
বাচ্চার বয়স যখন দুই বছর, তখন সে একটা ট্রানজিট পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। না সে এখন নিউবর্ন বাচ্চার মতো খুব ছোট, আবার না খুব নিয়ম কানুন মানা টডলার। এর মধ্যে যদি টেরিবল টু’জ চলতে থাকে তাহলে তো কথাই নেই। সদ্য কথা শিখতে শুরু করা বাচ্চার রাগ, জেদে বাবা-মায়ের অবস্থা কাহিল। একদিকে তার সব কাজ নিজে করতে চাওয়ার বাহানা আর আরেকদিকে করতে না পারার অক্ষমতা এই দুইয়ে মিলে বাচ্চা নিজেই বিপর্যস্থ থাকে।
এই বয়সটা বাচ্চাদের নিয়ম কানুন শেখানোর জন্য চমৎকার। অনেক মায়েরা অভিযোগ করেন, বাচ্চাকে একদম নিয়ম কানুন শেখানো যাচ্ছে না। বাচ্চারা অবশ্যই বড়দের মতন না, যে খালি মুখে বললেই সে সব কথা শুনবে। বরং তাকে নিয়ম কানুন শেখাবার জন্য প্রতিদিন একই কাজের ধারার পুনরাবৃত্তি (Repeating) জরুরী। এভাবেই সে অভ্যস্থ হবে কোন সময় কোন কাজ করতে হবে এবং কোন কাজের পর কোন কাজটা আসবে।
কেমন হতে পারে দুই বছর বয়সী বাচ্চার সারাদিনের রুটিন?
মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকটা বাচ্চা আলাদা। প্রত্যেকটা ফ্যামিলির নিয়ম-কানুনও আলাদা। কিন্তু এই বয়সী একটা বাচ্চার যে পরিমান খাদ্যপুষ্টি, ঘুম আর কার্যক্রম (Activities) দরকার, তার উপর ভিত্তি করে একটা স্যাম্পল রুটিন দেয়া হলো। এটাকেই আদর্শ মানার দরকার নেই। তবে কম-বেশী এদিক ওদিক করে বাচ্চার জন্য রুটিন তৈরী করুন। এতে বাচ্চা যেমন রুটিন মানা শিখবে, তেমনি বাবা-মা হিসেবে আপনার জীবনযাত্রাও সহজ হবে।
দুই বছরের বাচ্চার সম্ভাব্য রুটিনঃ
- সকাল ৭ টাঃ ঘুম থেকে উঠা।
- সকাল ৭ টা- ৮ টাঃ সকালের নাস্তা খাওয়া, বাবার সাথে কাটানো সময়, খেলাধূলা।
- সকাল ৯.৩০ঃ হালকা স্ন্যাক্স
- সকাল ১০ টাঃ বাইরে পার্কে হাঁটতে নেয়া (সম্ভব হলে), বই পড়ে শোনানো, শিক্ষামূলক কার্যক্রম।
- দুপুর ১২.৩০ টাঃ দুপুরের খাবার খাওয়া।
- দুপুর ১ টাঃ দিনের ঘুম (১-২ ঘন্টা)
- দুপুর ৩ টাঃ স্ন্যাক্স টাইম। নিজে নিজে খেলা।
- বিকাল ৪ টাঃ পার্কে নেয়া (সম্ভব হলে), বাসায় সৃজনশীল কার্যক্রম (Creative Activities)।
- সন্ধ্যা ৬ টাঃ বাবা-মা’র সাথে খেলা, সব খেলনা গুছানোতে বড়দের সাহায্য করা।
- সন্ধ্যা ৭ টা- ৭.৩০ টাঃ রাতের খাবার খাওয়া।
- রাত ৮ টা- ৮.৩০ টাঃ ঘুমের সব প্রিপারেশন নিয়ে বিছানায় চলে যাওয়া এবং ঘুম।
মিলিটারী নিয়ম কানুনের মতো একদম স্ট্রিক্ট হওয়া হয়ত প্রতিদিন সম্ভব না। কিন্তু নিয়মিত একটা নির্দিষ্ট চার্ট ফলো করলে বাচ্চার জন্য বোঝা সহজ হয়, বাবা-মা আসলে কি চাইছেন। এই বয়সী বাচ্চা এমনিতেই দিনে দুইবারের বদলে একবার ন্যাপ নিবে। কালেভদ্রে বাড়ির বাইরে থাকলে যে হয়ত নাও ঘুমাতে চাইতে পারে। কিন্তু এমন যেন না হয়, এই ঘুম প্রতিদিন বাদ যাচ্ছে। এমনকি ঘুমাতে না চাইলেও, চুপচাপ শুয়ে থাকার অভ্যাস গড়ে তুলুন। তবে বাচ্চাকে ঘরের ভেতরে ও বাইরে যথেষ্ট পরিমান কাজ দিয়ে ব্যাস্ত রাখলে বাচ্চা এমনিতে ক্লান্ত থাকবে।
বাবা-মায়ের জন্য টিপস
- যদিও সাংসারিক কাজের ফাঁকে কঠিন মনে হতে পারে, বাচ্চাকে প্রচুর প্রচুর সময় দিন। তার সাথে খেলুন, বই পড়ে শোনান।
- বাচ্চার জন্য অপ্রয়োজনীয় ইলেকট্রিক গ্যাজেট সরিয়ে রাখুন। মোবাইল ফোন, ট্যাব এগুলো শিশুর জন্য না। তাকে হাতে খেলনা দিন, ছবিওয়ালা বই কিনে দিন। এবং বাচ্চার সাথে বসে খেলুন, বই পড়ে শোনান। মনে রাখবেন, বাচ্চারা গ্যাজেট চায় না। চায় আপনার নিরবিচ্ছিন্ন মনোযোগ।
- বাসায় কাজে বাচ্চাকে যুক্ত করুন। যখন রান্না করবেন, বাচ্চাকে সাথে নিন। পেঁয়াজের খোসা ছিলতে দিন। সিম, বরবটির মতো সবজি হাতে ধরিয়ে দিন। কোনটার কি নাম, বাচ্চাকে দেখে শেখার সুযোগ দিন।
- প্রাত্যহিক জীবন থেকে তাকে শেখার সুযোগ দিন। রঙয়ের নাম, গুনতে শেখা কেন ইউটিউব ভিডিও দেখে শিখতে হবে? আশেপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিস, ফুল-পাতা, আকাশ থেকে রঙ শেখান, গুনতে শেখান। বই থেকে বর্ণমালা শেখান।
- একসাথে গাছে পানি দিন। তাকে মাছ বা পাখির মতো পোষা কিছু কিনে দিন। একসাথে যত্ন নিন। এতে বাচ্চা বাসায় থেকেও প্রকৃতির সংস্পর্শ পাবে।
- বাচ্চাকে নিয়ে ক্র্যাফটস (যেমন কাগজের নৌকা, প্লেন) বানান, নানা রকম এক্টিভিটিজ করুন। সব বয়সী বাচ্চা এইধরনের কাজ আগ্রহ নিয়ে করে।
- সম্ভব হলে অন্য বাচ্চাদের সাথে তাকে খেলতে দিন। বাসায় আমন্ত্রন জানান বা পরিচিত পরিবারের সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে খেলতে নিয়ে যান। তবে নিশ্চিত রাখবেন, এই সময় কোন বাচ্চার হাতে যেন কোন ধরনের গ্যাজেট না থাকে।
- খোলা পার্কে নিয়ে যান, ইচ্ছা মতো ছুটে বেড়াতে দিন। হাতে ধরে প্রকৃতি চেনান।
বাচ্চাকে সময় দেয়া একধরনের বিনিয়োগ, যেটা সারাজীবন তার পাথেয় হয়ে থাকবে। দুই বছর বয়স থেকে বাচ্চাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। এই সময় বাবা-মায়ের দেয়া সময়, আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা তার ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়ক।
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সাবেরা সাঈদা খান
M.B.B.S (DU), MPH (Reproductive & Child Health)(NIPSOM),
Diploma in Ultrasonogram
Lecturer, Ibn Sina Medical College
Consultant Sonologist, Trust Medical Care