ইদানিং পত্রিকার পাতা উল্টালে হেডলাইনে প্রায়ই দেখা যায় যে, অমুক আত্মহত্যা করে মারা গিয়েছে। আর এই আত্মহত্যার পিছের রহস্য উদঘাটন করলে অনেকের ক্ষেত্রেই দেখতে পাই, ডিপ্রেশন জগতের এক অদৃশ্য বেড়াজাল তাকে আকড়ে ধরে রেখেছিল, যা থেকে পরিত্রাণ পেতেই এমন হতাশাজনক মৃত্যুকে বেছে নিতে হলো!
আমরা হয়তো ভুলিনি, এই তো মাস কয়েক আগেরই কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় ধুম পড়ে গিয়েছিল একটি নিউজ নিয়ে! সুশান্ত সিং রাজপুত, যিনি কিনা খুবই জনপ্রিয় একজন তারকা ছিলেন ডিপ্রেশনের এই বেড়াজাল থেকে তিনিও বাদ যান নি, বেছে নিয়েছেন মৃত্যুকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) হতাশাকে উচ্চ আয়ের দেশগুলোর মধ্যে রোগের বোঝার (disease burden) অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বর্তমানে আত্মহত্যা হতাশার সবচেয়ে মারাত্মক পরিণতি এবং তরুণ তরুণীদের মধ্যে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।
এছাড়াও আরো অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো দ্বারা আমরা হতাশাকে চিহ্নিত করতে পারি-
- নিজেকে অযোগ্য মনে করা
- অপরাধবোধ এর অনুভূতি
- যেকোনো কাজে মনোযোগ কমে যাওয়া, শক্তিহীনতা
- খাবারের প্রতি অনীহা বা ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া
- স্লিপ প্যার্টান ওলট-পালট হওয়া
- কাজের গতি হ্রাস বা দিন দিন নিস্তেজ হয়ে পড়া (শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকেই)
- অস্থিরতা বা উদ্বেগ প্রভৃতি।
এখন আমাদের অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এই ডিপ্রেশন বা হতাশার পেছনে কারণ কি আসলে এবং কিভাবে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব?
ডিপ্রেশনের পিছে একক কোনো কারণ দায়ী নয়। অনেকগুলো ফ্যাক্টর হতাশার বিকাশে অবদান রাখতে পারে। সেটা হতে পারে কোন biochemical imbalance, psycological problem, genetic কিংবা কোন environmental factor, যেমনঃ মানসিক চাপ, শোক, পারিবারিক ঝামেলা প্রভৃতি।
বর্তমানে মূলত বিভিন্ন অনিশ্চয়তার ভয়, ঘুমের ব্যাঘাত, অন স্ক্রিন এক্টিভিটি বেড়ে যাওয়া, তরুণদের মধ্যে স্মোকিং হতাশার পেছনে দায়ী। তাছাড়া সোশ্যাল মিডিয়াতে অন্যের চাকচিক্যময় জীবনকে নিজের সাথে তুলনা করে, যেমন- অমুক আমার চেয়ে এতো সুখী, ওর আছে আমার নেই ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমরা অনেকেই বুঝি না সঠিক ডায়েট ফলো না করা, ওলট-পালট লাইফস্টাইল প্যার্টান আমাদেরকে হতাশার দিকে ঠেলে দেয়, যেমন- পর্যাপ্ত খাওয়া-দাওয়া না করা, ইবাদাতে মনোযোগী না হওয়া, নামাজে অনীহা, প্রোডাক্টিভিটির সাথে কোনো কাজ না করা, পর্যাপ্ত এক্সারসাইজ না করা প্রভৃতি।
এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, nutritional imbalance যা আপনার শরীরে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে আপনাকে ডিপ্রেশনে ফেলে দেয়। তবে একক কোনো পুষ্টি উপাদান হতাশার ঝুঁকি বৃদ্ধি বা হ্রাসে সহায়তা করে বলে শনাক্ত করা যায় নি।
মানসিক অবসাদের জন্য দায়ী কে?
আমরা একটি পরামর্শ অহরহ শুনে থাকি যে, শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে হলে আমাদের সঠিক মাত্রায় পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত। কিন্তু মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্যও আমাদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত, এ সম্পর্কে কি আমরা শুনি?
মানসিক সুস্থতার জন্য আমাদেরকে একই সাথে পর্যাপ্ত মাত্রায়ও খেতে হবে। কেননা সঠিক ডায়েট প্ল্যান আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ও স্বাস্থ্যের জন্যও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যা ডিপ্রেশন এবং ডিপ্রেশনের মতো আরো আনেক মানসিক অবস্থা যেমন- PTSD, OCD, anxiety disorder প্রভৃতি থেকে আমাদেরকে দূরে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মুড ভালো রাখার পিছে খাদ্য এবং পুষ্টির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সুরা আন্-নাহলের ১১৪ নং আয়াতে বলেছেন,
“অতএব আল্লাহ তোমাদেরকে যে হালাল উত্তম রিযিক দিয়েছেন, তোমরা তা থেকে আহার কর এবং আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় কর, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদাত করে থাক।”
সুরা আন-নাহল/১১৪ নং আয়াত
পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার আমাদের মেজাজকে উন্নত (alleviate mood) করতে পারে এবং উদ্বিগ্ন মেজাজকেও শান্ত করতে সহায়ক, সুবহানআল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে কত নিয়ামত দিয়েছেন, সুস্বাস্থ্যের জন্য যার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা বান্দা হিসেবে আমাদের সবার দায়িত্ব। কেননা, আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য আল্লাহর তরফ থেকে আমাদের জন্য আমানাহস্বরুপ।
গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, আমরা কি খাচ্ছি সেটা শুধু আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যই নয়, বরং মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতাকেও প্রভাবিত করে, যা এতই শক্তিশালী (গবেষণা) যে সেটা মেডিসিন জগতে নিউট্রিশনাল সাইকিয়েট্রি (nutritional psychiatry) নামক নতুন একটি ফিল্ডের সূচনা ঘটিয়েছে!
ভালো খাওয়া-দাওয়া, যেমন- একটি ভালো ব্যালেন্স ডায়েট যাতে কিনা সব রকম পুষ্টিকর উপাদান যথাযথ পরিমাণে বিদ্যমান, আমাদের সুস্থতার সাথে সংযুক্ত। ২০১৪ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে যে, যারা যথেষ্ট পরিমাণে ফল ও শাকসবজি খায় তাদের মাঝে সুস্থতার হার বেশি। মূলত পর্যাপ্ত শাকসবজি, ফলমূল, এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল, বাদাম ও বাদামজাতীয় খাবার, খাদ্যশস্যসমূহ খাওয়া এবং প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার, রেড মিট প্রভৃতি খাদ্য তালিকায় না রাখা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে।
আমাদের মস্তিষ্ক খুবই সক্রিয় একটি অঙ্গ এবং সঠিকভাবে কর্ম সম্পাদনের জন্য এর পর্যান্ত পরিমাণে এনার্জি, নিউট্রিশন এবং হাইড্রেশন দরকার হয়। যখন কেউ তার খাবার থেকে সঠিক মাত্রায় ভিটামিন, মিনারেলস এবং এনার্জি পায় না সেটা তার দেহ ও মনে প্রভাব ফেলে থাকে।
যাদের দেহে পুষ্টির ঘাটতি রয়েছে তারা মূলত সহজে যে কোনো কিছু চিন্তা করে উঠতে পারে না এবং উদ্বেগ, হতাশা ও স্মৃতিভ্রমের ঝুঁকিতে থাকে। সেজন্য ছোট থেকেই বাচ্চাদেরকে খাবারের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে এবং নতুন নতুন পুষ্টিকর খাবারের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আমাদের থেকেই মূলত বাচ্চারা শিখে থাকে।
বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্বব্যাপি ডায়েটের ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমানে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার থেকে দূরে সরে গিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার, স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা সম্পৃক্ত চর্বি, পরিশোধিত শর্করা (refined sugar) এর দিকে ঝুঁকছে যা বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতা থেকে শুরু করে আমাদের মানসিক অসুস্থতার জন্যও দায়ী।
কেননা, এসকল খাবার থেকে শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সঠিক মাত্রায় ভিটামিন, মিনারেলস, এন্টিঅক্সিডেন্টস, এনার্জি, প্রোটিন, প্রোবায়োটিক্সস প্রভৃতি পাওয়া যায় না। এরই সাথে আমাদের দেহে ফ্রি রেডিকেল নামক এক ধরনের অণু তৈরি হয়, সঠিক ডায়েটের অভাবে যা হতে আমাদের দেহ সহজে রক্ষা পেয়ে উঠে না।
ফ্রি রেডিকেল আমাদের দেহে সেল ড্যামেজ, এইজিং এবং আরো অন্যান্য সমস্যার জন্য দায়ী। গবেষণা হতে দেখা গেছে যে, আমাদের ব্রেইনও ফ্রি রেডিকেল ড্যামেজের ঝুঁকিতে থাকে যা মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। যদিও দেহে ফ্রি রেডিকেল উৎপাদন একদম বন্ধ করা সম্ভব নয় কিন্তু সঠিক খাবারের মাধ্যমে এর ক্ষতিকর প্রভাব হতে আমাদের দেহ ও ব্রেইনকে রক্ষা করা সম্ভব।
পর্যাপ্ত মাত্রায় পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার মাধ্যমে দেহ ও ব্রেইন শুধু ফ্রি রেডিকেল ড্যামেজ থেকে রক্ষাই পায় না, বরং মস্তিষ্কের কাজ সম্পাদন ও বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি চাহিদাও মিলে। ফলে হতাশা এবং হতাশার ন্যায় অন্যান্য মানসিক অবস্থা হতে নিজেদেরকে রক্ষা করাও সম্ভবপর হবে ইন শা আল্লাহ।
এজন্য আমাদেরকে জানতে হবে মানসিক সুস্থতা এবং হতাশা থেকে মুক্তি পেতে কি ধরনের খাবার আমাদের ডায়েটে রাখার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে এবং কোন খাবার বাদ দিতে হবে।
পরের পর্ব দেখুন এখানে।
লেখক: নাশীতা ওয়েলনেস