গর্ভাবস্থায় যেহেতু শরীর ভারী হতে থাকে, পেট উঁচু হয়ে যায়, ওজন ও গরম লাগা বেড়ে যায়, ঘুমাতেও তখন অস্বস্তি হয়। কিভাবে শুয়ে আরাম পাবেন সেটাও মাঝে মাঝে মায়ের বুঝে আসে না। আরামের পাশাপাশি শোয়ার ধরনের উপর বাচ্চার সুস্থতাও কিছুটা নির্ভর করে। তাই গর্ভাবস্থায় সঠিক পজিশনে শোয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম ট্রাইমেস্টার
প্রথম ট্রাইমেস্টার বা গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে পেটের মাঝে তেমন কোন পরিবর্তন বোঝা যায়না, বাচ্চাও তেমন বড় হয়না। তাই এই সময় গর্ভবতী মা যেভাবে সুবিধা সেভাবে শুতে পারেন।
দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার
এই সময় থেকে অর্থাৎ গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাস থেকেই গর্ভবতী মায়ের পেট বড় হতে থাকে, গর্ভের শিশুও বাড়তে থাকে। তাই এই সময় শরীর ভারী হয়। ডাক্তারদের মতে এই সময় থেকেই চিত হয়ে বা উপুড় হয়ে পেটে ভর দিয়ে শোয়া উচিত নয়। বরং কাত হয়ে শোয়া মা ও শিশুর জন্য ভালো। বিশেষ করে বাম কাতে শোয়ার পরামর্শ দেয়া হয় কেননা এতে প্লাসেন্ট্রায় অক্সিজেন সরবরাহ সহজ হয় যা বাচ্চার বৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য ডান কাতেও শোয়া যায়, তবে বাম কাতে শোয়া উত্তম।
তাছাড়া পেটের নীচে একটি কাঁথা বা নরম বালিশ দেয়া যায়, সেই সাথে দুই পায়ের মাঝেও একটি নরম বালিশ রেখে শুলে মায়ের আরাম লাগবে।
তৃতীয় ট্রাইমেস্টার
এই শেষ তিন মাস গর্ভবতী মায়ের জন্য খুবই নাজুক। শরীর বেশ ভারী হয় যেহেতু ওজন বেড়ে যায়, পেটের আকার বড় হয়, গর্ভের বচ্চার বৃদ্ধিও বেশ বাড়ে। এসময় শোয়ার ভঙ্গিতেও পরিবর্তন আসে।
এসময় উপুড় হয়ে শোয়া অনেকটাই অসম্ভব, তাও যদি কোন কারণে কী শুতে চান তমে সেটা একদম নিষেধ।
এসময় খুব খেয়াল রাখতে হবে যেন মা চিত হয়ে না ঘুমান। বেশীরভাগ গর্ভবতী এ সময় চিত হতেই পারেন না, নিঃশ্বাস নিতে পারেন না চিত হলে, তাই স্বাভাবিকভাবেই চিত হয়ে ঘুমান না। কিন্তু অনেকেই হয়তো চিত হয়ে ঘুমানোর অভ্যাস চালিয়ে যান।
গবেষণা বলছে, গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চিত হয়ে ঘুমানোর ফলে মৃত শিশুর (Still birth) জন্ম হতে পারে। বাচ্চার বৃদ্ধিতেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
এর কারণ হচ্ছে, মায়ের জরায়ুর মাঝে প্লাসেন্ট্রার ভেতরে শিশু অবস্থান করে। আর জরায়ুর পেছনেই থাকে সবচে বড় রক্তনালী। এবার ভাবুন, মা যখন চিত হয়ে শুবেন তখন এই রক্তনালীর উপরে সম্পূর্ণ জরায়ুর ওজন পড়ে, আর নীচের দিকে থাকে মায়ের শ্রোণীদেশের হাড়। তার মানে মাঝখানে রক্তনালীটি একদম চাপে পড়ে যায় যে কারণে রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
এরকম হলে প্লাসেন্ট্রায় ঠিকভাবে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌছতে পারেনা। এটি বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর তো বটেই।
তাই সবচে ভালো হয় কাত হয়ে, বিশেষত বাম কাত হয়ে ঘুমালে। কেননা বাম কাতে শুলে রক্তনালীর উপর চাপ পড়ে না । ডান, বাম কাত মিলিয়ে শুতেও সমস্যা নেই।
সার সংক্ষেপ
- যখন থেকে পেট ভারী হতে থাকবে, মুটামুটি দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার থেকেই চিত হয়ে বা পেটে চাপ দিয়ে ঘুমানো বাদ দিতে হবে।
- শেষের তিন মাস বা শেষ ট্রাইমেস্টার অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন পেটের উপর ভর দিয়ে উপুড় হয়ে বা চিত হয়ে ঘুমানো না হয়।
- এক কাতে ঘুমাতে অসুবিধা লাগলে খুব অল্প সময়ের জন্য অন্য পাশে বা চিত হয়ে থাকা যেতে পারে।
- ঘুমের মাঝে নানান দিকে পাশ ফেরা হতে পারে, সেটি নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
- পেটের নিচে ও পায়ের মাঝে বালিশ/ কাঁথা দিয়ে সাপোর্ট দিলে বেশ ভালো আরাম পাওয়া যাবে।
- বাম কাতে শোয়া সর্বোত্তম তবে ডান কাতে শোয়াও নিষেধ নয়। তবে যেহেতু বাম কাতে শোবার বেশ কিছু উপকারিতা আছে তাই বাম কাতে শোয়ার অভ্যাস করাই ভালো। মাঝে মাঝে ডান কাতেও শোয়া যায়।
শেষ কথা
গর্ভাবস্থায় ছোট ছোট অভ্যাসগুলোও অনেক গুরুত্ব বহন করে। তাই যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে না শুয়ে গবেষনালব্ধ পদ্ধতি অনুসরণ করাই উত্তম। যেহেতু বাম কাতে শোয়ার ব্যাপারে জোরালো গবেষণা রয়েছে, সেহেতু এভাবে অভ্যাস করতে পারলে মা ও বাচ্চার জন্য ভালো।
অনেকেই ভাবেন বাম কাত ছাড়া বুঝি শোয়াই যাবে না, তবে এটি ঠিক নয়।
বাম কাতে শোয়া উত্তম, ডান কাতে শোয়ায়াও খুব ক্ষতিকর নয়। তবে যেহেতু বাম কাতে শোবার উপকারিতা আছে তাই এটিই সাধারণত পরামর্শ দেয়া হয়। গর্ভবতী মা চাইলে বাম কাতে বেশীরভাগ সময় শুতে পারেন ও এর মাঝে ব্রেক নেবার জন্য ডান কাতে শোয়ার অপশন তো রয়েছেই। চাইলে খুব সামান্য সময়ের জন্য চিত হয়ে শুয়ে একটু ভঙ্গি পরিবর্তন করা যায়।
অনেক মা-ই হয়তো বলবেন যে তিনি চিত হয়ে ঘুমাতেন তেমন অসুবিধা হয়নি, আসলে অসুবিধা হবেই কিংবা বাচ্চার ক্ষতি হবেই এমনটা বলা হয়না। তবে বাচ্চার ক্ষতির আশংকা আছে- এটি প্রমাণিত বলেই সচেতন থাকতে পরামর্শ দেয়া হয়।
তাই আপনার গর্ভকালীন সময়ে ঘুমানোর আরামদায়ক ভঙ্গি বেছে নিন, সেই সাথে গর্ভের বাচ্চার সুস্থতার দিকেও খেয়াল রাখুন।
তথ্যসূত্র
- গর্ভাবস্থায় শোয়ার সঠিক ধরণ কোনটি
- Tiredness and sleep problems in pregnancy
- Pregnancy sleep positions
কৃতজ্ঞতা: মাতৃত্ব আমানি দৌলা ট্রেইনিং প্রোগ্রামের প্রশিক্ষণার্থী নাসরীন সুলতানা এই লেখায় অবদান রেখেছেন।