আগের লেখায় শিশুর আবেগ ও বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া নিয়ে লিখেছিলাম। বলছিলাম শিশুর আবেগকে বাবা মা হিসেবে আমাদের গাইড করতে হবে, তাকে সাহায্য করতে হবে সে যা অনুভব করছে সেটা বুঝায়। শিশুর সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় আবেগ যেমন কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখে, তেমনি তার পড়াশুনার অভ্যাসেও “কৌতুহল” নামের আবেগের ভূমিকা রয়েছে। শিশুর পাঠের অভ্যাস গঠনে আরো বেশ কিছু বিষয় জড়িত।

আবেগের প্রয়োজনীয়তা

কথিত আছে শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। মেরুদন্ড যেমন পিঠকে সোজা রাখে, শিক্ষা তেমন মানসিকতা ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখে; আত্মপরিচয় দান করে, চিন্তা করার দক্ষতা তৈরী করে। এখানে আবেগ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা কেননা নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ মানুষের চিন্তাক্ষমতা কেড়ে নেয়। আর পড়াশুনায় স্বতঃস্ফূর্ত হওয়ার জন্য চিন্তাদক্ষতার কোন বিকল্প নেই।

তো যদি শিশুদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে না থাকে তাহলে তারা শিখলেও শিক্ষা দ্বারা উপকৃত হতে পারবেনা। ভয়, আশা, লোভের মাঝে তাদের জীবন আবর্তিত হবে। যা তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন তো বটেই, প্রভাবিত করবে তাদের আধ্যাত্মিক জীবনকেও। ঈমান ও আমল সংক্রান্ত বিষয়ে সে হয়ে পড়বে উদাসীন। সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল হিসেবে এটা বাবা-মায়ের ইহ ও পরকালের জন্য ক্ষতিকর।

পড়ানোর আগে তাই তাদেরকে আবেগিক ভারসাম্যে রাখতে হবে। যেহেতু পড়ার ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি কৌতুহলের আবেগটা কাজ করে তাই আবেগিক দিকে কৌতুহলটাকে ধরে রাখতে শেখানোটাই প্রথম পদক্ষেপ। আর বাবা-মায়ের নিজেদের আবেগ ভারসাম্যে থাকলেই সন্তান অনুরূপ ভারসাম্য শিখবে- এক্ষেত্রে বলতে হয়, পরিবেশই সবথেকে বড় শিক্ষক। যদি এমনটাই হয়, তাদের আবেগের চাহিদাটি গুরুত্ব পায়, তাহলে পড়াশুনার ক্ষেত্রে তাদেরকে অতিরিক্ত শাসন করে, বকে, মেরে ধরে পড়তে বসালে তারা যে আদৌ পড়াশুনায় উৎসাহী হবেনা সেটা বলাই যায়।

আবার পড়াশুনার প্রতি আবেগকে না গড়ে শুধু ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে গেলেও তারা পড়াশুনায় বিশেষ উপকৃত হবেনা। একটা উড়নচণ্ডী, স্বাধীনচেতা শিশুকে ধরেই একঘেয়ে পড়াশুনায় বেঁধে ফেলা যায়না। আসলে, পড়াশুনাকে যারা ধরতে পারে তারা কখনোই জৈবিকভাবেই পড়াশুনায় উৎসাহী হয় না। কোন না কোন মাধ্যমে তারা পড়াশুনার ইতিবাচক দিকের সাথে পরিচিত হয়। শিশুকে নিজের সাথে রেখে নিজে বেশি বেশি বই পড়ে বইয়ের ব্যাপারে বেশি বেশি আলোচনা করলে তারা কৌতুহলী হয়ে উঠবে। কৌতুহলের এই আবেগটা তাদের মাঝে জাগাতে পারলে বইয়ের যাত্রায় এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যাবে।

বইয়ের প্রতি আকর্ষণ স্বভাবজাত

মানুষ স্বভাবগতভাবেই বইকে ভালোবাসে। একাডেমির তাত্তিক পড়াশুনা যাদের ভালো লাগেনা, তারাও দেখা যায় গল্পের বই পেলে গোগ্রাসে গিলে। এসব বই থেকে তাদের সময় নষ্ট হওয়া ছাড়া কোন ফায়দা হয়না। বোধ করি সেজন্যই শার্লট ম্যাসন এসবকে ‘ট্র‌্যাশি নভেলস’ বলেছেন। প্রশ্ন থেকে যায়, স্বভাব যদি পড়াশুনাকে প্রবৃত্ত করে, তাহলে একাডেমির পড়াশুনা কেন ভালো লাগেনা? এখানে কয়েক রকমের কারণ থাকতে পারে; বাবামায়ের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করার স্বভাব সন্তানকে চিন্তা করার ব্যাপারে উদাসীন করে দেয়, পড়াশুনার সাথে কিছু ভীতিকর অভিজ্ঞতা যুক্ত হয় (মেরে ধরে পড়তে বসালে শিশু যদি শাসনে অপ্রস্তুত থাকে তাহলে ট্রমাটিক রেস্পন্স করে, প্যানিকড হয়ে যায়), শেখার প্রক্রিয়াটা তার কাছে চমকপ্রদ না লাগলে।

বইয়ের সাথে যুক্তকরণ

উপরে বর্ণিত কারণগুলোর মধ্যে প্রথম দুটি এড়ানোর উপায় প্রথমেই বলেছি, নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা, যা একটা দীর্ঘ অনুশীলন আর উত্তম সোহবাতের উপর নির্ভর করে- যা আমার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। কিন্তু তৃতীয় দিকটি সম্পর্কে আমি কিছু দিকনির্দেশনা তুলে ধরতে পারি, যা আপনাদের উপকারে আসতে পারে। ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ।

বইকে জীবিত করার প্রক্রিয়া

১) ঘুমানোর আগে গল্প পড়ে শুনাবেন; অবশ্যই বই থেকে। কঠিন শব্দ সে বুঝবেনা এমনটা ভাববেন না। একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলবেন- গল্পের চরিত্রের অবস্থানুযায়ী কণ্ঠ পরিবর্তন করবেন।

২) গল্পের চরিত্র ও কাহিনীর সাথে তাদের জীবনকে মেলানোর চেষ্টা করবেন; দিনেই তাদের করা কোন কাজের সাথে মিল রেখে গল্পটা নির্বাচন করবেন। তবে যদি ওরা নির্বাচন করতে চায় তবে করতে দিবেন। 

৩) ছবিওয়ালা বইগুলো দিয়ে শুরু করবেন। শিশুর ৩-৩.৫ বছর বয়সেই ছবিওয়ালা বইগুলোর সাথে পরিচিত করাবেন। এর মধ্যে ছবিওয়ালা গল্পের বইয়ের চেয়ে ছবিওয়ালা তথ্যের বইগুলো বেশি পড়াবেন। যেমন, ওয়ার্ডবুক। ৮ বছরের আগে গল্পের সাথে সম্পর্ক শুধু বেডটাইম পড়ার মাঝেই সীমতি রাখলে ভালো।

৪) বইয়ের মধ্য হতে যেসব জিনিস ওরা জানে সেই জিনিসগুলো বেশি বেশি দেখাবেন। যেমন, ওয়ার্ডবুকগুলো পড়ানোর সময়ে যে সবজিগুলো ওরা চিনে সেগুলো আগে পড়ালেন। ওয়ার্ডবুক এবং সাধারণজ্ঞানের বিষয়গুলো তাদেরক হাঁটাচলার মাধ্যমেই শিখিয়ে নিতে পারবেন। এতে আরও অগ্রগতির জন্য পড়ে আসতে পারেন “শিশুদের হাতেখড়ি-কিছু টিপস” লেখাটি।

৫) ওরা বইয়ে যা পড়বে দিনের সকল কাজে সেগুলোর উদাহরণ ও শিক্ষাটা প্রতিফলিত করতে থাকবেন। এতে হাতে-কলমে, বইয়ের অক্ষরে পড়াশুনা সীমিত না থেকে তাদের জীবন ও কল্পনাজগতকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে।   

৬) পড়ানোর সময়ে উদাহরণ বেশি দিবেন। আপনি যদি বর্ণ ও কার শেখাতে চান, তাহলে তারা রোজ যা বলে সেসবকে উদাহরণ হিসেবে টানুন। যেমন, ক শেখানোর পর তাদেরকে কাক এর উদাহরণ দিলেন, খ শেখানোর পর খাবারের। নিজে দুয়েকটা উদাহরণ দেয়ার পর বাচ্চার ব্রেইনকে দিয়ে কাজ করাবেন। বলবেন, ক দিয়ে কাক হয়, আর কী কী হয় বলোতো?

৭)) যখন কার শেখাবেন, তখন আগে কার এর ব্যবহার বুঝাবেন। আ কার বসে যেকোন শব্দকে আ এর উচ্চারণ দেয়। ক এর পাশে বসে তৈরী করে কা, খ এর পাশে বসে তৈরী হয় খা ইত্যাদি। চেষ্টা করবেন যেন বাচ্চার ব্রেইনটা বেশি কাজ করে। উদাহরণ শিখিয়ে দেয়ার পর বইয়ে কার চর্চা করার যে পৃষ্ঠা আছে তা পড়তে দিবেন। আটকে গেলে একটু সুযোগ দিয়ে নিজে বলে দিবেন। 

বইটা যখন তার কাছে জীবিত লাগবে তখন সে নিজেই বেশি বেশি পড়তে চাইবে। 

তথ্যসূত্র