শরীরের থাইরয়ড গ্রন্থি থেকে যেসকল হরমোন নিঃসরিত হয়, সেগুলোকে থাইরয়ড হরমোন বলে। এই হরমোন গুলো নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকাটা আমাদের শরীরের জন্য খুবই দরকারি। কোষের বৃদ্ধি থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি অঙ্গের মেটাবলিজম বা বিপাকেই এর অবদান রয়েছে । কম উৎপাদন (হাইপোথাইরয়ডিজম) কিংবা বেশি (হাইপোথাইরয়ডিজম), দুটোই ভীষণ ক্ষতিকর।
থাইরয়ড হরমোনের ঘাটতিতে অর্থাৎ হাইপোথাইরয়ডিজমে ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি, চুল পড়া, মাসিকের সমস্যা সহ শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। মূলত পুরুষদের থেকে নারীদের ভেতরই এ রোগটি বেশি দেখা যায়। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ১-২% মানুষ এ রোগে ভুগছে।
হাইপোথাইরয়ডিজম এর কারণ
আমাদের সবার গলার মাঝ বরাবর প্রজাপতির মত একটি ছোট্ট গ্রন্থি রয়েছে, সেটাই থাইরয়েড গ্রন্থি। এটি থাইরয়েড হরমোন গুলো তৈরি ও সংরক্ষণ করে। মাথায় অবস্থিত পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে উৎপাদিত থাইরয়েড স্টিমুল্যাটিং হরমোন বা TSH এর সাড়া পেলে থাইরয়েড হরমোনগুলো রক্তে ছাড়া পায়।
তবে ঘটনা সব সময় এভাবেই ঘটে তা না, মাঝে মধ্যে TSH এর উপস্থিতিতেও থাইরয়ড গ্রন্থি তার হরমোনগুলো নিঃসৃত করে না। একে বলে প্রাইমারি হাইপোথাইরয়ডিজম। হাসিমোতো থাইরয়ডাইটিস নামে একটি অটো-ইমিউন রোগে শরীরের ইমিউন সিস্টেম নিজ শরীরের থাইরয়ড গ্রন্থিকেই ঘায়েল করার ফলে এমনটা হতে পারে। অনেক সময় আক্রান্ত গ্রন্থিটি বড় আকার ধারণ করে। তাছাড়া শরীর আয়োডিনের ঘাটতি হলে, জিনগত ত্রুটির কারণে; কিংবা বিভিন্ন ওষুধ, রেডিয়েশন বা সার্জারির ফলেও এই গ্রন্থিতে ক্ষত তৈরি হতে পারে। এগুলোর সুদূর প্রসারী প্রভাব হিসেবে থাইরয়ড গ্রন্থির ক্যানসারও দেখা দিতে পারে।
আবার পিটুইটারি গ্রন্থির ক্ষতির কারণে তথা TSH হরমোনের অভাবেও সমস্যা হতে পারে (সেকেন্ডারি হাইপোথাইরয়ডিজম)।
হাইপোথাইরয়ডিজম এর লক্ষণ
হাইপোথাইরয়ডিজম এর লক্ষণগুলো সাধারণত অত একটা প্রকট হয় না, আবার অন্য অসুখের লক্ষণের সাথে মিলেও যেতে পারে।
- ক্লান্তিভাব, দীর্ঘ ঘুমের পরেও থেকে যায়
- ডিপ্রেশন বা দুশ্চিন্তা
- কোন কারণ ছাড়াই ওজন বেড়ে যাওয়া
- চিন্তায় ধোঁয়াশা, মনোযোগের ঘাটতি
- স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেও ঠান্ডা অনুভব হওয়া
- চুল পড়া, শুস্ক ও ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া
- ত্বক শুষ্ক, খসখসে হয়ে যাওয়া; বিশেষত পায়ের পাতা
- অস্বাভাবিক কম রক্তচাপ
- মুখ ফোলাভাব, বিশেষ করে চোখের চারদিকে
- রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়া
- মাসিক অনিয়মিত হওয়া
- মাঝে মধ্যে খিঁচুনি হতে পারে
রোগ নির্ণয় এর জন্য ডাক্তার লক্ষণসমূহ ও রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট যাচাই করে নিবেন। অনেক সময় খালি হাতেও থাইরয়েড গ্রন্থির স্ফীতি টের পাওয়া যায়।
- TSH এর মাত্রা
- থাইরয়ড হরমোন (রক্তে স্বাধীন T3, T4)
হাইপোথাইরয়ডিজম এর চিকিৎসা
এর চিকিৎসায় মূলত ব্যবহার করা হয় থাইরয়ড হরমোন রিপ্লেসমেন্ট ড্রাগ, যেমন- লেভোথাইরক্সিন (সচরাচর ব্যবহৃত), ন্যাচারাল ডেসিকেটেড থাইরয়ড বা NDT (এর ব্যবহার অনেক বিশেষজ্ঞের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ)।
তবে ওষুধের পাশাপাশি জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনাটাও এ ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি চিকিৎসা। বিশেষ করে প্রতিদিন সঠিক খাবার সঠিক মাত্রায় খেলে এই রোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।
হাইপোথাইরয়ডিজম ডায়েট
(ক) কি কি উপকারী
আপনার শরীরের থাইরয়ড গ্রন্থির কার্যকারিতা ঠিকঠাক রাখতে চাইলে নিচের পুষ্টি উপাদান গুলো একটু বেশি জরুরি-
১. আয়োডিন
থাইরয়েড হরমোন তৈরি করতে শরীরের আয়োডিন প্রয়োজন। কাজেই এর সঠিক মাত্রা নিশ্চিত করতে হবে প্রতিদিন। আয়োডিনের সবচেয়ে সহজ উৎস হল আয়োডিন যুক্ত লবণ। আমাদের দেশে অনেকে খোলা লবণ খান, যা বাজারে সস্তায় পাওয়া যায়। কিন্তু এমনটা করলে আপনার সহ পরিবারের সবারই আয়োডিনের ঘাটতি থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
আয়োডিনের অন্যান্য উৎস হল সামুদ্রিক মাছ। সামান্য আয়োডিন ডিম, দুধ সহ অন্যান্য খাবারেও পাওয়া যেতে পারে।
২. সেলেনিয়াম
থাইরয়েড হরমোন গুলোর কাজে সেলেনিয়াম সাহায্য করে থাকে, তাই এটিও জরুরি। তাছাড়া এর এন্টি অক্সিডেন্ট গুণ থাকার কারণে থাইরয়ড গ্রন্থিকে বিভিন্ন ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে। বাদাম, ডাল, মাছ, ডিম ইত্যাদিতে সেলেনিয়াম পাওয়া যায়।
৩. জিঙ্ক
সেলেনিয়ামের মত জিঙ্কও থাইরয়েড হরমোনের কাজে সাহায্য করে। এটি পাওয়া যায় মূলত সামুদ্রিক মাছ ও মাংসে।
(খ) কি কি ক্ষতিকর
১. গয়ট্রোজেন
এই শ্রেণীর যৌগগুলো থাইরয়ডের কাজকে বাধা দেয়, ফলে গ্রন্থিটি ফুলে গিয়ে গয়টার বা গলগন্ড রোগ হতে পারে। এর খাদ্য গুলো হল-
- সয়াবিন জাত খাবার
- কিছু সবজি, যেমন- ফুলকপি, বাধাকপি, পালং শাক, মিষ্টি আলু ইত্যাদি
- কিছু ফল, যেমন- স্ট্রবেরি, নাশপাতি, পিচ ইত্যাদি
- কিছু বাদাম ও বীজ- চীনা বাদাম, মিলেট ইত্যাদি
এই খাবার গুলো একেবারে বাদ দিতে হবে তা না, বরং আয়োডিনের ঘাটতি থেকে থাকলে কম খেতে হবে। তাছাড়া, রান্না করে খেলে ক্ষতিকর উপাদানটি নষ্ট হয়ে যায়, তাই আর চিন্তার কিছু নেই।
২. প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার
শুধু এক হাইপোথাইরয়ডিজম না, যে কোন সুস্থ মানুষেরও উচিত বাইরে থেকে কেনা এসব খাবার যথা সম্ভব পরিহার করা। খাবার যত কম প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তার গুনগত মান তত বজায় থাকে। যেমন, মিলে ছাটা সাদা চাল অপেক্ষা ঢেঁকি ছাটা লাল চাল ভালো, ময়দা অপেক্ষা আটা ভালো।
এছাড়াও, এসব রিফাইন্ড খাবার, বিশেষত সাদা চিনি ওজন সহজেই বাড়িয়ে দেয়। ফলে হাইপোথাইরয়ডিজম সহ অন্য যেকোন বড় রোগ হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৩. ক্যাফেইন
চা, কফি, চকোলেট অর্থাৎ ক্যাফেইন এ ভরপুর খাবার বেশি খেলে আপনার থাইরয়েড গ্রন্থির ক্ষতি করতে পারে। তাই চা বা কফি পরিমিত পান করুন।
(গ) ডায়েটে কি কি থাকবে
ডায়েট নিয়ে খুব বেশি চিন্তার কারণ নেই। ক্ষতিকর উপাদান সমৃদ্ধ খাবার গুলো একটু কমিয়ে, ওজন কমানোর লক্ষ্য নিয়ে নিজের ডায়েট প্ল্যানিং করবেন। স্বাস্থ্যকর খাবার খাবেন, প্রয়োজন ও পরিমাণ বুঝে। তবু আপনার সুবিধার্থে থাকছে কিছু পরামর্শ-
- ভাত, রুটি: এগুলোতে খেতে মানা নেই। তবে চেষ্টা করবেন পরিমাণ খুব কমিয়ে দিতে। আপনার ওজন উচ্চতা অনুযায়ী কিলোক্যালরি মেপে খাবেন।
- ডিম: পুরো একটা ডিম খাবেন প্রতিদিন। কুসুম বাদ দিতে হবে না। আয়োডিন, সেলেনিয়াম সহ বেশির ভাগ পুষ্টি উপাদানের যোগান দিবে।
- মাংস: রেড মিট (গরু, খাসি) কম খাবেন। সপ্তাহে দু-তিন দিন খেলেই যথেষ্ট।
- মাছ: মিঠা পানির মাছ, ছোট মাছের সাথে সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার চেষ্টা করবেন। সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি খেতে পারেন প্রায় প্রায়।
- শাক-সবজি, ফল-মূল: একজন বাংলাদেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অন্তত ৩ পরিবেশন সবজি ও ২ পরিবেশন ফল খাওয়া উচিত (পরিবেশন সংক্রান্ত বিস্তারিত রয়েছে আরেকটি লেখায়)। হাইপোথায়রয়ডিজম সনাক্ত হয়ে থাকলে উপরে উল্লেখিত সবজি, ফল গুলোর পরিমাণ কমিয়ে দিবেন, যদি কাঁচা খেয়ে থাকেন।
- ফাইবার: ফাইবার ওজন কমাতে সাহায্য করে। শাক সবজি, শস্য জাতীয় খাবার তো খাবেনই, সাথে ইসবগুলের ভুসি, চিয়া সিড ইত্যাদি ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেতে পারেন।
- দুধ: দুধ বা দুধ জাতীয় খাবার খাবেন রোজ। ওজন খুব বেশি হলে লো ফ্যাট দুধ কিনে খেতে পারেন। টক দই খেলে খুবই ভালো। তবে পনির জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলবেন।
- পানীয়: বেশি বেশি পানি খেতে হবে। চা কফি কম খেলেও, প্রতিদিন গ্রীন টি রাখতে পারেন ডায়েটে। এটি আপনার ঝিমিয়ে পড়া বিপাক ক্রিয়াকে চাঙ্গা করে তুলবে, ওজন ঝরবে সহজে।
অন্যান্য
ডায়েট ছাড়াও আপনার সামগ্রিক লাইফস্টাইল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- যেহেতু মেটাবলিজম খুব ধীর হয়ে যায়, তাই ব্যায়াম খুবই কাজে দিবে। মডারেট থেকে হাই ইন্টেন্সিটি কার্ডিও, যেমন- জোরে হাঁটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং ইত্যাদি মেটাবলিজম বাড়িয়ে দেবে।
- অনেকে দ্রুত ওজন কমানোর জন্য কিটো ডায়েট বা অন্য কোন ফ্যাড ডায়েট করে থাকেন। একেবারেই কম কার্বোহাইড্রেট পেটে গেলে সেটা কিন্তু আবার থাইরয়ড হরমোনের উৎপাদন কমিয়ে দিবে। তাই ধীরে ধীরে ওজন কমানোর চেষ্টা করুন।
- প্রায় প্রায় ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং বা রোজা রাখার চেষ্টা করুন। এতে মেটাবলিজম বাড়বে, ওজনও কমবে।
ছবিঃ Thyroid Diet Coach
তথ্যসূত্রঃ Healthline
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সাবরিনা আফরোজ
MBBS, MPH
লেকচারার, ঢাকা কমিউনিটি মেডিসিন কলেজ
সম্পাদনায়ঃ হাবিবা মুবাশ্বেরা