সন্তানের পিছে খাবারের প্লেট হাতে দৌঁড়ানোর অভিজ্ঞতা কোন মায়ের না আছে! খুব স্বাভাবিক, সব মা-ই তার সন্তানের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে চিন্তিত থাকেন। কারণ জীবনের শুরুর দিকে সঠিকভাবে বৃদ্ধি হওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, এ কথা তারা জানেন।
বেড়ে ওঠা বলতে মূলত শারীরিক, মানসিক আর সামাজিক বিকাশকে বোঝায়। একেক মানুষ যেমন একেক রকম, তেমনি একেক শিশুর বেড়ে ওঠার হার একেক রকম। তবে শারীরিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কিছু দৃশ্যমান পরিমাপ রয়েছে, যা দ্বারা সঠিক বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা বোঝা যায়। যেসব শিশু সঠিক পুষ্টি পায়, তারা সাধারণত সঠিক হারে বেড়ে ওঠে। শুধু পুষ্টিই না, আরো কিছু বিষয় রয়েছে, যেমন- লিঙ্গ, জিন, শারীরিক কসরত, ঘুমের সময়, অসুস্থতা ইত্যাদি।
বয়স অনুযায়ী শিশুর ওজন আর উচ্চতা বৃদ্ধির একটি কমন প্যাটার্ন রয়েছে। গবেষকরা দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণের পর একটি চার্ট তৈরি করেছেন, যার নাম গ্রোথ চার্ট। আপনি হয়তো ইন্টারনেটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্রোথ চার্ট দেখে থাকবেন। আমাদের দেশের শিশুদের জন্য বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণিত একটি গ্রোথ চার্ট রয়েছে।
দারিদ্র আর অশিক্ষার কারণে এদেশে অপুষ্টি সমস্যা প্রকট, আর তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাহত হয় শিশুদের বেড়ে ওঠা। এ সমস্যা মোকাবিলা করতে সরকারি ভাবে গ্রোথ মনিটরিং এন্ড প্রমোশন কর্মসূচি (জিএমপি) বাস্তবায়িত হয়েছে। এই কর্মসূচিতে বলা হয়েছে নিয়মিত সন্তানের ওজন ও উচ্চতা পরিমাপ করতে-
- বয়স ০-২৪ মাস হলে: প্রতিমাসে ওজন, ৩ মাস অন্তর উচ্চতা
- বয়স ২-৫ বছর হলে: ৩ মাস অন্তর ওজন ও উচ্চতা
এই ওজন আর উচ্চতা গ্রোথ চার্টে স্পট করার মাধ্যমে শিশুর সঠিক বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা তা অনুমান করা সম্ভব। এবারে চলুন গ্রোথ চার্টটির সম্পর্কে জেনে নেই।
গ্রোথ চার্টের বক্র রেখাগুলোর পাঁচটি রং রয়েছে-
- লাল অংশ = মারাত্মক অপুষ্টি
- গাঢ় হলুদ অংশ = মাঝারি অপুষ্টি
- হালকা হলুদ অংশ = স্বল্প অপুষ্টি
- সবুজ = স্বাভাবিক
- সাদা = বেশি
এবারে নিচের চিত্র গুলো দেখুন। আরো স্পষ্ট চিত্র দেখতে চাইলে নিচের লিঙ্কে গিয়ে চার্টগুলো ডাউনলোড করে নিন-
ছেলে শিশুর জন্য- জিএমপি কার্ড
মেয়ে শিশুর জন্য- জিএমপি কার্ড
বয়স অনুযায়ী ওজন
চিত্র-১: ছেলে শিশুর ওজন বৃদ্ধির চার্ট (০-২ বছর)
প্রথমে চিত্র-১ দেখুন। গ্রাফটির x-অক্ষ (বাম থেকে ডান) বরাবর বয়স এবং y-অক্ষ (নিচ থেকে উপর) বরাবর ওজন দেয়া আছে। এখন শিশুর বয়স ও ওজন অনুযায়ী তা গ্রাফে প্লট করতে হবে।
ধরুন, ১২ মাস বয়সী একটি শিশুর ওজন ১০ কেজি। অর্থাৎ সে সবুজ ঘরে অবস্থান করছে এবং তার ওজন বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক। নিচের ছবিতে প্লট করে দেখানো হল-
চিত্র-১.১: ছেলে শিশুর বয়স অনুযায়ী ওজন প্লটিং
এভাবে করে জন্মের পর থেকে নিয়মিত ওজন মেপে গ্রাফে প্লট করে, সেগুলো পরস্পর জোড়া লাগিয়ে দিলে একটা রেখা পাওয়া যাবে। এখন এই রেখাটি যদি ঊর্ধ্বমুখী হয় তাহলে শিশু সঠিক ভাবে বাড়ছে। আর তা না হলে চিন্তার বিষয়। রেখা কোন ভাবে নিম্নমুখী হলে অবিলম্বে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিত।
চিত্র-১.২: শিশুর গ্রোথ প্যাটার্ন
সাধারণত জন্মের ৩-৪ দিন শিশুদের ওজন অনেকটা কমে যায় এবং ৭-১০ দিনের মাঝে তা ফিরে আসে। প্রথম তিন মাস প্রায় ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম করে দৈনিক বারে তারপরে গতি কমে যায়। ছয় মাসে গিয়ে শিশুর ওজন প্রায় দ্বিগুণ হয় আর এক বছর এগিয়ে হয় তিন গুণ। তবে কম ওজনের শিশুর ক্ষেত্রে পাঁচ মাসের আগেই ওজন দ্বিগুণ হয়ে যায় (চিত্র ১ ও ৩)।
জন্মের পর প্রথম ছয় মাস দেখা যায় স্বাভাবিক ওজন থাকে কিন্তু অনেকেরই এরপর রেখা নিম্নগামী হয়ে যায় কারণ বুকের দুধ এখন যথেষ্ট দুধের পাশাপাশি বাড়তি যে খাবার দেওয়া দরকার তা ঠিক পরিমাণে হচ্ছে না, কিংবা হজম করতে পারছে না।
২ বছরের বেশি বয়সীদের ওজন বৃদ্ধি অনেক ধীর গতিতেই হয় (চিত্র-২ ও ৪)।
চিত্র-২: ছেলে শিশুর ওজন বৃদ্ধির চার্ট (২-৫ বছর)
চিত্র-৩: মেয়ে শিশুর ওজন বৃদ্ধির চার্ট (০-২ বছর)
চিত্র-৪: মেয়ে শিশুর ওজন বৃদ্ধির চার্ট (২-৫ বছর)
বয়স অনুযায়ী উচ্চতা
একটি নবজাতকের উচ্চতা হয় সাধারণত ৫০ সেমি (২০ ইঞ্চি) এর মত। ১ বছরে সাধারণত আরো ২৫ সেমি ও ২ বছরে ১২ সেমি করে বৃদ্ধি পায় উচ্চতা।
ওজনের মত উচ্চতা অপুষ্টির সাথে এত জড়িত না, তবে দীর্ঘদিনের পুষ্টি ঘাটতি থাকলে তা উচ্চতায় প্রভাব ফেলে।
চিত্র-৫: ছেলে শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধির চার্ট (উপরে ০-২ বছর, নিচে ২-৫ বছরের জন্য)
চিত্র-৬: মেয়ে শিশুর উচ্চতা বৃদ্ধির চার্ট (উপরে ০-২ বছর, নিচে ২-৫ বছরের জন্য)
বৃদ্ধি কম হলে করণীয়
যদি শিশুর বৃদ্ধি সঠিকভাবে না হয় তাহলে প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে কেন এমন হলো। সাধারণত শিশুর অসুখ হলে, যেমন- ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, হাম ইত্যাদি হলে স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এমন হলে অবশ্যই ডাক্তারকে দেখাতে হবে।
শুধু সন্তান না, ব্রেস্ট ফিডিং করানো মায়েদের অস্বাস্থ্যকর ডায়েট ও অসুখও বৃদ্ধি স্তিমিত করার কারণ হতে পারে। তাই মায়েদের পরিমিত ও সুষম খাবার খাওয়া উচিত।
ছয় মাস পূর্ণ হলে শিশুদের মায়ের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার (বা পরিপূরক খাবার) দিতে হবে। কত বার এবং কত পরিমাণে দিতে হবে তা জেনে নিতে হবে পুষ্টিবিদ বা অভিজ্ঞ কারো কাছ থেকে। তাছাড়া খাবার হতে হবে সুষম, মানে সব পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। সাথে মজাদার হওয়াটাও একই ভাবে জরুরি! তবে শিশু খেতে না চাইলে জোর করা যাবেনা। শিশুর খাবার সময় যেন আনন্দদায়ক হয় সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হবে, সকলে মিলে খেতে উৎসাহিত করতে হবে।
মনে রাখবেন, শিশুর পুষ্টি ঠিক থাকলে আর সুস্থতা থাকলে, স্বাস্থ্যও ঠিক থাকবে। পুষ্টি ও অসুস্থতা ছাড়াও অন্যান্য কারণ গুলোর জন্য গ্রোথ চার্টের সাথে কখনো কখনো বৃদ্ধি না মিলতে পারে। তাতে ঘাবড়াবেন না, যদিনা কয়েক মাস ব্যাপী একই অবস্থা দেখেন। তাই এখন থেকে ওর পাশাপাশি গ্রোথ চার্টটির উপরেও নজর রাখবেন।
ছবি: Health, Population, Nutrition eToolkit by DGHS, Bangladesh and USAID
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সারওয়াত জাবীন আনিকা
এমবিবিএস
KMC (IMCS) – এ বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
অনেক উপকারী পোষ্ট যেটা সব শিশুদের বাবা মা দের প্রয়োজন। ৪ নাম্বার ইমেজটা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে না।