বার্থ দৌলা বা দৌলা কী?

বার্থ দৌলা সাধারণত “দৌলা ” নামে বেশি পরিচিত। দৌলা সুস্থ গর্ভাবস্থা সম্পর্কে হাতেকলমে প্রশিক্ষিত হন এবং হবু মা-বাবাকে (অথবা প্রসবে সহায়তাকারিকে) সম্ভাব্য প্রসব, সন্তান জন্মদান এবং অভিভাবকত্বের জন্য প্রস্তুত করতে সর্বোচ্চ শারীরিক ও মানসিক তথ্য সহায়তা প্রদান করেন। 

এককথায়,দৌলা একজন প্রশিক্ষিত সাহায্যকারী যিনি প্রসব অবস্থা ও সন্তান জন্মদানের সময় সাপোর্ট দিয়ে থাকেন।

হবু মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ যত্ন নেওয়া এবং মায়ের জন্য একটি স্মরণীয় পজিটিভ বার্থ স্টোরি তৈরী করতে সর্বোচ্চ সহায়তা করা একজন দৌলার প্রাথমিক লক্ষ্যগুলির মধ্যে অন্যতম। এই অভিজ্ঞতা একজন মা’কে সারাজীবন তৃপ্তি প্রদান করবে এবং আত্মবিশ্বাস যোগাবে! 

জরিপে দেখা গেছে, সার্বক্ষণিক দৌলার উপস্থিতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নরমাল ডেলিভারি হওয়ার সম্ভাবনা ১৫% বাড়ায় এবং সিজার হওয়ার সম্ভাবনা ৫২.৯% কমায় এবং পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন না হওয়ার সম্ভাবনা ৫৭.৫% কমায়।

একজন দৌলার কাছ থেকে একজন হবু মা কী সেবা আশা করতে পারেন?

লেবার ও সন্তান প্রসবের আগে: 

একজন দৌলা আপনাকে প্রসবের জন্য প্রস্তুত হতে সহায়তা করে। দৌলা তার কাজের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্যকর গর্ভাবস্থা সম্পর্কে আপনার সাথে কথা বলে, আপনাকে বিভিন্ন ব্যায়াম (গভীর শ্বাস, শিথিলকরণ) করতে উদ্বুদ্ধ করে, এবং থেরাপিউটিক স্পর্শ সহ বিভিন্ন কৌশল অনুশীলনে সহায়তা করে যাতে আপনি প্রসবকালীন নাজুক মুহূর্ত গুলো মোকাবিলা করতে পারেন।

এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মা কতবার দৌলার সাথে দেখা করতে চান তা উভয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে ন্যূনতম ২-৩টি প্রসবপূর্ব মিটিং বা ভার্চুয়াল মিটিং করতে পারলে সাধারণত একটি দুর্দান্ত সূচনা হয়!

একজন হবু মা চাইলে আরো বেশিবার দেখা করতে পারেন এবং সেটা একজন দৌলার ব্যাক্তিগত কাজ ও পারিশ্রমিকের উপর নির্ভর করে। তাছাড়া এখনকার সময়ে ফোন, ইমেইল বা মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমেও তারা যোগাযোগ করতে পারেন।

লেবার ও সন্তান প্রসবের সময়: 

সাধারণত লেবারের সক্রিয় ধাপে (Active phase) হবু মায়ের সাথে দৌলা সশরীরে বা ফোনের মাধ্যমে যুক্ত হন এবং পুরো প্রসবে তাকে শারীরিক এবং মানসিক সমর্থনের মাধ্যমে উজ্জীবিত রাখেন। প্রসবের বিভিন্ন পর্যায়ে যখন নানারকম সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন পড়ে, দৌলা তখন বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়ে হবু মা-বাবাকে সহায়তা করেন। 

এছাড়াও প্রসবের আগের সেশনগুলোতে শেখানো কৌশলগুলো প্রয়োগের কথা মা’কে মনে করিয়ে দেন, যাতে তিনি সহজেই প্রসববেদনার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এসময় দৌলা আগে শেখানো বিভিন্ন ব্যায়াম করতে সহায়তা করেন।

লেবারের অগ্রগতির সাথে সাথে এসব সাপোর্ট হবু মাকে মানসিকভাবে আত্মবিশ্বাসী করে। তিনি সহজেই ব্যাথা মোকাবেলা করতে পারেন এবং উভয়ের সম্মিলিত চেষ্টায় দারুণ প্রসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

সন্তান প্রসবের পর: 

সাধারণত নবজাতক জন্মের পরে দৌলা অল্প সময়ের জন্য থাকেন । প্রসবোত্তর মিটিংয়ের জন্য বাড়িতে বা হাসপাতালে দৌলা তার সেবাগ্রহীতার সাথে দেখা করতে পারেন। এসময় তিনি নতুন শিশুর সাথে মায়ের সুস্থ আন্তরিক বন্ধন তৈরি করা ,নবজাতকের বিভিন্ন যত্ন এবং প্রসব পরবর্তী মায়ের শারীরিক ফিটনেস ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বিভিন্ন উপদেশ ও টিপস দিয়ে থাকেন। তাছাড়া একজন মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নন -মেডিক্যাল প্রশ্নের উত্তর দেন।

একজন দৌলা কী কী দায়িত্ব পালন করেন:

একজন দৌলা মূলত তথ্যভিত্তিক পরামর্শ এবং শারীরিক ও মানসিক সহায়তা দিয়ে থাকেন। এসব সহায়তার মৌলিক লক্ষ্য হলো প্রসবিনী মা ও তার স্বামী/অভিভাবক যেন আত্মবিশ্বাসের সাথে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

দৌলার শারীরিক সহায়তার এর মধ্যে যা যা থাকে:

শারীরিক সহায়তা হবু মাকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ, স্বাচ্ছন্দ্য এবং আত্মবিশ্বাসের অনুভূতি বজায় রাখতে সহায়তা করে। 

১. বিভিন্ন ধরণের রিলাক্সেশন ম্যাসেজ করা যার মাধ্যমে হবু মা প্রশান্তি অনুভব করবেন।

২. লেবারের জন্য একটি শান্ত পরিবেশ তৈরি করতে সাপোর্ট পার্সনকে সাহায্য করা, যেমন ঘরের আলো ম্লান করা,পর্দা সাজানো, মায়ের চাহিদা মতো পরিবেশ তৈরি করতে পরামর্শ দেয়া ও সাহায্য করা। 

৩. হবু মাকে ওয়াটার থেরাপিতে সহায়তা করা। 

দৌলার মানসিক সহায়তা বা ইমোশনাল সাপোর্ট এর মধ্যে যা যা থাকে:

দৌলার প্রাথমিক লক্ষ্যগুলির মধ্যে একটি হল হবু মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ যত্ন নেওয়া এবং মায়ের জন্য একটি স্মরণীয় বার্থ স্টোরি তৈরী করতে সর্বোচ্চ সহায়তা করা। 

১. হবু মাকে সাহস, উৎসাহ প্রদান করা. তার ধৈর্য্য ও প্রচেষ্টার জন্য তাকে প্রশংসা করা। 

২. হবু মাকে নিজের ও অনুসাঙ্গিক পরিস্থিতি আরও ইতিবাচকভাবে দেখতে সাহায্য করা, অনুপ্রাণিত করা। 

৩. সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস ও ভরসা রাখতে অনুপ্রাণিত করা। 

৪. প্রসবের সময় হবু মা যেটা করতে চায়, সেটা করতে দিতে তাকে সহায়তা করা। 

৫. হবু মা এবং তার সাপোর্ট পার্সনকে যেকোনো অবস্থায় ভয় এবং দ্বিধা থেকে মুক্ত থাকতে সহায়তা করা।  

৬. বাচ্চা জন্মের পর সহানুভূতির সাথে মায়ের সব কথা শোনা এবং মা যদি চান তাহলে সেটা গোপন রাখা অথবা পরিবার বা সাপোর্ট পারসন এর সাথে কথা বলে মায়ের সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করা। 

৭. এবং সর্বোপরি, নাজুক সময়ে শেয়ার করা মায়ের কথা, অনুভূতির গোপনীয়তা নিশ্চিত করা।

দৌলার তথ্যগত সহায়তা বা  ইনফরমেশনাল সাপোর্ট এর মধ্যে যা যা থাকে:

১. হবু মা এবং তার সাপোর্ট পারসনকে লেবার ও ডেলিভারির সময়ে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য তথ্যের মাধ্যমে গাইড করা.

২.লেবারের সময় বিভিন্ন টেকনিক (যেমন ডিপ ব্রিথিং, মুভমেন্টস, রিলাক্সেশন টেকনিক , আরামদায়ক পজিশন) ইত্যাদি করতে পরামর্শ দেয়া।  

৩. হাসব্যান্ড বা সাপোর্ট পার্সনকে হবু মায়ের শারীরিক ও মানসিক কষ্ট এবং লেবারের বিভিন্ন ধাপে কী হচ্ছে  সেটা বুঝতে সহায়তা করা। 

৪. গর্ভাবস্থা এবং প্রসবের নির্ভরযোগ্য তথ্য খুঁজে পেতে তাদের সহায়তা করা যাতে করে তারা নিজেরা সঠিক সিদ্বান্ত নিতে পারেন।

একজন দৌলা যেসব দায়িত্ব পালন করেন না:

একজন দৌলা কোনো ধরণের ডাক্তারি সেবা দেন না এবং চিকিৎসা কার্যক্রম (medical procedure) চালান না। দৌলা তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে কিন্তু সিদ্ধান্ত দেন না। এমনকি কোন সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিতও করেন না। যেকোন সিদ্ধান্ত গর্ভবতী মা ও তার স্বামী/অভিভাবক নিবেন।

ক্লায়েন্টের গোপনীয়তার স্বার্থে দৌলা সুস্পষ্ট অনুমতি ছাড়া প্রসব সম্পর্কে কারো সাথে কোনো প্রকার কথা বলেন না। এছাড়া, দৌলা নবজাতকের শারীরিক যত্নের জন্যও দায়িত্বপ্রাপ্ত নন।

ভার্চুয়াল দৌলা সাপোর্ট কী:

বিভিন্ন কারণে স্বশরীরে দৌলার সেবা পাওয়া নাও যেতে পারেন। বাসায় প্রসবের ক্ষেত্রে এলাকায় দৌলা সেবাদাতা না থাকলে বা দৌলার শিডিউল খালি নাও থাকতে পারে। এছাড়া নিজ ভাষাভাষী দৌলা পাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালে প্রসবের ক্ষেত্রে অনেক সময় দৌলাকে হবু মায়ের সঙ্গী হতে নিষেধ করা হতে পারে। এধরনের নানা কারণে ভার্চুয়াল দৌলা সেবা জনপ্রিয় হচ্ছে। 

দৌলা সার্ভিস এবং ভার্চুয়ালি দৌলা সার্ভিস এর মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো ফিজিক্যাল সাপোর্ট বা শারীরিক সহায়তা। এটা বাদে তথ্যগত সেবা ও মানসিক বা ইমোশনাল সাপোর্টে কোন ঘাটতি হয়না।

শেষ কথা

একজন মায়ের কাছে সন্তান জন্মদানের অভিজ্ঞতা বা বার্থ স্টোরির দুইটি দিক আছে। একদিকে প্রসবের তিক্ত অভিজ্ঞতা মা ভুলতে চাইলেও পারেন না, আবার এসময়ের সুন্দর অভিজ্ঞতা অন্য মা বা হবু মা’র সাথে আগ্রহের সাথে শেয়ার করেন। প্রসব একজন মায়ের খুবই নিজস্ব স্মৃতি (Intimate experience) এবং এটা তিনি বহুদিন ধরে ধারণ করেন। এই স্মৃতিকে সুখস্মৃতিতে পরিণত করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে “বার্থ দৌলা” বা “দৌলা” সার্ভিসটির প্রচলন অনেক আগে থেকে হলেও বাংলাদেশের জন্য এই পেশাটি একদমই নতুন।

আশার কথা হলো এই প্রজন্মের হবু বাবাদের কাছে মায়ের জন্য সন্তান প্রসবকে সহজ ও স্মরণীয় করার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।  খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের মায়েরা তার গর্ভকালীন সময়ে দৌলা সেবা নিতে পারবেন এবং নিজের আত্মতৃপ্তির জন্য একটি দুর্দান্ত পজিটিভ বার্থ স্টোরি তৈরী করতে পারবেন। দৌলা সেবা পাওয়া এখনকার সময়ে প্রত্যেক মায়ের অধিকার!

লেখকঃ সাবেকুন নাহার 
ট্রেইনী চাইল্ড বার্থ এডুকেটর এবং দৌলা, আমানি বার্থ

তথ্যসূত্র

  • Rebeca Dekkar. Evidence based doula
  • Falcony, April M., Bromfield, Samantha G., et al. Doula care across the maternity care continuum  and impact on maternal health: evaluation of doula program across three states using propensity score matching. https://www.thelancet.com/
লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা