গর্ভধারনের এই সপ্তাহে এসে মায়ের শরীরের শারিরীক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটেই চলেছে। প্রথম ট্রাইমিস্টার প্রায় শেষের দিকে। একাদশ সপ্তাহ মানে আপনি ইতিমধ্যে দুই মাস এবং দুই সপ্তাহের প্রেগন্যান্ট। যদিও আপনাকে দেখে প্রেগন্যান্ট মনে হচ্ছে না এখনো, কিন্তু আপনি মনে মনে আপনার ভাবী সন্তানের কথা ভাবা শুরু করে দিয়েছেন। মায়ের সাথে সন্তানের বন্ধনের ভিত গড়ে উঠে, গর্ভধারন শুরু থেকেই।
আপনার শরীরে যে পরিবর্তন আসবে
যাদের শুরু থেকে বমিভাব প্রবল থাকে, সাধারনত প্রথম ট্রাইমিস্টার শেষ হলে, এই সমস্যা চলে যায়। তবে অনেকের প্রেগন্যান্সীর পুরোটা সময় জুড়ে এই অবস্থা থাকতে পারে। এই সময়ে যে পরিবর্তনগুলো স্বাভাবিক-
- ক্লান্তিঃ সবসময় ভীষন ক্লান্ত লাগতে পারে। কোন পরিশ্রমের কাজ করা ছাড়াও ক্লান্তি ঘরে থাকতে পারে। এরকম অবসাদ খুবই স্বাভাবিক। প্রয়োজনে কিছু বেশী সময় বিশ্রাম নিন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে জিরিয়ে নিন। এইসময়টাতে প্লাসেন্টাও গঠন হয়,যা প্রসব পর্যন্ত বাচ্চার সংগী। এই গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেও ক্লান্তি একটু বেড়ে যায়।
- পায়ে গিট লাগা (Leg cramp): শুয়ে কিংবা বসে আছেন, হঠাত করে পায়ের পিছনের মাংশপেশী টানটান করে উঠলো। রাতে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে খেয়াল করলেন, পা আর নাড়াতে পারছেন না সহজে। লেগ ক্রাম্প এড়াতে প্রচুর পানি খান। এরকম হলে উঠে দাঁড়িয়ে পা ঝাড়া দিয়ে নাড়াচাড়া করুন।
- গ্যাসঃ অল্প খাবার খেলেই পেটে প্রচুর গ্যাস হতে পারে এইসময়। কেন অতিরিক্ত গ্যাস হয়? প্রোজেস্টেরন হরমোনের প্রভাবে এই সময় পরিপাকতন্ত্রের মাংসপেশী শিথিল হয়ে যায় যেন খাবার বেশিক্ষণ পেটে থাকতে পারে এবং রক্তের মাধ্যমে বাচ্চার কাছে পৌছানোর সময় পায়। এরকম গ্যাস একে তো অস্বস্তিকর আবার বুকে চাপ ধরে থাকতে পারে।
- মুড সুয়িংঃ প্রেগন্যান্সির আগাগোড়াতে মুড সুয়িং স্বাভাবিক। সব কিছু অসহ্য লাগতে পারে। আবার ছোটখাট স্বাভাবিক ঘটনাতে আবেগ সামলানো মুশকিল হতে পারে।
- ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জঃ প্রেগন্যান্সিতে অন্য সময়ের চাইতে হোয়াইট ডিসচার্জ বেশী হতে পারে। সাথে চুলকানি থাকতে পারে। ব্যকটেরিয়াল বা ইস্ট ইনফেকশ হওয়াও অসম্ভব না।
- কালচে চামড়াঃ পেটা, ঘাড়ে, কনুই এর চামড়ায় কালচে ভাব আসতে পারে। অনেকেরই তলপেটের মাঝ বরাবর কালো দাগ দেখা দেয়। একে লিনিয়া নায়েগ্রা (linea nigra)বলে। এর সাথে ছেলে/মেয়ে বাচ্চা হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। এটা ক্ষনস্থায়ী। ডেলিভারীর পর সাধারনত চলে যায়।
বাচ্চার ডেভেলপমেন্ট
১১ সপ্তাহে ভ্রুনটি খুবই ক্ষুদ্র এখনো। কিন্তু এখনি সে পেটের ভেতর বেশ নড়াচড়া করে। কিন্তু যেহেতু আকারে খুবই ছোট, মা বাইরে থেকে এই নাড়াচাড়া টের পান না। এই সময় ভ্রুনের চামড়া এতই পাতলা, যে বাইরে থেকে দেখতে পুরো স্বচ্ছ দেখায়। সাধারনত এই সময় আল্ট্রাসাউন্ড করা হলে, বাচ্চার ঘাড়ের পরিমাপ থেকে কোন ক্রোমোজোমাল এবনরমালিটি আছে কিনা বুঝা যায়।
এই সময় বাচ্চার মাথাই গোটা শরীরের মধ্যে আকারে বেশ বড়। মুখের গঠন বেশ স্পষ্ট। চোখের পাতা এখনো বন্ধ। শিঘ্রই চোখের পাতা খুলতে বন্ধ করতে পারবে। এই সময়ে ভ্রুনের সাইজ ছোট্ট একটা ডুমুরের সমান।
এই সপ্তাহে আপনার জন্য টিপস
- ঢিলেঢালা আরামদায়ক ম্যাটারনিটি পোশাক পরুন। বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর পরিকল্পনায় ম্যাটারনিটি ব্রা কিনে রাখুন। এখন থেকে পড়লে প্রেগন্যান্সিতে স্তনের যে পরিবর্তন আসে, তাতে আরাম পাবেন।
- গ্যাসের উদ্রেককারী খাবার কম খান। ডাল, বাঁধাকপি, তেলে ভাজা- এই জাতীয় খাবার কম খান।
- হালকা এক্সারসাইজ, যোগ ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- লেগ ক্রাম্প এড়ানোর জন্য খাদ্যতালিকায় পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম জাতীয় খাবার নিশ্চিত করুন। খেতে পারেন বাদাম, যা থেকে পেতে পারেন ভিটামিন ই সাথে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম,সেলেনিয়াম,ক্যালসিয়াম। এছাড়াও খাবারে রাখুন ভিটামিন সি। এইসময় দাঁতের সুরক্ষা খুব প্রয়োজনীয় কিন্তু অবহেলিত একটি প্রসংগ। মাড়ির, দাঁতের ইনফেকশন এড়াতে দুইবেলা ব্রাশ এবং খাবার পর ফ্লসিং খুবই জরুরি।
- মেজাজের তারতম্য (Mood Swing) এড়াতে মানসিক চাপমুক্ত পরিবেশে থাকুন।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন। প্রস্রাবের সংক্রমন (Urine Infection) এড়াতে প্রচুর পানি খান। বাইরে গেলে ব্যাগে হালকা স্ন্যাক্স আর পানি রাখুন সাথে।
- নিজেকে সবসময় বাসায় আটকে না রেখে, এদিক সেদিক ঘুরতে যেতে পারেন। এতে মন মেজাজ ভালো থাকে। তবে রিকশায় অতিরিক্ত ঝাঁকি এড়িয়ে চলুন।
- স্ট্রেচমার্ক দূর করার জন্য নিয়মিত স্কিন ত্বক অার্দ্র (Moisture) রাখুন। অলিভ ওয়েল বা বায়োওয়েল লাগাতে পারেন।
জমজ বাচ্চার ক্ষেত্রে ওজন বাড়বে। এবং ক্ষেত্রবিশেষে অন্য পরিবর্তনগুলোও প্রকট হবে। প্রথম ট্রাইমিস্টারের শেষ দিকে গর্ভপাত (Miscarriage) সম্ভাবনাও কমে যায়। চিন্তামুক্ত থাকুন। হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করুন।
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ মাশরুরা মাহজাবিন
MBBS
General Practioner, Trained Mental health counselor