দেহের ভেতর আরেকটি দেহের অস্তিত্ব টের পাওয়ার পর থেকে একজন নারীর জীবন যেন হুট করেই বদলে যায়। একদিকে যেমন তাকে ঘিরে প্রচন্ড উত্তজনা, অন্য দিকে ভীষণ দুশ্চিন্তাও কাজ করে। কারণ একটু অসাবধানতা, একটু অনিয়ম গর্ভের মানুষটার বিরাট ক্ষতি করে ফেলতে পারে।
তাই এ সময়ে ভীষণ সতর্ক থাকতে হয়। সেইসাথে অনাগত সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য নিজের ডায়েট বা খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে সচেতন হতে হয়। প্রেগন্যান্সি ডায়েট বলতে আমাদের দেশে অনেকেই বুঝেন আগের তুলনায় বাড়তি খাওয়া, দুজনের খাবার খাওয়া। কিন্তু শুধু বাড়তি খেলেই হবে না, পুষ্টিকর খাবার হতে হবে। প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আরেকটি লেখায় আলোচনা করা হয়েছিল, দেখতে পারেন।
তবে শুধু পুষ্টিকর খেলেই যে কাজ শেষ তা কিন্তু না, এক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মেনে চলাও খুবই জরুরি। কঠিন কিছু না, নিচের পয়েন্ট গুলো একটু পড়েই দেখুন।
১. খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে ধীরে
পুরো প্রেগন্যান্সির সময়টাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়- প্রথম ট্রাইমেস্টার (প্রথম তিন মাস), দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার (মাঝের তিন মাস) ও তৃতীয় ট্রাইমেস্টার (শেষ তিন মাস)। বলাই বাহুল্য, প্রথম দিকে পরিমাণে বেশি না খেলেও চলবে, তবে ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে যাতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে যথাক্রমে প্রায় ৩০০ ও ৪৫০ কিলোক্যালোরি অতিরিক্ত খেতে হবে। তবে আপনার গর্ভধারণের সময় আপনার ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকলে এর থেকে কম পরিমাণে খেতে হবে ।
একজন স্বাভাবিক ওজনের নারীর ক্ষেত্রে প্রেগন্যান্সির প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত প্রায় ১ কেজি করে আর পরের মাস গুলোয় প্রায় ২ কেজি করে বাড়ার কথা। এই হারের থেকে কম বেশি হলে খাবারের অনুপাত সেভাবে ঠিক করে নিতে হবে।
সঠিক পরিমাপের ক্যালোরি
আমরা সবচেয়ে বেশি ক্যালোরি বা শক্তি পাই মূলত কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার থেকে, যেমন- ভাত, রুটি ইত্যাদি। আধ কাপ ভাত বা একটি মাঝারি রুটি থেকে আসে প্রায় ৭০ কিলোক্যালোরি। প্রোটিন ও ফ্যাট থেকেও ভালোই ক্যালোরি আসতে পারে। যেমন, দুধ ও ডিম প্রধানত প্রোটিন জাতীয় খাবার হলেও এ থেকে ভালো পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়, প্রতি পরিবেশনে যথাক্রমে প্রায় ১৫০ ও ১০০ কিলোক্যালোরি।
ফলমূল থেকে আগত শক্তি নির্ভর করে মিষ্টতার উপর, তাও মোটামুটি এক পরিবেশনে ৪০ কিলোক্যালোরি ধরা হয়। কলা, আম ইত্যাদির ক্ষেত্রে অর্ধেককেই এক পরিবেশন বলা হয়। শাকসবজি রান্না করলে আধ কাপ থেকে ৩০ কিলোক্যালোরি আসে প্রায়। মাছ, মাংসও চর্বিহীন হলে প্রায় এমনই শক্তি দেয়। তবে যেটা নিয়ে আমরা খুব একটা মাথা ঘামাই না কিন্তু খেতেই হয়, তা হলো তেল। এক চা চামচ তেল থেকেই ৪৫ কিলোক্যালোরি আসে, কিন্তু টের পাওয়াই যায় না। এই ভাবে হিসাব করে একটু একটু করে ক্যালোরি বাড়াতে পারেন।
উচ্চ-মানের প্রোটিন
সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় একজন মায়ের শরীরে প্রেগন্যান্সি এর সময় রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায়, কারণ ডেলিভারি দিতে গিয়ে যে প্রচুর রক্তপাত হবে। এই রক্ত তৈরিতে এবং একই সাথে গর্ভের সন্তানের বৃদ্ধির জন্যও প্রোটিন খুব জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী ,প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে যথাক্রমে প্রায় ১, ৯ ও ৩১ গ্রাম করে অতিরিক্ত প্রোটিন দরকার হয় প্রতিদিন। এর জন্য মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি প্রাণিজ খাবারকে বলা হয় উচ্চ-মানের প্রোটিন। অবশ্য এর পাশাপাশি ডাল, শিম, বাদাম ইত্যাদি উদ্ভিজ্জ প্রোটিনও খেতে হবে।
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট
এটি বলতে বোঝায় যায় বিশেষ কিছু ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার যা শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও ব্রেইনের সুষম গঠনে সাহায্য করবে। এর উৎস হলো অলিভ অয়েল, বাদাম, বিভিন্ন বীজ, দুধ ইত্যাদি। বিশেষ করে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড গর্ভের শেষের তিন মাস শিশুর জন্য খুব বেশি জরুরি। তাই এ সময়ে এর উৎস যেমন, ডিম ও সামুদ্রিক মাছ বেশি খাওয়া উচিত।
২. খেতে হবে পাঁচ ধরণের খাবার
এই নিয়ম আসলে সব মানুষের জন্যই প্রযোজ্য, তবে প্রেগন্যান্সিতে এই নিয়মটি একটু কড়াকড়ি ভাবেই মানতে হবে। তাছাড়া স্বাভাবিক নারীর থেকে এ সময়ে প্রতিদিনের পরিবেশন সংখ্যা একটু আলাদা। ছবিটিতেই দেখুন।
কার্বোহাইড্রেটকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে, তিন বেলা খাবারের সাথে দুটি হালকা নাস্তা। প্রতি বেলায় কি পরিমাণ খাবেন, তা অবশ্যই আপনার ওজন ও কত মাসে অবস্থান করছেন তার উপর নির্ভর করবে। খিদা না পেলে নাস্তার পাটটা বাদও দিতে পারেন। নাস্তায় জাঙ্ক ফুড, ভাজাপোড়া বা অত্যধিক মিষ্টি খাবার আবার রাখবেন না।
প্রোটিন তো সাধারণত ভাতের সাথেই রাখা হয়। তবে দুধ জাতীয় খাবার আলাদা হলেই ভালো। নাস্তার সময়ে দুধের জিনিস আর কিছুটা বাদাম রাখতে পারেন। শাক-সবজি তিনবেলা আর ফলমূল দুই বেলা রাখা হয়েছে। কখন কোনটা খাবেন সেটা আপনার ইচ্ছা, তবে এই দুইয়ে মিলে যেন মোট ৫ পরিবেশন বা ৪০০ গ্রাম হয়।
নীচে একদিনের একটি স্যম্পল মেনু দেয়া হয়েছে, দেখতে পারেন। এটি যার দৈনিক চাহিদা ২৫০০ কিলোক্যালরি, তার জন্য। আপনার চাহিদা অনুযায়ী খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে কমিয়ে নিবেন।
৩. যখন যেটা বেশি জরুরি
যদি উপরে উল্লেখিত খাবারের পরিমাণ গুলো ঠিক ঠিক নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে ভিটামিন ও মিনারেলের চাহিদা গুলো পূরণ করা সম্ভব হবে। এই পরিবেশনগুলো সব কিছু মাথায় রেখেই হিসেব করে বের করা, তাই কোন ভিটামিন কতটুকু লাগবে, কোন খাবার কতটুকু মিনারেল দিবে এত সব তথ্য মনে রাখতে হবে না। তবে যেহেতু প্রেগন্যান্সি এর একেক মাসে আপনার শরীরের একেক রকম পরিবর্তন হয় আর গর্ভের সন্তানের একেক রকম চাহিদা থাকে, তাই কোন মাসে কোন খাদ্য উপাদানটি বেশি জরুরি তা জেনে নেয়া প্রয়োজন যাতে কোন ভাবেই এর ঘাটতি না হয়।
প্রথম মাস:
এ মাসে ফলিক এসিড বা ফলেট বাচ্চার স্নায়ুতন্ত্রের জন্য খুব খুব জরুরি। তবে অনেকেই টের পান না এত জলদি। তাই সন্তান গ্রহণে ইচ্ছুক নারীর সব সময়ই ফলেট সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- সবুজ শাক সবজি, ডাল, বাদাম ইত্যাদি খাওয়া উচিত।
দ্বিতীয় মাস:
এ সময়ে মিসকারেজ ঠেকাতে ভিটামিন-ই জরুরি। এর জন্য বাদাম, ডিমের কুসুম, অলিভ অয়েল, বিভিন্ন বীজ ইত্যাদি খাওয়া দরকার প্রতিদিন।
তৃতীয় মাস:
এ সময়ে ডিহাইড্রেশন এর আশংকা থাকায় প্রচুর পানি পান করা দরকার, সেইসাথে ফলমূল ও সবজি। বমি ভাব থাকলে আদা কুচি খেতে পারেন।
চতুর্থ মাস:
এই মাস থেকে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরিপূর্ণ রূপে বৃদ্ধি পায় ও রক্ত তৈরি হতে থাকে। তাই এর পর থেকে রোজ উচ্চ-মানের প্রোটিন ও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া একদম বাধ্যতামূলক। কেউ নিরামিষাশী হলে উদ্ভিজ্জ উৎস গুলোই বেশি খাবেন।
পঞ্চম মাস:
যেহেতু এ সময়ে শিশুর হাড়, দাঁত, হার্ট, স্নায়ু ও মাংসপেশি সুগঠিত হতে থাকে, তাই এখন থেকে ক্যালসিয়াম খুব জরুরি।
ষষ্ঠ ও সপ্তম মাস:
সুষম খাবার খেতে হবে, প্রোটিন ও শাক-সবজি কোনভাবেই বাদ দেয়া যাবে না। তবে কোষ্ঠকাঠিন্য হলে শাকের পরিমান কমিয়ে দিতে হবে, পানি বেশি খেতে হবে।
অষ্টম মাস:
এ সময়ে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড জরুরি, যেমনটা আগেই বলেছি।
নবম মাস:
রসুন প্রিম্যাচিউর ডেলিভারির ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। এ সময়ে খেজুর খেলে নরমাল ডেলিভারি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
এ ছাড়া পুরো গর্ভাবস্থায়ই খুব জরুরি কিছু পুষ্টি উপাদান হল-
- ভিটামিন এ ও ক্যারটিনইডস: টিস্যু বৃদ্ধি, ইমিউনিটি, দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি ইত্যাদি।
- ভিটামিন বি কমপ্লেক্স: শক্তি তৈরি, রক্ত ও স্নায়ু গঠন ইত্যাদি
- ভিটামিন সি: ইমিউনিটি, রক্ত ও হাড় গঠন ইত্যাদি
- ভিটামিন কে: প্রোটিন, হাড় ও স্নায়ু গঠন
- ভিটামিন ডি: ইমিউনিটি, হাড় গঠন ইত্যাদি
- আয়োডিন: বুদ্ধিবৃত্তিক ও হরমোনের উন্নতি ইত্যাদি
- জিঙ্ক: ডিএনএ ও বিভিন্ন এনজাইম তৈরি, ইমিউনিটি ইত্যাদি
৪. প্রয়োজনীয় সাপ্লিমেন্ট
প্রেগন্যান্সি নিশ্চিত জানার পর থেকে ডাক্তাররা প্রয়োজন অনুসারে দৈনিক একটি করে আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট খেতে বলেন। আর প্রতিদিন দুটি ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট লিখে দেন।
অনেকেই হয়তো জানেন না, এই দুরকম ট্যাবলেট একসাথে খাওয়া যায় না। কেননা আয়রন ও ক্যালসিয়াম একে অন্যকে শোষণ করতে বাধা দেয়। শুধু ট্যাবলেট না, যদি দুধ পান করার পর আয়রন ট্যাবলেট খান, তাহলেও একই কাহিনী হবে। কারণ দুধেও তো সেই ক্যালসিয়াম আছে! এছাড়াও চা, কফি ও অন্যান্য ট্যানিন সমৃদ্ধ খাবার আয়রন এর শোষণ কমিয়ে দেয়। তাই এগুলো চেষ্টা করবেন একদম না খেতে, সামান্য খেলেও সাপ্লিমেন্টের আগে বা পরে কোনভাবেই না।
সকাল ও রাতে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেলে, দুপুরে ভাত খাওয়ার পর খাবেন আয়রন-ফলিক এসিড ট্যাবলেট। লেবু বা ভিটামিন সি আয়রনের শোষণ বাড়িয়ে দেয়, তাই প্রতি বেলায় লেবু খাওয়ার চেষ্টা করবেন।
অনেকে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ও ভিটামিন ডি খেতে বলেন যে সময়ে, তা সবার ক্ষেত্রে জরুরি না। তাছাড়া ভিটামিন এ প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলে অনেক সময় তা গর্ভস্থ সন্তানের জন্মগত ত্রুটির কারণ হয়। তাই সাপ্লিমেন্ট এর প্রয়োজন নেই। অন্য যে কোন ওষুধ, হোক তা এন্টাসিড বা নাপা, খাওয়ার আগে ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়ে নেবেন।
৫. অন্যান্য
প্রেগন্যান্সি এই সময় জুড়েই মানসিক কিংবা শারীরিক- উভয় প্রকার স্ট্রেস থেকেই মুক্ত থাকা দরকার। এজন্যই ডায়েটের পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম খুবই জরুরি। তবে কায়িক শ্রম একেবারে বন্ধ না করে, নিয়মিত হাঁটাচলা করবেন। কিছু সহজ ব্যায়াম আছে, সেগুলোও করবেন, তাতে শরীর ঝরঝরা থাকবে।
প্রেগন্যান্ট অবস্থায় শরীরে রক্তের ঘনত্ব ঠিক রাখার জন্য পানি ও লবণ খুব জরুরি। তাই তৃষ্ণা অনুভব করার সাথে সাথেই পানি পান করুন, আর সাথে লবণ তো খাবারের স্বাদ বাড়াতে খাচ্ছেনই। কারো লো প্রেশার থাকলে তো লবণ আরো দরকারি। তবে হাই প্রেশার থাকলে লবণ এড়িয়ে চলবেন।
একজন ভালো মা হতে চাইলে, সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থা থেকেই তার যত্ন নিতে হবে। আপনি পুষ্টিকর খাবার খেলে, সেও পুষ্টি পাবে। আপনি সুস্থ থাকলে, সেও সুস্থ থাকবে। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠবে সে, সাথে সাথে বাড়বে আপনার ভালোবাসা। নাড়ির বন্ধন এমনই অদ্ভুত সুন্দর হয়!
ছবিঃ বি এম জে জার্নাল, ফ্রিপিক
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সাবরিনা আফরোজ
MBBS, MPH
লেকচারার, ঢাকা কমিউনিটি মেডিসিন কলেজ
সম্পাদনায়ঃ হাবিবা মুবাশ্বেরা