সিরিজ ইনডেক্স
১. হোমস্কুলিং এর ভালমন্দ
২. আমার হোমস্কুলিং এর আদ্যোপান্ত – প্রথম পর্ব
৩. হোমস্কুলিং ও ইসলাম শিক্ষা
৪. হোমস্কুলিং ও আউটডোর ট্রিপ
৫. হোমস্কুলিংঃ করণীয় ও বর্জণীয়
৬. হোমস্কুলিংঃ অক্ষর শেখানো
৭. হোমস্কুলিং কারিকুলাম যেভাবে তৈরি করবেন?
আমাদের মধ্যে প্রায় সবাই চাই সন্তানকে বেসিক ইসলামের শিক্ষাটুকু দিতে। অনেকের আবার স্বপ্ন থাকে সন্তানকে আলিম হিসেবে গড়ে তোলার। হোমস্কুলিং কি এর অন্তরায়?
উত্তরটা আসলে হ্যাঁ আর না এর অনেকটা মাঝামাঝি।
একথা আমাদের সবার জানা যে, সন্তানকে আলিম দেখতে চাইলে নিজেকেও ইলমের অনুসন্ধান করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের প্রায় কারোই এমন ইসলামিক ইলমগত অবস্থা নেই যাতে করে আমরা নিজেরা সন্তানদের ইসলাম পড়িয়ে আলিম বানিয়ে ফেলতে পারবো। এটা আমাদের পুরো সমাজের ব্যর্থতা।
তাহলে করনীয় কী? নিজেরা আরবী শেখা, কুরআন হিফয করা, হাদীস শেখা, শিখতে থাকা। যতটুকু পারা যায়। তাতে করে অন্তত সন্তানের আলিম হবার জন্য পড়াশোনার প্রথম দুই চার বছর যা লাগে সেটা আপনি কিছুটা হলেও দিতে পারবেন। আপনার আরবী যত ভালো হবে বাচ্চার আরবীর ভিত্তি তত মজবুত হবে এবং পরের ধাপগুলো ততই সহজ হবে।
আরেকটু ভেঙে বলি। ধরুন আপনি ইংলিশ আরবীতে একই রকম পারদর্শী। আপনি বাচ্চার সাথে যদি আরবীতে নিয়মিত কথা বলেন তাহলে বাচ্চার জন্য আরবী খুবই পরিচিত একটা ভাষা হবে। যেমন সিরিয়াল দেখে হিন্দী বাচ্চাদের জন্য খুব সহজ হয়ে যায়। এরপর বয়স চার-পাঁচ হতে হতে সে লিখতে পড়তে শিখে গেলেই আপনি তাকে আরবী ইলমের জগতে প্রবেশ করাতে পারবেন। সেখানে আপনি যদি আরবী একেবারেই না জানেন বা অল্প জানেন তাহলে আপনাকে বাচ্চার বয়স অন্তত আট দশ হওয়া পর্যন্ত শুধু রিডিং পড়ানো শিখিয়ে বসে থাকতে হবে। এরপর সে মাদীনা সিরিজ পড়ে আরবী শিখবে।
ভিত্তি মোটামুটি (পুরোপুরি না) মজবুত করতে করতে কম হলেও আরো চার পাঁচ বছর। তারপর হয়তো সে আস্তে আস্তে হাদীসের বই পড়তে শুরু করবে। যেখানে প্রথম বাচ্চাটা বয়স ছয় সাত হবার আগেই হাদীসের বই পড়তে শুরু করবে। অর্থাৎ আপনি ভালো আরবী জানলে বাচ্চাকে বাচ্চাকে এগিয়ে রাখতে পারবেন।
বাচ্চাকে হাফিয বানাতে চাইলেও আপনাকে কুরয়ান হিফয করতে হবে। অল্প বিস্তর না, উঠেপড়ে লেগেই করতে হবে। না হলে কুরআনের হাফিয হয়ে গেলেও তার সাথে কুরয়আনের সম্পর্ক গড়ে উঠবে না। এই কঠিন কাজ বাচ্চার উপর চাপিয়ে দিয়ে যতই উৎসাহ দেন না কেন, যতই হিফযের ফযীলত আলোচনা করেন, ও মনে মনে একটা কথাই ভাববে, এত ভালো কাজ হলে আম্মু কেন করে না? আম্মুর কেন এটা প্রায়োরিটি না? উত্তর যদি আপনি দেন যে, আম্মুর বয়স হয়ে গেছে, মাথা আগের মত আর কাজ করে না, তাহলে কিন্তু সর্বনাশ। আপনার বাচ্চাও বড় হওয়ার পর মাথাকে ছুটি দিয়ে দেবে। কবরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ইলম অর্জন করবে না, আলিমও হবে না।
আসল কথা হলো, আমাদের উলামারা বলেন, মাথা কখনই কাজ করা থামিয়ে দেয় না। দীর্ঘদিন আমরা পড়াশোনার সাথে না থাকায় একটা জড়তা আসে কেবল। চেষ্টা করে লেগে থাকলে সেটা কাটিয়ে আবার মাথাকে ধার দেয়া সম্ভব। একারণেই তো সত্তর আশি বছর বয়সে হিফয করার ঘটনা অহরহই শোনা যায়। আমাদের ক্লাসমেটদের মধ্যেও একাধিক বয়স্কা(ষাট, নব্বই) নওমুসলিমা আছেন। চল্লিশোর্ধ্ব আছেন অনেক মহিলা। খুব কষ্ট হয় উনাদের পড়া বুঝতে। কিন্তু দিনশেষে বুঝেই ছাড়েন মা শা আল্লাহ।
আপনার তত্তাবধানে রেখে বাচ্চাকে ততদিন পড়াতে পারবেন যতদিন আপনার রসদ থাকে। এরপর তাকে উস্তাদের কাছে পাঠাতে হবে, কোন বিকল্প নেই। মা হিসেবে এক্ষেত্রে আপনার ভুমিকা হবে সবচেয়ে ভালো শিক্ষককে খুঁজে বের করা, প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আলাদাভাবে শিক্ষকের কাছে পড়া অনেক বেশি উপকারী। কেন সে ব্যপারে বিস্তারিত আরেকদিন বলব নাহয়। তবে শিক্ষক বাসায় এসে পড়াবেন না, আপনাকে আর বাচ্চাকে শিক্ষকের কাছে যেয়ে পড়তে হবে। নাহলে বাচ্চা আলিম হবে না। নিজে আরাম করে ইলমকে কেউ নিজের কাছে ডেকে আনতে পারে না। কষ্ট করে ইলমের কাছে যেতে হয়, তবেই ইলম ধরা দেয়।
প্রাইভেট টিউটর রেখে আজ পর্যন্ত কেউ ভালো কোন পর্যায়ে গেছে দ্বীন শিক্ষার ক্ষেত্রে একথা শোনা যায়নি। আপনাকে সবচেয়ে ভালো শিক্ষক খুঁজে বের করতে হবে। তিনি যেখানেই থাকুন, সেখানেই যেতে হবে। নাহলে বাচ্চা ভালো আলিম হবে না। শিক্ষক ঢাকায় থাকেন না, সন্দ্বীপে থাকেন? সেখানেই যান। পারলে পুরো পরিবার সহ শিফট করুন। জ্বি, ইলম এতটাই কঠিন। একারণেই যুগে যুগে হাতেগোণা মানুষ সত্যিকারের আলিম হতে পেরেছেন।
ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহর মা, ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহর মা, ইমাম বুখারীর মা কী পরিমাণ স্যাক্রিফাইস করেছেন তা কল্পনার বাইরে। অনলাইনে ভালো উস্তাদের কাছে পড়াবেন ভাবছেন? হবে না, যেয়ে পড়তে হবে। প্রথম দুই চার বছর সম্ভব হলেও হতে পারে। এরপর আর না। যদি অনলাইনই আপনার ভরসার জায়গা হয় তাহলে আপনার সন্তান একজন অনেক জানা সাধারণ মানুষ হবে, আলিম হবে না। উলামারা বলেন, ইলম বইয়ের পাতায় নেই। ইলম এমন নূর যা শিক্ষকের বুক থেকে ছাত্রের বুকে যায়। ঘরে বসে অনলাইনে শিক্ষকের কাছে বই পড়ে ইলম আসবে না।সশরীরে উস্তাদের মুখোমুখি বসতেই হবে।
আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিন এত ত্যাগ স্বীকার করে সন্তানকে আলিম বানানোর ব্যপারে। ততদিন আপনিই পড়ান, যদি আপনার কাছে সেই এক্সপার্টিজ না থাকে টিউটরের কাছে যান। আপনার তাজউইদ ভালো না? আলিফ বা তা সা শিখানোর জন্যও অমুক আপু বা তমুক ভাবীর কাছে পাঠান। সময়মত যাবে, আসবে। নিজে কষ্ট করবে, উস্তাদাকে কষ্ট দিয়ে ডেকে আনবে না।
হোমস্কুলিং কমিউনিটি গড়ে তুলুন আপনার বাচ্চার বয়সী আরো দশ বারোজন বাচ্চার মায়েদের নিয়ে। সবার বাচ্চাই তাজউইদ শিখতে একই ব্যাচে এক্স আন্টির কাছে যাবে, ওয়াই আন্টি আরবীতে পটু, তিনি নিজের বাচ্চা ও অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে আরবীতে কথা বলবেন, শিখাবেন। আপনি যদি ইংলিশে দক্ষ হন তাহলে আপনার ও অন্যদের বাচ্চার ইংলিশের দায়িত্ব আপনি নিলেন। বাচ্চাদের দৌড়ের উপর রাখতে হবে, কিন্তু একই সাথে বাচ্চারা যাতে নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাত করতে পারে, কোয়ালটি টাইম কাটাতে পারে, সে সুযোগও রাখতে হবে। যেটা আপনাকে এমনিতেও করতে হতো।
লেখক: ফারিহা আমাতুর রহমান
সম্পাদনা: হাবিবা মুবাশ্বেরা
ছবি কৃতজ্ঞতা: brgfx – freepik.com