
গর্ভধারণের মোট সময়কাল ৪০ সপ্তাহের। এই সময়ের বিভিন্ন পরিবর্তনকে নির্দেশ করতে মাসের বদলে সপ্তাহ হিসেব করা হয়। আবার মাস হিসেবে প্রতি তিন মাসকে এক “ট্রাইমেস্টার” ধরে মোট গর্ভকালকে তিনটি ট্রাইমেস্টারে ভাগ করা হয়। সেই হিসেবে আপনার প্রথম তিন মাস শেষ, মানে প্রথম ট্রাইমেস্টার শেষ, আপনি এখন আছেন দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারের একদম শুরুর দিকে। আপনাকে অভিনন্দন!
বিষয়সূচী
চৌদ্দতম সপ্তাহে আপনার শারীরিক পরিবর্তনঃ
এই সপ্তাহে ধীরে ধীরে আপনার শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন, কিছু কষ্টকর অসুবিধার উন্নতি ও নতুন কিছু প্রেগ্ন্যান্সি লক্ষণ দেখতে পাবেন। যেমন-
পেটের আকার বৃদ্ধি
গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে আপনার যতই খারাপ লাগুক না কেন, শারীরিক গঠনে তেমন কোন পরিবর্তন আসে নি। তবে এখন চৌদ্দতম সপ্তাহের দিকে এসে আপনার পেট কিছুটা উঁচু বা মোটা হবে যা দেখে আপনাকে গর্ভবতী মনে হবে। নতুন এই পরিবর্তনে অনেকেই লজ্জা পান, বিশেষ করে প্রথম মা হচ্ছেন যারা। আনন্দমাখা লজ্জা দোষের কিছু নয় তবে নিজের আরামের দিকে খেয়াল রাখবেন।
প্লাসেন্ট্রা বা গর্ভফুলের গঠন
আপনার শরীরে এখন একটি বাড়তি অঙ্গ তৈরি হয়েছে। প্লাসেন্ট্রা(Placentra) বা গর্ভফুল নামে এই অঙ্গটির গঠন প্রথম তিন মাসেই সম্পূর্ণ হয়েছে। চ্যাপ্টা আকৃতির ও রক্ত দিয়ে পূর্ণ প্লাসেন্ট্রার ভেতরে আপনার ছোট্ট শিশু সুরক্ষিত থাকে, এর মাধ্যমেই শিশুর কাছে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও অক্সিজেন পৌঁছায়, আর মলমূত্র, কার্বন ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয় জিনিস বের হয়ে যায়। গর্ভফুলটি আপনার জরায়ুর সাথে শক্তভাবে আটকে থাকে এবং অ্যাম্বিলিকাল কর্ড বা নাড়ীর মাধ্যমে গর্ভের শিশুর সাথে সংযুক্ত থাকে। প্লাসেন্ট্রার গঠন শেষ হবার পর আপনি আগের চেয়ে কম ক্লান্ত অনুভব করবেন।
ক্ষুধা বৃদ্ধি পাবে
এই সময়ে এসে আপনার ক্ষুধা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাবে। এসময়য় অনেকেই আপনাকে বেশি বেশি খেতে পরামর্শ দেবে, কেউ বা বলবে কম খেতে, যেন বাচ্চা বেশি বড় না হয়ে যায়। অথচ দুইটি পরামর্শই ভুল। এসময় আপনাকে খেতে হবে পরিমিত।
এখনো আপনার শিশুর বাড়তি ক্যালরির প্রয়োজন শুরু হয়নি, তাই নিয়মিত খাবারের চেয়ে খুব বেশি খাবার আপনার দরকার নেই।
ডাক্তারদের মতে ১৪তম সপ্তাহ থেকে আপনার প্রতিদিন গড়ে ১ পাউন্ড করে ওজন বাড়বে ও আপনার প্রতিদিন ৩০০ ক্যালরি বাড়তি খাবার খেতে হবে- যদি আপনার BMI (Body mass index) স্বাভাবিক হয়ে থাকে।
আর যদি আপনার যমজ শিশু হয়, যা আপনি আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করে জানতে পারবেন, তবে দৈনিক আপনাকে ৬৮০ ক্যালরি বাড়তি খাবার খেতে হবে। এসময়য় খেয়াল রাখবেন, ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত আপনার ওজন যেন এক সন্তান গর্ভধারণ করা মায়ের মতই বাড়ে।
তবে আপনার যদি কোন শারীরিক অসুবিধা থাকে বা ওজন খুব কম বা বেশি হয় তবে ডাক্তার আপনাকে অন্যরকম ওজন গাইডলাইন দেবেন।
কলোস্ট্রাম (Colostrum) নিঃসরণ
আপনার স্তনের সংবেদনশীলতা এখন বেশ কিছুটা কমে আসবে, তবে নিপলে মাঝে মাঝে হালকা হলুদাভ তরল দেখতে পারেন। এটি হচ্ছে শাল দুধ বা কলোস্ট্রাম-যা আপনার শিশুর প্রথম খাবার। আপনার শরীরে এটি এখন থেকেই তৈরি হতে থাকবে।
লিগামেন্ট পেইন
আপনার বারন্ত শিশুর জন্য জায়গা করে দিতে আপনার পেশী ও লিগামেন্টগুলো প্রসারিত হচ্ছে, যার ফলে আপনার তলপেটে হালকা টান ও ব্যাথা অনুভব করতে পারেন।
এই পরিবর্তনগুলো ছাড়াও আরও ছোট বড় নানান পরিবর্তন দেখতে পারবেন। মাথা ব্যাথা, মাড়ির অসুবিধা, গরম লাগা, গায়ে কালচে দাগ/ আবরন পরা, পা ব্যাথা ইত্যাদি নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আবার, যদিও বেশীরভাগ মায়েদের এই সময়ে এসে শারীরিক দুর্বলতা, বমিভাব, গন্ধ ইত্যাদি কমে যায় , তবে সবার ক্ষেত্রে তা একই সময়ে না-ও হতে পারে। অনেকেই এখনো দুর্বল থাকেন। তাই যেই অবস্থায়ই থাকুন না কেন, সেটির সমাধান কিভাবে হতে পারে তা বের করতে চেষ্টা করুন ও নিজের যত্ন নিন।
এই সময়ে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি
আপনার শরীরের পাশাপাশি আপনার গর্ভের শিশুরও বৃদ্ধি হচ্ছে।
প্রথম তিন মাসে শিশুর সব অঙ্গ গঠন সম্পন্ন হয়েছে, এখন সেসব ধীরে ধীরে পরিপক্ক হতে থাকবে। চৌদ্দতম সপ্তাহে আপনার শিশুটি দেখতে ছোট্ট একটি কিউই ফলের সমান হবে! লম্বায় প্রায় সাড়ে তিন ইঞ্চি ও ওজন প্রায় দেড় আউন্স! ভাবতেই অবাক লাগছে, তাইনা!
আরও অবাক করা বিষয় হচ্ছে, আপনার বাবু এই সময়ে এসে প্রথমবারের মতন প্রস্রাব করবে! শিশু প্লাসেন্ট্রার ভেতরে যে পানির ভেতরে থাকে, সেটিকে বলা হয় এম্নিওটিক ফ্লুয়িড( Amniotic fluid) , শিশুটি এই ফ্লুইড কিছুটা খেয়ে ফেলবে, সেটি তার পাকস্থলিতে চলে যাবে এবং কিডনি থেকে প্রস্রাব হয়ে বের হয়ে আসবে!
এদিকে আবার বাবুটির মাথায় অল্প কিছু চুলও গজাবে, গঠিত হতে থাকবে তার ভ্রু!
আপনার শিশুটি ছেলে না মেয়ে তা নির্ধারিত হয়ে সেই মোতাবেক তার অঙ্গ গঠিত হবে। যদি সে ছেলে হয় তবে তার প্রস্টেট গঠিত হয়ে গেছে, আর মেয়ে হলে তার ডিম্বাশয় পেলভিসে নেমে আসবে।
আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে, এই সময়ে বাবুর অন্ত্র মোকানিয়াম তৈরি করছে যা জন্মের পর বাবুর প্রথম পটি ( কালো রঙের) হিসেবে বের হবে।
এখনো আপনার শিশু খুব বেশি শক্ত নড়াচড়া করেনা যা আপনি অনুভব করতে পারেন, তবে একেক জন মায়ের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ভেদে আপনি কিছুটা নাড়াচাড়া বুঝতেও পারেন! যদি সত্যিই বুঝতে পারেন তবে আপাকে আবারও অভিনন্দন!
আপনার জন্য পরামর্শ
১।যেহেতু আপনার শারীরিক গঠন পরিবর্তন হয়েছে, তাই কিছু ম্যাটারনিটি ওয়্যার কিনে ফেলতে পারেন।
২। ঘুমানোর সময় চিত হয়ে না ঘুমিয়ে চেষ্টা করবেন বাম কাতে ঘুমাতে। গর্ভাবস্থায় কোন কাতে ঘুমানো উচিত ও নিরাপদ এটা নিয়ে লেখাটা পড়ে ফেলুন।
৩। একটি নিরাপদ ও উপভোগ্য গর্ভাবস্থা ও প্রসবের জন্য দরকারি তথ্যপূর্ণ প্রি-নাটাল ক্লাস করে ফেলুন। বিস্তারিত পাবেন এইখানে-
৪। যেহেতু আপনার শরীর এখন কিছুটা ভালো লাগার কথা, তাই আস্তে আস্তে ব্যায়াম শুরু করুন, পেলভিক ফ্লোর ব্যায়ামগুলো আপনার জন্য বেশ কার্যকরী হবে।
৫। চেষ্টা করবেন ফরজ আমল কন্টিনিউ করতে , পাশাপাশি নফল ইবাদাত যেটুকু পারেন সেটুকু করুন।
৬। খাবার দাবারে মনোযোগী হন।
৭। এই সময়ে সাধারণত বিশেষ কোন আল্ট্রা করার দরকার হয়না, যদিনা ডাক্তারের পরামর্শ থাকে, তাই বাচ্চার লিঙ্গ জানার জন্য আল্ট্রা করাবেন না, কেননা এখনো সেটি বুঝাই যাবেনা।
গর্ভাবস্থার এই সময়কে বলা হয় হানিমুন পিরিওড (Honeymoon period), কারণ এসময় গর্ভবতীর তেমন শারীরিক অসুবিধা থাকে না তাই সময়গুলোকে উপভোগ করুন, গর্ভধারণ ও মাতৃত্ব নিয়ে পড়াশোনা করুন, স্বামীর সাথে সুন্দর দাম্পত্য তৈরিতে মনোযোগ দিন।
আপনার সমমনা মায়েদের কমিউনিটিতে যোগ দিতে মাতৃত্ব ফেসবুক গ্রুপে জয়েন হতে পারেন আর এখান থেকে অন্যান্য মায়েদের প্রসব অভিজ্ঞতাগুলো পড়ে নিতে পারেন।
ছবি কৃতজ্ঞতা: Mother & Baby
