থেকে এসে আবার শুয়ে পড়ি। খানিক বাদে মনে হলো আবার ইউরিন ইশ্যু! শেষ দিকে যা হয় আর কি। আমার প্রথম সন্তানের সময় ৩৮ সপ্তাহের দিন ওয়াটার ব্রেক করেছিল। কিন্তু এবার ৩৬ সপ্তাহ থেকেই একটু একটু করে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেও কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আমি সেদিনও ভাবিনি যে ওয়াটার ব্রেক করতে পারে তাও আবার সারা রাত ঘুমানোর পর। তো আলহামদুলিল্লাহ ঐ সময়েই ওয়াটার ব্রেক করলো।
এদিকে আমার জামাই সারা রাত জেগে মাত্র ঘুমিয়েছেন। উনার আসলে অফিসের কাজের ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছিল গত ১-১.৫ মাসে। যেটা আমার ৩৯-৪০ সপ্তাহের দিকে অনেকটা কমে যাওয়ার কথা। আর হ্যা বলে রাখি আমরা দেশের বাহিরে থাকি। এই একই বছরের জানুয়ারি মাসে আমরা নতুন শহরে মুভ করি। যেহেতু প্যানডেমিক চলছে তাই কোনো নতুন বন্ধু হয়নি। প্রতিবেশীদেরও জানার সুযোগ হয়নি। আমাদের চিন্তার একটা বড় অংশ ছিল আমার লেবারের সময় আমি অপারেশন থিয়েটারে থাকলে আমার ২.৫ বছরের ছেলে কোথায় থাকবে। প্যানডেমিকের কারণে পেশেন্টের সাথে শুধু একজন ভিজিটরের ভিতরে ঢোকার অনুমতি ছিল। ছোট বাচ্চাকেও তারা অনুমতি দিবে না বলে জানিয়েছিল। আমি অবশ্যই চাইছিলাম এই দূর পরবাসে আমার জামাই অন্তত আমার পাশে থাকবে লেবারের সময় টাতে। কিভাবে কি করব কিছু বুঝতে পারছিলাম না। শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তাহলে আমি একাই হাসপাতালে থাকব আর ছেলে থাকবে তার বাবার সাথে।
তো ওই দিন ভোরে ওয়াটার ব্রেক করার পর ভাবলাম মাত্র তো ৫ টা বাজে, দিনের আলো ফুটুক আর ছেলে সাধারণত ৭.৩০-৮.৩০ টার মাঝে ঘুম থেকে উঠে, ও-ও উঠুক, এর মাঝে ছেলের বাবা একটু ঘুমিয়ে নিক যেহেতু উনি রাত জেগে অফিসের কাজ করেছেন। ৯ টা বাজলে আমি ঘুম থেকে ডেকে তুলব না হয়। প্রথম সন্তানের ডেলিভারীর এক্সপেরিয়েন্স অনুযায়ী ওয়াটার ব্রেক করার বেশ কয়েক ঘন্টা পরে পেইন শুরু হয়েছিল সে জন্য আমি এমনটা পরিকল্পনা করছিলাম।
খানিক বাদে ফোনে আগে থেকে নোট করে রাখা অনুযায়ী কিচেনে গিয়ে খেজুর খেয়ে নিলাম। মারইয়াম আলাইহিসসাল্লামকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা প্রসব বেদনার সময় খেজুর খেতে বলেছিলেন।
তখন মনে হয় ৫.৩০ টা কি ৬ টা বাজে। অসম্ভব ব্যাথায় কুকড়ে উঠলাম। ভয় হল। যেহেতু ওয়াটার ব্রেক হয়ে গিয়েছে এখন কি না কি হয়ে যায়। ব্যাথা টা আসা যাওয়া করছে। পুরোপুরি ব্যাথা শুরু হয়ে গেল অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই। জামাইকে শান্ত গলায় ডাকলাম। উনি এতো ক্লান্ত যে কয়েকবার ডাকার পরও উঠলেন না। কিন্তু আমার যে অবস্থা উনাকে ডেকে তুলতে হলো। জানালাম ওয়াটার ব্রেক করেছে। উনি সাভাবিক ভাবেই নিলেন, বললেন- “আচ্ছা আর আধা ঘন্টা ঘুমাই?”
আমি উনার অবস্থা তো জানতাম – তাই চলে এলাম অন্য রুমে। হ্যা, ব্যাথা ৪ মিনিট পরেই আবার আসল। আমি পেইন মেনেজম্যান্টের জন্য কিছু পড়াশোনা করেছিলাম। সে অনুযায়ী ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে বিছানায় ভর দিয়ে রইলাম। অসম্ভব ব্যাথায় কান্না করে দিলাম। অটোমেটিক মুখ দিয়ে শুধু আল্লাহ আল্লাহ আওয়াজ আসছিল। গোঙ্গানী শুনে এবার জামাই এর ঘুম ভেঙ্গে গেল, নিজেই দৌড়ে এল। জিজ্ঞেস করলেন কি করব; হাসপাতালে কল দিতে বল্লাম। তারা আসতে বলল তখুনি।
আমার হাত পা ছেড়ে দিল। বিকট আওয়াজ বের হলো অটোমেটিক। বাওয়েল মুভমেন্ট হল তবে স্পষ্ট মনে হল বাবু বুঝি চলে আসছে! জামাই ছেলেকে ঘুম থেকে তুললেন। জামা কাপড় পরালেন যত দ্রুত সম্ভব। আমিও রেডি হলাম কোনো মতে। জামাইকে বল্লাম আমাকে কিছু খাইয়ে দিতে যেহেতু লেবার পেইন সহ্য করার জন্য আর শেষের দিকে পুশ করার জন্য অনেক এনারজি লাগে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমি নুডুলস বানিয়ে রেখেছিলাম। জামাই ছেলেকে দিল একটা প্লেটে আর আমাকে খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু আমি একটু খেতেই বমি হয়ে গেল। তারপর আবার প্রচন্ড ব্যাথা – আবার বিকট চিতকার। আবার হাত পা ছেড়ে দিল। মনে হচ্ছিল যদি সেন্সলেস হয়ে যেতাম তাহলে হয়ত এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাব।
ঘড়িতে তখন পৌনে ৭ টার মত বাজে। হাসপাতালের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম আমরা। আমরা থাকি ৫ তলায়। আমাদের ফ্ল্যাট থেকে লিফটের কাছাকাছি যেতে খানিকটা পথ হেটে যেতে হয়। আমার মনে হচ্ছিল ওই হলওয়ে পার হয়ে লিফট ধরতে আমার আজীবন লাগবে। ছেলে আগেই হেটে লিফটের সামনে দাড়িয়ে ছিল।
নিচে নামলাম। গাড়িতে উঠলাম। দেখাল ৩৪ মিনিট লাগবে পৌছুতে। গাড়িতে তেল নেই। তেল নেওয়া হল। কুরআন তিলাওয়াত চলছিল। আমার কথা গুলো অস্পষ্ট শোনাচ্ছিল। যেতে যেতে পুরোটা রাস্তায় শুধুই গোঙ্গিয়েছি। দুয়া ইউনুস দুয়া ইউনুস বলে চিতকার করছিলাম। নিজে পড়তে পারছিলাম না। জামাই নিজে পড়া শুরু করেছিলেন। তাতে ভাল লাগছিল। তখনো পৌছুতে ১৫-২০ মিনিটের মত বাকি। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম বাবু চলে এসছে। আমি পুশ করলেই ও চলে আসবে। আমি যেন আটকে রাখছি তাকে। আমি এটা বলতে পারছিলাম জামাইকে যে বাবু তো চলে আসছে! ৩-৪ বার এমন হল। একবার মনে হল পেটের ভিতরে ভুটুশ করে পানি ভরতি বিশাল বেলুনের মত ভেঙ্গে গেল।
৩৪ মিনিট পর আমরা পৌছলাম। ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে ঐ সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম এপিডুরাল (যা আমি না নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম এবং প্রস্তুতি নিয়েছিলাম যেন না নিতে হয়) অথবা যেটাই দরকার এই ব্যাথা থামানোর জন্য সেটাই বলব করে দিতে। হায়রে, সিচুয়েশন মানুষকে কত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে/করতে বাধ্য করে। হাসপাতালের গার্ড আমার চিৎকার শুনে দৌড়ে এল হুইল চেয়ার নিয়ে। আমি জুতা খুলেই হুইল চেয়ারটায় বসলাম কোনো মতে। জামাই গার্ডকে বললেন গাড়িতে ছেলে বসে আছে একটু যেন দেখে রাখে।
তারপর আমাকে হুইল চেয়ারে নিয়ে আমার জামাই দৌড়ে ঢুকে গেলেন হাসপাতালের ভিতরে। রিসিপশনের মহিলা দ্রুত ইমারজেন্সী তে ফোন দিল। আর একটা মহিলা এল আর আমাদেরকে করিডোর ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে ডিরেকশন দিতে দিতে নিয়ে গেল লিফটের কাছে। ৭ তলায় গিয়ে নামলাম। ৮-১০ জন আকাশী রঙ্গের ড্রেস পরা নার্স এবং আমার মিডওয়াইফ চলে এল। আমাকে করিডোরের পাশেই ইমার্জেন্সি রূমে নিল। বেডের কাছে নিয়ে একজন বলল- “Come on honey, you’re gonna do it!”
উঠে দাড়ানোর শক্তি ছিল না, ভেবেছিলাম পারব না, কয়েক সেকেন্ড শুন্যে তাকিয়ে চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে শুলাম বিছানায়। ওরা মিনিটের মধ্যে আমাকে রেডী করিয়ে বলল “Push push push… the head is here!” তারপর পুশ করতেই চলে আসল আমার মেয়ে পৃথিবীতে সকাল ৭.৩৪ মিনিটে। আলহামদুলিল্লাহ।
আমাকে ওই করিডোরের ইমার্জেন্সি রুমে রেখে জামাই নিচে ছেলের কাছে চলে গিয়েছিল। আগেই বলেছি কোভিডের কারণে জামাই ছাড়া আর কারো হাসপাতালের ভিতরে ঢোকার অনুমতি ছিল না। কিন্তু আমাদের অবস্থা যেহেতু ইমার্জেন্সি ছিল তাই ছেলেকে ঢুকতে দিয়েছিল ওরা। একটু পরে জামাই এসে দেখে আলহামদুলিল্লাহ আমার বুকে আমাদের দ্বিতীয় সন্তান। দ্বিতীয় বারের মত অ্যাম্বিলিকাল কর্ড কাটলেন আমার জামাই। নার্স এসে জামাইকে বলছিল, “she is a rockstar!” পরে এক সময় আমার জামাইও আমাকে বলেছিলেন তুমি আসলেই রকস্টার।
সব কিছু এতো জলদি হয়ে গিয়েছিল যে আমার প্রাথমিক ডাক্তারের কাছে খবর পৌছুতে পৌছুতে বাবুই এসে হাজির। গত ১-২ ঘন্টার মধ্যে কি হয়ে গেল বোঝার চেষ্টা করছিলাম। আল্লাহ, আমার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা তুমি কতোই মহান!
এবার শেয়ার করি আমি কি কি ফলো করার চেষ্টা করেছিলাম আমার প্রেগন্যান্সীর সময়ে। যদি কোনো টিপস কারো উপকারে আসে। পুরো প্রেগন্যান্সীতে যতটা সম্ভব কেগেল এক্সারসাইজ করার চেষ্টা করতাম। সপ্তাহে ২-৪ দিন ১৫-৩০ বারের মত স্কোয়াট করার চেষ্টা করতাম। সাথে খুব কমন এক্সারসাইজ কমোড ছাড়া টয়লেটে বসার মত সেটাও করতাম। সময় পেলে আর শরীর সায় দিলে মাসে অন্তত ২-৩ বার হলেও বাহিরে হেটে আসতাম। ৩৬ সপ্তাহের পর কয়েক দিন বাসার ভেতরেই সল্প পরিসরে ঘড়ি দেখে ৮-১৫ মিনিটের মত হাটার চেষ্টা করেছিলাম।
একটু প্রথম প্রেগন্যান্সীর কথা বলি যখন আমার পুরো ৯ মাস ধরে অসম্ভব কষ্ট হয়েছিল। কিছু খেতে পারতাম না। ৩ মাস পানিও খেতে পারি নি, জোর করে একটু পানি খেতে গেলেও বমি হয়ে যেত। দুবার ইউরিন ইনফেকশনের কারনে দুই ডোজ অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হয়েছিল। আর বিদেশ জীবনের অন্যান্য কঠিন পরিস্থিতির কথা না বলি। তো আমার প্রথম সন্তানের ডেলিভারীর সময় খুব বাজে টিয়ারিং হয়েছিল। এইবারও আমার টিয়ারিং হয়েছিল তবে সেকেন্ড ডিগ্রী।
যেহেতু ২য় প্রেগন্যান্সীর সময় আমি খেতে পারতাম অর্থাৎ খাওয়ার রুচি ছিল প্রথম থেকে তাই আমি এটাকে টারগেট করেছিলাম যে আমি সাস্থ্যকর খাবার খাব এবং তা হবে আমার নিজের হাতের করা। এর জন্য দেখা যেত সপ্তাহে ৪-৫ দিন আমি ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘন্টা দাড়িয়ে রান্না করেছি। আমাদের নতুন বাসায় রান্নাঘরের ফ্লোরের কিছু অংশ ছিল যেটা মুছে পরিষ্কার করার মত। ঘর মুছা কিন্তু খুব ভালো এক্সারসাইজ। প্রেগন্যান্সীর সময় বেশ কিছুক্ষণ টানা দাড়িয়ে থাকাটাই যেহেতু চ্যালেঞ্জিং আর সেই জায়গায় ঘর মুছাটা তো বটেই। আমি যেন অ্যাক্টিভ থাকি শেষ পর্যন্ত – এটা ছিল আমার নিয়ত এবং গোল। পানি ভাঙ্গার আগের রাতেও আমি টানা অনেকক্ষণ দাড়িয়ে কাজ করে কাটিয়েছিলাম। আর আমার টডলার ছেলের সাথে সময় কাটানো তো আছেই। ওকে কোলে নিয়ে হাটতাম যখন পারতাম। সঠিক নিয়মে ওজন তোলা কিন্তু ভালো এক্সারসাইজ। আমি যা কিছু করেছিলাম ডাক্তারের সাথে আগে কথা বলে নিয়েছিলাম।
আর একটা ব্যাপার মেনে চলার চেষ্টা করতাম সেটা হল হাসিখুশি থাকা। মানসিক ভাবে শক্ত আর পজিটিভ থাকা। আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতা’লাই তো আমাদের সর্বোত্তম অভিভাবক – এতো দুশ্চিন্তা করব কেন? দুয়া অবশ্যই পাওয়ারফুল। খুব ইচ্ছা ছিল পুরো কুরআন একবার পরে শেষ করা, পরে পারিনি যদিও।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা আমার মেয়েকে নেক বান্দী হিসেবে কবুল করুন। উম্মাহর উপকারে আসার তাউফিক দিন। আমাকে এবং আমার পুরো পরিবার বর্গকে জান্নাত লাভের পথটা সহজ করে দিন।
(লিখেছেন উম্মে ফাতিমা)