আমার নরমাল ডেলিভারির জন্যে সবচেয়ে বেশী উৎসাহ দিয়েছে আমার বোন। ও সি-সেকশনের কথা শুনতেই পারে না। ওর প্রথম বাচ্চার জন্মের সময় ওজন ছিলো ৪.৫ কেজি, পরের জনের ৫ কেজি। তারপরেও প্রথম জনের সময় ওর নরমাল ডেলিভারি করেছে। পরেরবার ওর SPD হয়েছিল, তাই সম্ভব ছিলো না। আমার মা, মামী বা অন্য মুরুব্বিদের পর আমার বোনকেই নরমাল ডেলিভারি করতে দেখেছি। আমি ওকে দেখে আর ওর কথা শুনেই সাহস পাই এই ব্যপারে। তার আগে সবাইকে দেখেছি সি-সেকশন করাতে।
যাই হোক, আমার LMP ছিলো মার্চ ২০১৯ এ। আমি প্রেগন্যান্ট হবার পরেই আমার ইচ্ছা ছিলো আপুর মতন নরমাল ডেলিভারি করবো। আমি সেভাবেই ডাক্তার খুঁজেছি। শুরুতে আমার শাশুড়ির বান্ধবীর কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু পরে কেন যেন মন সায় দিলো না। আমার ইচ্ছা ছিলো স্কয়ারে যাওয়ার, কারণ জানা মতে ওরাই নরমাল ডেলিভারি বেশী করে। এর মধ্যে খুঁজতে হয়েছে কার কাছে যাবো আর কে নরমাল ডেলিভারি বেশী করায়। সেলেব্রেটি ডাক্তার চাচ্ছিলাম না, কারণ ওরা সময় দেয় না। মার্চ মাসেই আমার ভাতিজির মেয়ে হয় স্কয়ারে, ওর ডাক্তার ছিলো খালেদা ইয়াসমিন মির্জা। আমার ভাতিজির ফাইব্রয়েড থাকা সত্ত্বেও উনি বলতো নরমাল ডেলিভারি করেন, কিন্তু ও ভয়ে রাজি ছিলো না। আমি এটা শুনেই সিদ্ধান্ত নেই উনার কাছে যাওয়ার।
উনি কথা কম বলেন, শুরুতে বিশেষ করে। আমাকে প্রথমে দেখেই বললেন সব স্বাভাবিক কাজ করতে, ভারী কাজ না করতে। যা বলে আর কি। কিন্তু দেড় মাসের সময় (সপ্তাহ ভুলে গেছি ), আমার ব্লিডিং শুরু হয়। একদম হঠাৎ। ডাক্তার রেস্ট দিলো, অফিস থেকে দুই সপ্তাহ ছুটি নিতে বললো। সাথে চললো ওষুধ আর ইনজেকশন। ব্লিডিং থামার পর অফিস শুরু করলাম। খুবই বমি হতো, খুবই ক্লান্ত লাগতো। অফিসে অনেক অনেক কাজ, পলিটিক্স… সবই সামাল দিতাম। এর মধ্যে আবার আমরা বাসা পাল্টালাম শ্বশুরের সিদ্ধান্তে। খুবই কষ্টে গেলো কিছুদিন। বাসায় ফিরে রান্নাও করতাম। ভালো লাগতো না কিছুই। এর মধ্যে আপু, প্রেগন্যান্সি আর ডেলিভারি নিয়ে একটা বই পাঠালো। এই বইটা আমার বোন আমেরিকায় যে হসপিটালে দেখাতো, ওখানে দিয়েছিলো ওর প্রথম মেয়ের সময়। আমাকে ও এটা পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমি আর রিফাত পুরোটা পড়লাম। ওই বইটা খুবই সাহায্য করেছে আমাকে। এই বইতে স্বামীর জন্য টিপস প্রতি চাপ্টারের সাথে দেয়া আছে। এটা খুবই উপকারী ছিল। হসপিটালে যাওয়ার ব্যাগ রিফাতই গুছিয়েছে। ও এই বই দেখে জেনেছে কী লাগবে, কী কিনতে হবে।
৩২ সপ্তাহে গিয়ে আবার ব্লিডিং। আমার অফিস যাওয়ার রাস্তা ছিলো খুবই খারাপ, যেহেতু ওটা মিরপুরের কাছে ছিলো। ঝাঁকিতেই এই সমস্যাটা হলো। ওই সময়ে preterm labor এর একটা সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, দুইদিন হসপিটালে থাকার পর ঠিক হয়ে গেলো। আবার দুই সপ্তাহের বেড রেস্ট। নিলাম। সুস্থ হয়ে আবার অফিস।
আমি শুরুতে ডাক্তারকে জিগ্যেস করতাম নরমাল ডেলিভারি সম্ভব কিনা। উনি খালি বলতেন সময় আসলে বুঝা যাবে। ৩৪ সপ্তাহে গিয়ে উনি নিজেই আমাকে কিছু ব্যায়াম দেখালেন, হাঁটতে বললেন। মন যেন চিন্তামুক্ত থাকে সেটাও বললেন।
আমার অফিসে ৩৮ সপ্তাহে ছুটি নেওয়া লাগে, নিলাম। ৩৮ সপ্তাহে আমার ভ্যাজাইনাল এক্সাম করে বললেন বাচ্চা যত নিচে থাকার কথা ততো নিচে নাই, সে একটু উপরেই আছে। ডাক্তার বললো যদি পানি ভাঙে, তাহলে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি হয়ে যেতে হবে। ৩৮ সপ্তাহ যেদিন শেষ, ঐদিন ভোর ৩টায় mucus plug দেখি। ঐদিন শুক্রবার ছিলো, রবিবার ডাক্তার যেতে বলেছিলো। এটার নাম, এটা দেখতে কেমন, দেখলে কী করতে হবে সেটা ওই বই পড়েই জেনেছি। আমি, রিফাত আর আমার শাশুড়ি হাসপাতাল চলে গেলাম। আম্মা, ভাইয়া, ভাবিও ছিলো। কিন্তু আমার ডাক্তার ঐদিন একটা কনফারেন্সে কক্সবাজার গিয়েছিল। তবে উনি ফোনে বলে দিয়েছিলেন আমাকে যেন লেবার রুমে রাখা হয়।
আমার পানি তখনো ভাঙে নাই, কিন্তু ব্যথা ছিলো। আবার বাবুও উপরের দিকে। রাতে পানি ভাঙলো, তবে খুবই অল্প। শনিবার সকাল পর্যন্ত ডাক্তাররা অপেক্ষা করলো। এরপর ইনডাকশন দিলো। যেহেতু বাবু উপরে তাই আমাকে saline বা ওষুধের ডোজ বেশী দিচ্ছিলো। আর যে কী ব্যথা, সেটা আল্লাহ জানে একমাত্র। এদিকে পানিও পুরো ভাঙছিলো না। সব শুনে আমার ডাক্তার কক্সবাজার থেকে চলে আসলো। আমার এক পর্যায়ে আর হুশ ছিলো না। খালি মনে পরে ডাক্তার আমাকে স্যুপ খাওয়ালো, কারণ আমি dehydrated হয়ে গিয়েছিলাম। আমি বহু চিল্লানোর পর ২১ ডিসেম্বর ২০১৯ সন্ধ্যা ৭টায় আলিয়া আমার কোলে আসে। আমার এপিসিওটমি করা লেগেছে। শেষ পর্যায়ে আর শক্তি ছিলো না প্রেশার দেওয়ার কারণ বাবু ছিলো উপরে।
লেবার রুমের নার্স আমাকে একটা কথা বলেছিল। ওরা নরমাল ডেলিভারি করাতে চায়, কিন্তু রোগীরা রাজি হয় না। আমি নিজেও সেটাই বেশী দেখেছি। স্কয়ারে আরেকটা কাজ করেছিলো। ওরা আম্মা আর রিফাতকে আমার ব্যথার সময় সাপোর্ট দিতে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছিল। ডেলিভারির সময় অবশ্য দেয় না। ডাক্তার আমাকে ওই সময় হাঁটতে বলেন, আমাকে রিফাত হাঁটিয়েছে। উনি আমাকে লেবার পজিশন হিসাবে নিচেও বসান তবে আমি সেভাবে সুবিধা করতে পারছিলাম না।
বাবু হবার পর লেবার রুম থেকে আমাদের বের করলো বাইরের সবাইকে দেখাতে। যখন বের হই, তখন ওখানের সবাই(ডাক্তার, নার্স ) দুইপাশে দাঁড়িয়ে হাতে তালি দিচ্ছিলো। কারণ ওরা কাউকে এতক্ষন অপেক্ষা করতে দেখে না। আমি মনে মনে বলি আলহামদুলিল্লাহ।
আমার মেয়ে সবাইকে দেখেই একটা হাসি দিলো। বুঝে নাকি না বুঝে দিলো সেটা জানি না
(লিখেছেনঃ উম্মে আলিয়া)
পাঠকদের সুবিধার জন্য এই গল্প থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট আমরা নিচে তুলে ধরছি:
- নরমাল ডেলিভারি করার জন্য সাহস ও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়।
- পছন্দমত ডাক্তারের খোঁজ করা গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনে ডাক্তার পরিবর্তন করতে দ্বিধা করা ঠিক না। প্রেগন্যান্সি ও মাতৃত্বের যে কোনো ধাপে নিজের ইনটুইশন বা ভেতরের অনুভূতিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত।
- প্রেগনেন্সি নিয়ে পড়াশোনা করা ডেলিভারির জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করে।
- স্বামীও যদি পড়াশোনা করেন তাহলে প্রেগনেন্সি ও ডেলিভারি নিয়ে উনি অন্ধকারে থাকেন না। সন্তানের আগমনে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা রাখতে পারেন ও সে অনুযায়ী স্ত্রীকে সহযোগিতা করতে পারেন। – মাতৃত্ব
ছবি কৃতজ্ঞতা: iqraa.com