লেবারের কথা শুনলে হয়তোবা আমাদের ভাবনায় প্রথমে একজন মায়ের প্রচন্ড শারীরিক কষ্টের চিত্রটা ভেসে ওঠে। যদিওবা বলাই বাহুল্য, প্রেগন্যান্সিতে লেবার শুধু শারীরিক নয় বরং শারীরিক, মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং আবেগীয় অনুভূতির সমন্বিত শক্তি৷ সৃষ্টিকর্তা নারীর শরীরকে সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য জরায়ু, বার্থ ক্যানেল, হরমোন, প্রয়োজনীয় পেশী ইত্যাদি সব দিয়ে রেখেছেন। নারীর মননকে তার জন্য প্রস্তুত করেই পাঠিয়েছেন৷
সাধারণভাবে বললে, জরায়ুর ক্রমাগত সংকোচনের ফলে সৃষ্ট শক্তি প্রাকৃতিকভাবে মানব শিশুকে মায়ের পেট থেকে বের করে আনে। এটাই লেবার। অর্থাৎ, প্রাকৃতিকভাবে ( কোনো মেডিকেশন এবং সি সেকশন ছাড়া) সন্তানের ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্য লেবার প্রয়োজন।
বিষয়সূচী
লেবারের প্রয়োজনীয়তা বা তাৎপর্য বুঝতে হলে প্রথমে আমাদের লেবার নিয়ে কিছু কথা জানা দরকার।
লেবার কী?
লেবার শুরু হয় জরায়ুর পেশীর সংকোচন দিয়ে এবং শেষ হয় প্রাকৃতিকভাবে শিশুর ডেলিভারির পর প্ল্যাসেন্টার ডেলিভারির মাধ্যমে। সাধারণত যখন সন্তান ফুল টার্ম (৩৭-৪২ সপ্তাহ) তখন লেবার শুরু হয়৷ সাধারণভাবে, মিউকাস প্লাগ বের হওয়ার মাধ্যমে বা অনেকের ক্ষেত্রে তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে এমনিয়োটিক স্যাক র্যাপচার হওয়ার (পানি ভাঙা) পর জরায়ুর আসল সংকোচন বা ট্রু লেবার শুরু হয়৷ তবে অনেক সময় লেবারের পুশিং স্টেইজেও এই পানি ভাঙ্গতে পারে। এরপর ক্রমাগত সংকোচন শুরু হয় যা সাধারণত ১২-২৪ ঘন্টা স্থায়ী হয়। তবে এই সময়টা এর একটু কম বেশি হতে পারে। প্রথম সন্তান জন্মে তুলনামূলক সময় বেশি লাগতে পারে বলে ধরে নেয়া হয়। একাধিক সন্তান (টুইন, ট্রিপলেট)এর জন্মের সময় ডাক্তাররা নিবিড় পর্যবেক্ষনে প্রসূতি মাকে রাখেন।
লেবারকে সহজভাবে বুঝার জন্য আমরা একে ঢেউয়ের সাথে তুলনা করি। কখনও কখনও এই ঢেউ তীব্র, দীর্ঘ এবং অল্পক্ষণ পর পর আসে৷ কখনো কখনো এই ঢেউ ক্ষীণ এবং অনেকক্ষণ পর পর আসে৷ ধীরে ধীরে সংকোচনগুলোর তীব্রতা বাড়তে থাকে এবং সময়ের ব্যবধান কমতে থাকে৷ ট্রু লেবার বোঝার একটা সাধারণ উপায় হলো ঘন্টায় অন্তত ১০ বার সংকোচন। ধীরে ধীরে প্রতিবার সংকোচের মধ্যকার সময় কমতে থাকে।
প্রাকৃতিকভাবে মায়ের শরীর লেবারের সূচনা করে সন্তান জন্মদানের উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরী করে দেয়।
লেবারের ধাপসমূহ
লেবারের ৩ টি ধাপ থাকে। মোটাদাগে এই ৩ টি ধাপ এর নাম:
১) সারভিক্স ওপেনিং বা খুলে যাওয়া
২) সন্তানের বের হওয়া
৩) প্ল্যাসেন্টা বের হওয়া
লেবারের প্রতিটি ধাপ পর্যায়ক্রমে শিশুকে বের করে আনে। প্রতিটা ধাপের সাথে আছে হরমোনের প্রভাব, মায়ের শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তন, ইত্যাদি। ওভারির আর প্ল্যাসেন্টার এস্ট্রজেন জরায়ুর অক্সিটোসিন রিসিপ্টরের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। লেবারের সময় জরায়ুতে শিশুর ক্রমাগত চাপ Corticotropin hormone (ACTH) কে স্টিমুলেট করে যা করটিসলের রিলিজের সূচনা করে৷
করটিসল প্ল্যাসেন্টাতে প্রভাব ফেলে এস্ট্রজেন আর প্রজেস্টোরন এর নিঃসরণ কমিয়ে দেয় আর প্রস্টাগ্লান্ডিস এর নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়, যা জরায়ুর সংকোচন ঘটায়৷ এর প্রভাবে সারভিক্সের প্রসারণ (স্ট্রেচ) ঘটে এবং তা খুলে যেতে থাকে। সারভিক্স এর প্রসারণ সংবেদনশীল ফাইবারকে স্টিমুলেট করে যা অক্সিটোসিন নিঃসরণ করে। অক্সিটোসিন জরায়ুর সংকোচন ঘটায়, যা আবার জরায়ুকে স্টিমুলেট করে প্রস্টাগ্লান্ডিসের নিঃসরণ ঘটায়৷ লেবারে এই চক্র চলতে থাকে যতক্ষণ না শিশু বের হয়ে আসে।
প্রাকৃতিকভাবে জন্ম দেয়া চ্যালেঞ্জিং তবে এটা নারীর সহজাত ক্ষমতার মধ্যেই৷ নারীর শরীর ও মনন জন্মদানের ব্যাপারে সহনশীল ও সক্ষম।
প্রাকৃতিক প্রসবের সুবিধাগুলো
এবারে তাহলে জেনে নেই, লেবার যেই প্রাকৃতিকভাবে সন্তান জন্মদানের জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ, সেই প্রাকৃতিক জন্মদানের বেশ কিছু সুবিধাঃ
- শরীরে বহিরাগত কোনো কিছুর প্রবেশ নেই। কাজেই, মা ও সন্তানের শরীরে কোনো ক্ষতি বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা নেই।
- মা পুরো জন্মদান প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাশীল। এখানে পুরো সময় মা সতর্ক থেকে নিজের সহজাত প্রবৃত্তি, জ্ঞান, শারীরিক ও মানসিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সন্তানকে দুনিয়াতে আনে। এটি মাকে এমন এক বিজয়ের সুখানুভূতি দেয় যার ফলে পরবর্তীতে জন্মদানের সময় প্রচন্ড ব্যথার অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তারা অনেকেই প্রাকৃতিক জন্মদান প্রক্রিয়াই বেছে নেয়৷ অনেক নারীর ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক জন্মদান ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
- মা নিজের সুবিধাজনক পজিশনে সন্তান জন্ম দিতে পারে।
- প্রেগন্যান্ট অবস্থায় প্রাকৃতিক জন্মদানের জন্য বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক অনুশীলন মাকে জন্মদানের পরের ধকল কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে, পোস্ট পার্টামের অস্বস্তিভাব ও জটিলতা কমাতে সাহায্য করে।
- এই প্রক্রিয়ায় স্বামী বা/এবং প্রিয়জন পাশে থেকে মানসিক সাহস জোগাতে পারে, পুরো প্রক্রিয়ায় সাহায্য করতে পারে।
- শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক ভাল হয় বলে ধারণা করা হয়।
- শিশুর শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি কমে।
- মা ও শিশুর স্থায়ী ও দীর্ঘকালীন জটিলতা তৈরী হওয়ার ঝুঁকি কম।
অনেক সময় লেবারের অনুপস্থিতি বা বিলম্ব দেখে চিকিৎসক বা অভিজ্ঞরা মা ও সন্তানের শারীরিক পরিস্থিতি নিরুপণ করে থাকেন৷ এর মাধ্যমে বিভিন্ন জটিলতা ও ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয়।
লেবারের বিকল্প কী?
লেবারের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে আমরা সন্তান জন্মদানের বিকল্প প্রক্রিয়াগুলোর একটির আলোচনা করি। সেটা হলো এপিডুরালের বা স্পাইনাল ব্লকের ব্যবহার।
এপিডুরাল
এপিডুরাল সন্তানের ডেলিভারিতে ব্যথা নিরসণের জন্য ব্যবহার করা হয়। সি সেকশনের জন্যও ব্যবহার করা হয়। এপিডুরাল ব্যবহারের ফলে লেবারের দ্বিতীয় ধাপ দীর্ঘ হয়ে যায়৷ এখানে assisted delivery এর প্রয়োজন হতে পারে (শিশুকে বের করে আনার জন্য ফরসেপ বা ভ্যাকুয়ামের ব্যবহার, ব্লাডার ক্যাথেটারাইজেশন, সি সেকশন)।
এপিডুরাল এর সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ
- চুলকানি
- কয়েক ঘন্টার জন্য পা অবশ হয়ে যাওয়া
- মাথাব্যথা
- বমিভাব ও বমি হওয়া
- জ্বর
- পিঠে ব্যথা
- নিম্ন রক্তচাপ
- প্রসাবে জটিলতা
যদিও এরকম নমুনা সহজে দেখা যায়না তবু স্থায়ী কিছু সমস্যা তৈরী হতে পারে৷ যেমন:
- স্নায়ুর স্থায়ী ক্ষত
- পিঠে স্থায়ী ব্যথা
- শ্বাসকষ্ট
- মেনিনজাইটিস
- সেপসিস, এপিডুরাল হেমাটোমা, এপিডুরাল এবসিস ইত্যাদি
সিজারিয়ান সেকশন
সন্তান জন্মদানের আরেকটি বিকল্প সি সেকশন, যেখানে সার্জিকাল প্রক্রিয়ায় পেট ও জরায়ু কেটে শিশুকে বের করে আনা হয়। এ প্রক্রিয়ায় মায়ের রিকভারিতে সময় লাগে। বিভিন্ন রকম শারীরিক জটিলতাও দেখা দিতে পারে।
মায়ের ক্ষেত্রেঃ
- অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
- প্রদাহ বা ইনফেকশন
- ব্লাডারে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া
- মেডিসিন বা এনেস্থিসিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
- ডিপ ভেইন থ্রম্বসিস DVT (যদিও এটি হওয়ার ঝুঁকি কম)
- ভবিষ্যতে প্রেগ্ন্যাসিতে ঝুঁকি
শিশুর ক্ষেত্রেঃ
- শ্বাসকষ্টের সম্ভাবনা
এছাড়াও, শিশুর আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। সচরাচর দেখা না গেলেও এনেস্থিসিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে৷
আমরা কুরআনে সূরা মারইয়ামের দিকে তাকালে খুব সুন্দর দুটি আয়াত দেখতে পাই৷
فَأَجَآءَهَا ٱلْمَخَاضُ إِلَىٰ جِذْعِ ٱلنَّخْلَةِ قَالَتْ يَٰلَيْتَنِى مِتُّ قَبْلَ هَٰذَا وَكُنتُ نَسْيًا مَّنسِيًّا
“তারপর প্রসব-বেদনা তাকে একটি খেজুর গাছের কাছে নিয়ে গেল। সে বলতে লাগল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং সম্পূর্ণ বিস্মৃত-বিলুপ্ত হয়ে যেতাম!”
فَنَادَىٰهَا مِن تَحْتِهَآ أَلَّا تَحْزَنِى قَدْ جَعَلَ رَبُّكِ تَحْتَكِ سَرِيًّا
“তখন তার নিচে এক স্থান থেকে সে তাকে ডাক দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ করো না, তোমার প্রতিপালক তোমার নিচে একটি ঝর্ণা সৃষ্টি করেছেন।”
(সূরা মারইয়াম: ২৩-২৪)
এই আয়াতগুলোতে মারইয়াম (আ) এর লেবার যন্ত্রণার কথা উল্লেখিত হয়েছে এবং এর সান্ত্বনাস্বরুপ কথা এসেছে৷ এই সুন্দর আয়াতগুলো থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছু আছে৷ আল্লহ রব্বুল আলামীন মারইয়াম (আ) এর যন্ত্রণার বর্ণনা দিয়ে নারীদের কষ্টের একটা চিত্র তুলে ধরেছেন৷ এ থেকে বোঝা যায় সন্তান জন্মদানে মা কতটা কষ্ট সহ্য করেন। কুরআনে এর উল্লেখ আমাদের সাহস বাড়িয়ে দেয়, আমাদের মাতৃত্বকে সম্মানিত করে৷ মারইয়াম (আ) এর উদ্দেশ্য করা সান্ত্বনা আমাদের সকল মায়েদের জন্যই সান্ত্বনা ও আশার বাণী হিসেবে কাজ করে, আমাদের শক্তি দেয় সুবহানআল্লহ।
স্বাভাবিক অবস্থায় একজন প্রেগন্যান্ট মায়ের জন্য সবচেয়ে উত্তম জন্মদানের পদ্ধতি হলো প্রাকৃতিকভাবে সন্তান প্রসব। এজন্য যদিওবা মাকে লেবারে তীব্র শারীরিক ও মানসিক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তবু এই আলোচনা থেকে বুঝতে পারি এই কষ্টের ভয়কে কাটিয়ে উঠতে পারলে তা আমাদেরই জয়ী হওয়ার সুখানুভূতি দিবে, অন্যরকম তৃপ্তি দিবে৷ কাজেই আমরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারলাম লেবারের প্রয়োজনীয়তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ৷
তবে হ্যাঁ, বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে মাকে এপিডুরাল দিতে হতে পারে, সি সেকশনের দরকার হতে পারে৷ এবং এসব ক্ষেত্রে কোনোভাবেই প্রাকৃতিক জন্মদান সম্ভব না৷ বরং, প্রাকৃতিক জন্মদান সেসময় মা ও শিশুর জন্য ঝুকিপূর্ণ৷
একজন প্রেগন্যান্ট মায়ের দায়িত্ব প্রেগন্যান্সি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা৷ তাহলে লেবারের প্রয়োজনীয়তা জানা সম্ভব, লেবারের ভয়কে কাবু করা সম্ভব, সুস্থ থেকে প্রাকৃতিকভাবে শিশুর জন্ম দেয়া সম্ভব এবং এও জানা সম্ভব কখোন কোন পরিস্থিতিতে এপিডুরাল বা/এবং সি সেকশনের প্রয়োজন হতে পারে৷ তাহলে মাতৃত্ব হয়ে উঠবে সহজ ও আনন্দময়, ইনশাআল্লাহ।
এই জ্ঞান অর্জনের সংগী হয়ে আপনাদের পাশে আছে মাতৃত্ব। গর্ভবতী মায়ের জন্য আমাদের প্রধান দুটি সেবা
১. অনলাইন প্রিনাটাল কোর্স, যার মূল লক্ষ্য একজন নারীকে গর্ভাবস্থার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জানানো এবং এর মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসি করে তোলা।
২. দৌলা সেবা, যার মাধ্যমে একজন মা’কে প্রেগনেন্সি ও প্রসবের সময় তথ্য/ইনফরমেশন সাপোর্ট দেয়া, মানসিক সাপোর্ট ও শারীরিক সাপোর্ট (অফলাইন দৌলা সেবার ক্ষেত্রে) দেয়া। যাতে হবু বাবা-মা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং তাদের বার্থিং অভিজ্ঞতা যেন অনন্য হয়।
এছাড়াও এই ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত অনেক লেখা, ভিডিও আছে, যা একজন নারী ও তার পরিবারকে পুরো প্রেগনেন্সির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জানতে, বুঝতে সহায়তা করবে।
তথ্যসূত্র
- Stages of Labor – Osmosis from Elsevier [Video]
- Parturition – Pregnancy, Hormones, Giving Birth
- Labor, delivery and postpartum care – Mayo clinic
- Labor 101 – The Society of Obstetricians and Gynaecologists of Canada (SOGC)
- Risks of Epidurals During Delivery – Healthline
- Epidurals – Cleveland Clinic
- Pregnancy and birth: Epidurals and painkillers for labor pain relief – National Library of Medicine
- Natural childbirth: Benefits and risks of unmedicated birth – Baby Center
- What Are the Side Effects of Cesarean Delivery? – MedicineNet
- Risks– Caesarean section – NHS
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সাবরিনা আফরোজ
এমবিবিএস, এমপিএইচ
লেকচারার, ঢাকা কমিউনিটি মেডিসিন কলেজ