প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে মনে হয় সব কিছুতে একটু অন্য রকম আবেগ কাজ করে। আল্লাহ তালার অনুগ্রহে আমার ক্ষেত্রে এমনটাই ছিল।
জামাই এর দেশের বাহিরে থাকার সুবাদে (?!) আমারও চলে আসা হয়। বিদেশে এসে কোপ আপ করতে না করতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লার অশেষ রাহমাতে জানতে পারি আমার ভিতরে আরো একটি প্রাণ। মনে আছে ডিউটিরত নার্সটি এসে আমাকে যখন বলে “Congratulations! You are pregnant!” মূহুরতেই খুব বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। আর আমিও কেঁদেকেটে অস্থির। বিশ্বাস হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল আল্লাহ তা’লা আমাকে চুজ করলেন? এতো সম্মানে সম্মানিত করবেন তিনি আমাকে??
আমার অবস্থা দেখে তখন জামাই আমার কাধে হাত রেখে বলেছিলেন “আমি আছি তো!” যেটা ঐ সময় মনে হয়েছিল পৃথিবীর সেরা স্বস্তিদায়ক একটি কথা।
তারপর শুরু হলো বিদেশ জীবনের কঠিন কিছু সময়। প্রথম ট্রাইমিস্টারটা খুব বেশি কষ্টের গিয়ছিল। প্রথম ট্রাইমিস্টার (অনেকের তো পুরো প্রেগন্যান্সি!) কষ্টকর হয় জেনেছিলাম, কিন্তু তাই বলে এতো কষ্টের? প্রেগ্ন্যান্সিতে অতিরিক্ত যে বমি হওয়া সেটার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। মনে হচ্ছিল আমি ডেলিভারী পর্যন্ত যেতে পারবো তো নাকি তার আগে মারা যাবো? রান্না করার সময় মশলা তো আগেও ব্যাবহার করেছি কিন্তু ঐ দিনগুলোতে মনে হচ্ছিলো যখন হলুদ গুঁড়া রান্নায় ব্যাবহার করছিলাম সেই হলুদ গুঁড়াগুলো বুঝি আমার নাকের ভিতর দিয়ে গিয়ে ব্রেইনে নাচানাচি শুরু করে আর আমি বেচারা পারলে অজ্ঞান হয়ে যাই। কয়েকদিন এমন হত যে আমি কোনোমতে রান্নার সব উপকরণ দিয়ে দৌড়ে বেডরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেই আর জামাই নেড়েচেড়ে ঢাকনা দিয়ে দেয়। খুব মজার না হলে খাওয়ার রূচি আসত না। বমির কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না।
প্রথম ৫ মাসের মত সারাক্ষণ এই বমি ভাব থাকায় এটাকেই সাভাবিক ধরে নিয়েছিলাম। মনে আছে একদিন চেয়ারে বসে রেস্ট নিচ্ছিলাম আর সেকেন্ডের মধ্যে ওয়ার্নিং ছাড়া এতো ফোরসে বমি আসে যে নাস্তানাবুদ অবস্থা। মর্নিং সিকনেস ছিল খুব বেশি। একদিন অবস্থা বেশি খারাপ হওয়াতে এক ডাক্তার ফ্রেন্ড বলেছিল “নেত্তি পট” নাকি কাজে দেয় এমন অবস্থায়। ইউটিউবে এই কঠিন পদ্ধতি দেখে আমার মাথা ঘুরে যায় অবস্থা। পরের দিকে আদা চা খেয়ে কিছুটা উপকার পেয়েছিলাম। তখন খুব মনে হত একজন সঙ্গী থাকত যদি অথবা কোনো মা খালা…
তো শুরু থেকে আমার লক্ষ্য ছিল ন্যাচারাল ডেলিভারীর। এর জন্য কিছু পড়াশুনা শুরু করে দেই। যতটুকু পারতাম শরীরে যতটুকু কুলাতো প্রেগন্যান্সি ব্যায়াম করার চেষ্টা করতাম। তবে ১২-১৩ সপ্তাহের আল্ট্রাসাউন্ডে আমাকে বলেছিল আমার প্লাসেন্টা নাকি একটু নিচে—প্লাসেন্টা পারভিয়া বলে যেটাকে। এটা জানার পর আমার ব্যায়াম করা অনেকটা কমে গিয়েছিল। কারণ প্লাসেন্টা পারভিয়া যদি পুরো প্রেগন্যান্সিতে কন্টিনিউ করে তাহলে রেগুলার অনেক কিছু করা রিস্কি হবে। তারপর মহান আল্লাহ তা’লার অশেষ রাহমাতে ২০ সপ্তাহের আল্ট্রাসাউন্ডে জানতে পারলাম আমার প্লাসেন্টা তখন নরমাল অবস্থায়। আলহামদুলিল্লাহ!
আমি যেহেতু প্রথম তিন চার মাসে কিছু খেতে পারিনি, তাই পানি কম খাওয়ার কারণে (চেষ্টা করতাম খুব কিন্তু বমি হয়ে যেত) তাই ইউরিন ইনফেকশণ হয়ে গিয়ছিল। তারপর ২ইয় ট্রাইমিস্টারে যখন খাওয়ার রূচি এসছিল তখন উপকারী খাবারগুলো খুব করে খাওয়ার চেষ্টা করতাম। অতিরিক্ত খাবার খাওয়া ছিল আমার অপছন্দের আর পুষ্টিগত খাবার ডায়েটে রাখা ছিল আমার পছন্দের তালিকায়। এক বেলা ভালো বা রীচ খাবার খেলে পরের বেলা একটু কম খাওয়ার চেষ্টা করতাম। তো প্রথম ট্রাইমিস্টারে একদম না খেতে পারা আমি যখন ২ইয় ট্রাইমিস্টারে এসে দেখি যে আরে আমি তো এখন খেতে পারি! খেতে পারাটাও যে মহান আল্লাহর অশেষ রাহমাত খুব করে উপলব্ধি করেছিলাম তখন।
তো ২য় ট্রাইমিস্টারে খুব করে খাওয়াদাওয়া শুরু করে দেই। বিদেশ জীবনে টানা ৫ মাসের মত চিকেন দেখলেই বিরক্ত হওয়া আমি এখন নিজের জন্য নিজে খুব ভাল মত রান্নাবান্না শুরু করি। আমার মাথায় ঘুরত যে এখন ঠিক মত না খেলে যদি আমার ক্যালসিয়াম শরটেজ দেখা দেয় পরে? তাই জন্য ব্যালেন্সড ডায়েট রাখার চেষ্টা করতাম। তবে খুব দূরবল ছিলাম পুরো প্রেগন্যান্সি তে। একটু কাজ করলে দুনিয়ার সব ক্লান্তি যেন জাপটে ধরত। ২৬-২৭ সপ্তাহের সময় ব্যায়াম করার সময় একবার মারাত্মক ব্যথায় কুকিয়ে গেলে পরে ভয়ে আর ব্যায়াম করা হয়নি।
৩৪ সপ্তাহ থেকে রোযা শুরু হয়। রোযা না থাকার সিদ্ধান্ত নেই। পুরো রোযার মাসটা মাসজিদে গিয়েছিলাম ইফতারীর সময়। যদিও ক্লান্তি আর দুর্বলতায় বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম (মনে আছে যে আবায়াটা গায়ে দেওয়ার শক্তি পেতাম না) তাও জামাই এর জোরাজুরি তে মাসজিদে কন্টিনিউ করেছিলাম পুরো মাস। তারাবীর নামায পরে তারপর বাসায় ফিরতাম। নামাযের ব্রেকে পানি খেতাম ভাবতাম আজকে বুঝি পারব না শেষ পর্যন্ত থাকতে কিন্তু এমনটা কোনোদিন হয়নি।
শেষ সময়টাতে মাসজিদে রেগুলার যাওয়া আর সবাইকে রোযার মাসে এক আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকতে দেখা যেন আমার শত ক্লান্তিতেও ভালো লাগা এনে দিত! আমি এমনিতে খুব পজিটিভ থাকার চেষ্টা করতাম। তার উপর কেউ যদি এসে সুন্দর একটা কথা বলত তাহলে যেন হৃদয় ছুঁয়ে যেত! আসলে পরিবার থেকে দূরে থাকাটা তাকদীরে ছিল তো তাই জন্য হয়ত আল্লাহ তালা তার অন্য বান্দাদের মাঝে মনে শান্তি এনে দিত। সেটা পরে উপলব্ধিকরেছিলাম। একদিন ৩৫-৩৬ সপ্তাহের দিকে মাসজিদের একজন সিস্টার আমার পেট দেখে বলেছিল “Enjoy your time, you cannot get pregnant everyday!” ছট্টো ২ মেয়ের জননীর এই কথাটা কেন যেন অনেক ভালো লেগেছিল। বিশাল পেট নিয়ে মাসজিদে বোনদের মাঝে এরকম প্রচুর ভালবাসা পেয়েছিলাম।
৩৬ সপ্তাহের পর আর তর সইছিল না। মনে হচ্ছিল এই দীর্ঘ সমকে আল্লাহ সহজ সংক্ষিপ্ত করে দিন। যেহেতু আমার প্রথম প্রেগন্যান্সি ছিল আমার এটা ধারণা ছিল না যে ৪০ সপ্তাহের বেশ আগে ডেলিভারী হতে পারে। হ্যা এটা তো জানতাম যে, যে কোনো সময় বাবু চলে আসতে পারে। আমি কিছু প্ল্যান করে রেখেছিলাম যে বাসাটা পরিষ্কার করতে হবে, লণ্ড্রী করতে হবে, যেহেতু মহান আল্লাহর অশেষ রাহমাতে নতুন সদস্য আসবে বাসায় তাই সুন্দর বিছানার চাদর বিছিয়ে দিতে হবে… । বিদেশ জীবনের নিজের কাজ নিজে করতে পারাকে আমি মহান আল্লাহ তালার অজস্র নিয়ামাতের একটি–এই হিসেবে দেখেছি। যা আমার ধারণা আমাকে অ্যাক্টিভ থাকতে সাহায্য করেছিলো। আমার ঈদের দিনে ডক্টর অ্যাপ্যেন্টমেন্ট ছিল। সব ঠিক ঠাকই ছিল শুধু ওজন একটু কমে গিয়েছিল। পরে খাবার দাবারে আরো একটু নজর দিলে সেটা নরমালে এসছিল আলহামদুলিল্লাহ।
সেদিন ছিল ৩৭ সপ্তাহ ৬ দিন। ঈদের তৃতীয় দিন। রাতে ঘুম আসছিল না দেখে আমি সাভাবিক কাজ করে যাচ্ছিলাম। ঘুমাতে ঘুমাতে ২-৩ টা বেজে গিয়েছিল। শরীরে শক্তি ছিল না যদিও কি মনে করে যেন রাত ২ টায় সব্জি রান্না করলাম। ভাবলাম এখন একটু এনার্জি আছে রেঁধে ফেলি পরে যদি না থাকে? পরের দিন অর্থাৎ ৩৮ সপ্তাহের দিন সকালে সাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে গেলাম, দেশে আম্মুর সাথে কথা বললাম। এদিকে ধৈরযের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছিল। ঐ দিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় জামাই বাসায় ছিল। বাসায় কিছু বোর্ডগেইম ছিল। তো আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে বোরডগেইম নিয়ে বসেছিলাম। অসম্ভব কষ্টে এক সময় আমি জামাইকে বলেছিলাম “এতো কষ্ট! মনে হচ্ছে আল্লাহ কি নেই? (নাউযুবিল্লাহ!) আর এটাই তো শয়তানের মেইন গোল (ঈমানহারা করা”। তার কিছুক্ষণ পরেই চেয়ারে বসতে গিয়ে মনে হল ওয়াশরূমে যেতে হবে, পানি ভাঙ্গতে পারে তখনো এমন কিছু ধারণা করিনি। (ঘটনাটা মনে পড়লে কুরআনের ঐ আয়াতটা মনে পড়ে- “নিশ্চই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে”।
তো পানি ভাঙ্গা বলতে আমি ভেবেছিলাম অনেক পানি একসাথে বের হয়ে আসবে। যাই হোক, ওয়াশরুমে গিয়ে দেখি গলগল করে আধা কাপের মত পানি বেরিয়ে এল। ভয় পেয়ে গেলাম। এদিকে ঐ মূহুরতে আবার কোনো ব্যাথা ছিল না। জামাইকে জানালে হাসাপাতালে কল দিলেন উনি। ডিউটিরত নার্স হাসপাতালে আসতে বলল। রেডী হয়ে চললাম ২ জনই হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। রিসিপশনে কথা বলে আমাদের চারতোলায় যেতে বলল। আমার হুইলচেয়ার লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করলে না করে দেই। যেহেতু আমি হেঁটে যেতে সক্ষম ছিলাম আর অ্যাকটিভ থাকা ছিল আমার উদ্দেশ্য। তারপর রূমে গিয়ে কিছুক্ষণ ওয়েট করার পর ওরা জানাল একটা পরীক্ষা করা হবে যে এটা আসলেই পানি ভাঙ্গা কিনা। বেশ কিছুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম আর এদিকে আমার পুরো প্রেগন্যান্সিতে এতো ধকল গিয়েছিল যে ঐ সময় মনে হচ্ছিল যেহেতু কোনো ব্যাথাটেথা নেই আমাদের বুঝি ফিরে যেতে হবে। তারপর আমাদের অবাক করে দিয়ে নার্স জানাল আমার সত্যিই পানি ভেঙ্গেছে অর্থাৎ আমার লেবার শুরু হয়ে গিয়েছে।
বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা নামল তখন ঘন্টায় আমার এক দুইবার একটু করে ব্যাথা আসা শুরু হল। জামাই একটু বাসায় গিয়েছিল তখন। আমি লণ্ড্রী সহ আরো কিছু কাজ করে রাখতে বললাম। আগের দিনের রেঁধে রাখা সব্জি দিয়ে আর ডিম ভাজি করে নিয়ে উনি ও ডিনার সেরে নিলেন। তারপর ব্যাথাটা একটু তীব্র হওয়ায় ফোন দিয়ে চলে আসতে বললাম তাড়াতাড়ি। প্রায় ৮ টার সময় উনি চলে আসলেন। একসময় ডাক্তার এসে সব কিছু চেক করল, আমার সাথে কথা বলল- ন্যাচারাল ডেলিভারী করাতে চাই এর জন্য সাইন নিল। তো জানাল যে সবে মাত্র ৮ টা বাজে আগামীকাল সকাল ৮ টার আগে নেক্সট স্টেপের আর কোনো চান্স নেই বললেই চলে।
তো জামাই আর আমি আছি রূমের ভিতর। ফিম্যাল অনলি রূম নিয়েছিলাম (যেটা বিদেশে খুব কমন জিনিস না)। নার্স একবার এসে পেইন ম্যানেজমেন্টের জন্য বাথ টাবে সহনীয় পর্যায় এর গরম পানি দিয়েছিল। যেটাতে খানিক সময়ের জন্য আরাম পেয়েছিলাম।
মাত্র রাত ১০ টা থেকে স্ট্রং ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। আমাকে ডাক্তার বলে গেলেন আগামীকাল ৮ টার আগে কিছু ঘটার চান্স নেই। আমি সেটা ভেবে আর ব্যাথার তিব্রতায় যেন হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম যে আমার বোধ হয় আর ন্যাচারাল ডেলিভারি সম্ভব না। তবুও শেষ পর্যন্ত যা কিছু পড়াশোনা করেছি অ্যাাপ্লাই করতে লাগলাম। ব্রিদিং টেকনিক ফলো করে গিয়েছিলাম। ( ইন ফ্যাক্ট ঐ যে শুরু হল ব্রিদিং এক্সারসাইজ- এখনো কন্টিনিউ করছি)। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি ছিল না একটুও কিন্তু গ্র্যাভিটির জন্য এই অবস্থায় দাড়িয়ে থাকা বেস্ট অপশন। চেশটা করে গিয়েছিলাম দাড়িয়ে থাকার। ব্যাথার চোটে “আমাকে বার্থ বলটা দাও” কথাটা বলার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু কোনো মতেই পারছিলাম না। শুধু বল বলে ইশারা করলে নার্স এনে দিয়েছিল (হেহে)।
বার্থ বল এ স্কোয়াট করেছিলাম শেষ শক্তি টুকু দিয়ে। সব কিছুতে জামাই আমার হাত ধরে ছিলেন। আল্লাহ তালা উত্তম প্রিতিদান দিন। এতো কিছুর পরও মাত্র ১২ টার মত বাজল। এক পরযায়ে বমি হচ্ছিল। শরীর খুব কাপছিল। আমি তো এপিডুরাল নিব না সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কিন্তু জানিয়ে দিলাম তখন আমি এপিডুরাল নিতে চাই। কিন্তু আমাকে নার্সরা-ই কনভিন্স করার চেষ্টা করছিলেন অনবরত যে আমি পারব এপিডুরাল ছাড়াই। কিন্তু যে অবস্থা আমি তহন নাছোড়বান্দার মতো জানালাম আমি এপিডুরাল নিবই নিব। তখন রাত প্রায় ২. ৩০ টায় একদম পরিপাটি হয়ে লম্বা চুলের একজন এনেস্থেশিয়া দিতে চলে আসল। উনাকে জানিয়ে রাখা হয়েছিল কিনতু লেবার ত এতো তাড়াতাড়ি প্রোগ্রেস করে না তাই উনি ছিলেন না শুরুতে।
তারপর ৩ টার মত বাজে। এনেস্থেটিক ডাক্তারও বেশ কয়েকবার বললেন আর একটু দেখতে। তারপর জোরাজুরিতে উনি বললেন আচ্ছা ঠিক আছে আমাকে দেওয়া হবে এপিডুরাল। তখন একজন সারভিক্স চেক করার সিদ্ধান্ত নিল। ওহ, সুবহানাল্লাহ সবাইকে অবাক করে দিয়ে নার্স জানালেন সারভিক্স ৮ সেমি ডায়ালেটড! তার মানে বাবু খুব কাছে চলে এসছে। এখন পুশিং স্টেইজ!
প্রায় ৪ টা থেকে শুরু হল পুশিং স্টেইজ এপিডুরাল ছাড়া। আনফরচুলেন্টলি আমি আর দাড়িয়ে থাকতে পারিনি। মোট ৭-৮ জনের মত নারস, আমার ডাক্তার, এনেস্তগেটিক ডাক্তার সবাই ছিলেন আমাকে পুশিং এ গাইড করতে। ১-১০ পরযন্ত একজন গুনছেন আর একজন পুশ, পুশ, পুশ বলে চলেছেন। বেশ কয়েকবার এই পদ্ধতি ফলো করা হল। ওই ঢেউ এর মত ব্যাথা গুলোর সাথে আর পারছিলাম না। দুয়া তো করছিলাম শুধু শুরু থেকে সবটা সময় যতটা পেরেছি।একবার একজন পানি খাইয়ে দিল। একজন চুল বেধে দেওয়ার চেষ্টা করল। একবার একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে পুশিং এর জন্য একটা কাপড়কে রশির মত বানিয়ে আমার হাতে এক প্রান্ত আর এক প্রান্ত যিনি পুশ পুশ বলিছিল পা এর কাছে উনি ধরে রেখে ১০ সেকেন্ড করে পুশ করলাম বেশ কয়েক বার। আর এক বার আমাকে মোটিভেশন দিতে একজন বিশাল সাইযের আয়না নিয়ে আমাকে আয়নাতে দেখাচ্ছিল যে এই যে তোমার বাবু! কিন্তু আমার তো প্রান যায় অবস্থা। আয়নাতে এহেন রক্তাক্ত অবস্থা দেখে ভড়কে গিয়ে বলেছিলাম না আমি দেখতে চাই না!
এভাবে অনেক সময় পার হল। তারপর তারপর এক সময় মনে হল নিজে থেকে— হ্যাঁ আমি এখন চাই পুশ করতে, জামাই বললেন তুমি বল বিসমিল্লাহ, বল বিসমিল্লাহ- এরপর আল্লাহ তায়ালার অশেষ রাহমাতে তে ভোর ৫.২৮ মিনিটে কান্না সহ চলে আসে দুনিয়াতে আমার প্রথম সন্তান। আলহামদুলিল্লাহ!
ন্যাচারাল ডেলিভারী হলেও মা হওয়ার চিহ্ন কিছু থাকেই। ডেলিভারীর পরেও নিজের যত্ন নেওয়া খুব জরুরি। কীভাবে যত্ন নিবেন তার বিস্তারিত এখানে পাবেন।
শেষের দিকে দাড়িয়ে থাকতে পারলে হয়ত পুশিং স্টেইজ টা একটু সংক্ষিপ্ত করা যেত সাথে অসম্ভব বাজে টিয়ারিং। যেটার জন্য পরবর্তীতে ইউরিন/বায়ু ধরে রাখার ক্ষমতা কমে গিয়েছিল। যেটা অবশ্যই ক্যাগেল এক্সারসাইজের মাধ্যমে কমিয়ে আনতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ।
আমার প্রথম পেগন্যান্সির শুরু থেকে সব কিছু যে খুব অনুকূলে ছিল তা বলব না। এমনকি আমাদের দুজনের মাঝে তৈরি হয়ছিল মানসিক দূরত্ব। তবে হ্যা আমার ফোকাস সবসময় পজিটিভ দিকে ছিল। আমি নিজের দিকে খেয়াল রাখতাম যে আমি নিজের পার্টটা ঠিকঠাক পালন করছি কিনা।
একটু চিন্তা করলে নিয়ামাতগুলোকে উপলব্ধি করা সম্ভব। সাইকলজিক্যালি আমি এবং আমরা ভাল থাকলে আমার বাচ্চার উপর সেটার প্রভাব পড়বে। আর দুয়ার ত কোনো বিকল্প নেই, চেষ্টা করে যাব আর দুয়া করব। দুয়া করা হল ইবাদাত এবং মুমিনের অন্যতম অস্ত্র। আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ছাড়া কিছু সম্ভব হয় না। দুয়া চাইলে উনি ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। নিশ্চই আল্লাহর সাহায্য খুব কাছে।
গল্পটা যারা পড়ছেন তারা আমার সন্তানের জন্য দুয়া করবেন। আল্লাহ তালা তাকে, আমাকে এবং আমার পুরো পরিবারবর্গকে দুনিয়া এবং আখিরাতে সফলকামী মাঝে, নিয়ামাতের শুকরিয়া আদায়কারীর মাঝে, ইহসানকারী এবং দানকারীদের মাঝে কবুল করে নিন।
লিখেছেন: উম্ম মুস’আব