অনেক বাবা-মায়েরা অভিযোগ করেন বাচ্চা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে, ঠিক সময়ে ঘুমায় না। যেহেতু দেরী করে ঘুমায়, ঘুম থেকে উঠেও অনেক দেরীতে। ঠিক সময় মতো না ঘুমানোটা একটা চক্রের (Loop) মতো। একবার এর ভেতর পড়ে গেলে, বের হওয়া মুশকিল।
কিভাবে বাচ্চাকে সময় মতো ঘুম পাড়ানো যায়- আসলেই চিন্তার বিষয়। কারন খুব ছোট বাচ্চাকে বড়দের মতো নির্দেশনা দেয়া যায় না। কাজেই এমন অবস্থা তৈরী করতে হবে, যাতে বাচ্চা বুঝতে পারে এখন ঘুমের সময়। এটা অনেকটা একরকম সিগন্যাল দেয়ার মতো বাচ্চাকে যে ঘুমের সময়ে ঘুমাতে হবে। এই সিগন্যাল দেয়া তখনই কাজ করবে, যখন বাচ্চার ঘুমের আগে একটা নির্দিষ্ট রুটিন করে দেয়া যাবে। বাচ্চার তিনমাস বয়স থেকে নিয়মিত এই বেড টাইম রুটিন অনুসরন করতে পারেন।
বেড টাইম রুটিন কেন দরকার?
বড়রা যেমন সারাদিনের ব্যস্ততার পর, ঘুমাতে যাওয়ার আগে কিছুসময় প্রস্তুতি নেন ঘুমাতে যাবার (দাঁত ব্রাশ করা, চুল আচড়ানো, বিছানা করা), ঠিক তেমনি বাচ্চাদেরও প্রস্তুতির দরকার আছে। ঘুমানোর আগের এই প্রস্তুতিগুলো বাচ্চাকে যে রিলাক্স করে কেবল ঘুমানোর সিগন্যাল দেবে তা না, বরং বাচ্চারকে সারা রাতের একটা ভালো ঘুম আর সকালে চমৎকার একটা দিন শুরু করতে সাহায্য করবে।
কোন বয়স থেকে শুরু করবেন?
যত কম বয়স থেকে শুরু করতে পারেন, আপনার আর বাচ্চার জন্য তত ভালো। সাধারনত বাচ্চার ৬-৮ সপ্তাহ বয়স থেকেই সম্ভব বেড টাইম রুটিন শুরু করা, যখন আপনি ডেলিভারীর ধকল কিছুটা সামলে উঠতে পারবেন। তবে তিনমাস বয়স থেকে নিয়মিত এই রুটিন শুরু করতে পারেন।
কিভাবে শুরু করবেন?
বাচ্চাকে তাড়াতাড়ি বিছানায় দেবেন। সন্ধ্যা ৬.৩০ টা থেকে ৮.৩০ আদর্শ সময় বাচ্চার রাতের ঘুমের। রাতের নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম বাচ্চার বৃদ্ধি জন্য জরুরী। যখনি বিছানায় দেবেন ঠিক করবেন, তার ঘন্টাখানেক আগে, অন্তত আধা ঘন্টা আগ থেকে বেড টাইম রুটিন শুরু করুন। বেড টাইম রুটিনে যা যা থাকতে পারে-
- হালকা হাতে ম্যাসাজ
- উষ্ণ গরম পানিতে গোসল
- কাপড় বদলে দেয়া
- শেষবারের মতো দুধ খাওয়ানো (বুকের দুধ বা ফরমুলা)
- দাঁত ব্রাশ করে দেয়া (দাঁত উঠা মাত্র)
- গল্প বলা বা বেড টাইম স্টোরি পড়ে শোনানো
- গুনগুন করে গান শোনানো (সূরা/ দু’আ পড়তে পারেন)
- আদর করে বিছানায় দেয়া
আপনি কিভাবে বাচ্চার জন্য বেড টাইম রুটিন সেট করতে চান, সেটা সম্পূর্নই আপনার উপরে। কিন্তু সবসময় একটা ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন।
যেভাবেই শুরু করুন, তার শেষটা হবে বাচ্চাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়ার মাধ্যমে। বাচ্চা যাতে এই রুটিনের সাথে তার ঘুমাতে যাওয়াটাকে সম্পর্কিত (Associate) করতে পারে। প্রতিদিন একই রুটিন অনুসরন করতে করতে, যাতে এই প্রক্রিয়া শুরু হওয়া মাত্রই বাচ্চা বুঝতে পারবে যে তা ঘুমাতে যাওয়ার সময় হলো।
বেড টাইম রুটিন শুরুর আগে
এই রুটিন যেহেতু ঘুমানোর প্রস্তুতি, তাই বাচ্চাকে বুঝতে দিন (একটু বড় হলেই মুখেও বলুন)- এটা রাত, এবং রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। অর্থাৎ বাচ্চাকে রাত আর দিনের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে দিন। দিনের শুরুতেই সব পর্দা তুলে দিয়ে ঘরে আলো আসতে দিন। দিন মানেই বাচ্চার নানা রকম এক্টিভিটিস, খেলা, মজা করা। আর রাত মানেই ধীরে ধীরে সব উত্তেজনার প্রশমন।
এছাড়া বিকাল ৫ টার পর কখনোই বাচ্চাকে ঘুমাতে (Day-time Nap) দিবেন না। এমনভাবে রুটিন ঠিক করুন যাতে ৫ টার পর আর বাচ্চা না ঘুমায়। বিছানায় দেয়ার পর ঘর অন্ধকার করে দেবেন। অর্থাৎ রাতে সব অন্ধকার হয়ে যায় এবং সবাই ঘুমিয়ে পড়ে- বাচ্চাকে এটাই বোঝাবেন। বেশী দেরী করে বাচ্চাকে ঘুমাতে নিয়ে গেলে, বাচ্চা যেহেতু অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তাতেও সে না ঘুমাতে চাইতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্তি বাচ্চার গভীর রাতে জেগে থেকে বিরক্ত করার একটা কারন।
যে কোন রুটিন শুরু করলে তাতে বাচ্চার এবং আপনার অভ্যস্থ হতে সময় লাগতে পারে, অধৈর্য্য হয়ে পড়বেন না। কিন্তু আপনি যদি ঠিকমতো একই রুটিন অনুসরন করতে থাকেন, তাহলে দেখবেন বাচ্চা খুব দ্রুত তার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে।
অনেক সময়ই হয়ত রুটিন মেনে চলার মতো অবস্থা আপনার নাও থাকতে পারে, যেমন বাড়িতে অতিথি আসতে পারে, কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন বা বাচ্চা অসুস্থ থাকতে পারে, তারপরও যতদূর সম্ভব চেষ্টা করুন বাচ্চার বেড টাইম রুটিন মেনে চলতে। হয়ত দুই-একটা স্টেপ বাদ দিতে পারেন, কিন্তু তাও নিয়মিত করার চেষ্টা করুন। প্রথমদিকে হয়ত এই রুটিন আপনার জন্য ক্লান্তিকর মনে হতে পারে, কিন্তু এই রুটিন যেমন বাচ্চাকে ভালো ঘুমাতে সাহায্য করবে, তেমনি আপনিও বিশ্রাম নিতে পারবেন বা নিজের মতো কিছু ভালো সময় কাটাতে পারবেন।
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সাবেরা সাঈদা খান
M.B.B.S (DU), MPH (Reproductive & Child Health)(NIPSOM),
Diploma in Ultrasonogram
Lecturer, Ibn Sina Medical College
Consultant Sonologist, Trust Medical Care