টিনেইজ সন্তানের সাথে আমাদের সম্পর্কোন্নয়নের মূল হাতিয়ার কী, বলুন তো? গুড কম্যুনিকেশান, তাইনা? আর এটার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা উপায় হচ্ছে: সন্তানের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, যাকে বলা হয় Active Listening.

এই যে মনের কান দিয়ে কথা শোনা, এটার গুরুত্ব কত, তা একটু বাস্তবতার আলোকে ব্যাখ্যা করি। আমাদের আশেপাশে কিংবা আমাদের নিজেদের মধ্যেই অনেকে আছে যাদের বাবা-মায়ের সাথে, বিশেষ করে বাবার সাথে এই যোগাযোগের সম্পর্কটা একদমই নেই। আমাদের বাবামায়েরা বেশিরভাগই সন্তানের শৈশব থেকে চিন্তিত থাকেন, বাচ্চা কেন খায়না, কত বেশি খাইয়ে তাকে গাপ্পুস গুপ্পুস বানানো যায়। আর এর পরের স্টেইজ হলো, ভালো জায়গায় পড়ানো, প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় টিকে থাকার জন্য যে করেই হোক তাকে একটা ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো, প্রাইভেট টিউটর, কোচিং…. আর দিনরাত এসবের পিছে দৌড়ানো। দ্বীনদার বাবা-মায়েরা আরেকটা দিকে ফোকাস করেন, তা হলো সন্তানকে দ্বীনি শিক্ষা দেয়া। মোটামুটি আমাদের অভিভাবকদের ফোকাসের কেন্দ্র ৩ টি: সন্তানের শরীর(পেট), সার্টিফিকেট(পড়াশোনা) ও দ্বীন। এসবই ঠিক আছে, তবে যে বিষয়টা অবহেলিত থেকে যায় সেটা হচ্ছে, সন্তানের মন ও মানসিকতার জায়গাটা, শরীরের খাবার নিয়ে আমরা অতিসচেতন, কিন্তু মনের খোরাক নিয়ে একেবারেই অচেতন। হিসেব করে দেখেন তো, আমরা কতজন আজকের জায়গায় দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমার বাবা-মা, বিশেষ করে বাবার সাথে আমি আমার মনের কথা শেয়ার করতে পারি? অনেকের ক্ষেত্রেই পরিবারে ‘বাবা’ মানে একটা আতঙ্কের নাম, কিছু একটা ভুল করলেই হয়তো তেড়ে এসে মাইর লাগাবে। কিন্তু পাশে বসিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করবে- বাবা, আসলেই কি তুমি ভুলটা করেছিলো? ইচ্ছায় না অনিচ্ছায়? তোমার নিজেরও এর পেছনে কোন লজিক আছে কিনা? এমন বাবা হাতে গোণা। ফলে ঐ যে শৈশব থেকেই বাবা-সন্তানের মাঝে সম্পর্কের একটা ‘গ্যাপ’ তৈরি হয়ে যায়, ওটা আমৃত্যু থেকে যায়। এমনকি এমনও ঘটে, মেয়ে বিয়েতে রাজি নয়, কিন্তু বাবার মুখের উপর কিছু বলার অনুমতি নেই তাই অমত সত্ত্বেও রাজি হয়ে গেলো, বাকী জীবন হয়তো সেটা নিয়েই সাফার করলো, অথচ ইসলামেও এমনটির অনুমতি নেই। তো এই যোগাযোগ জিনিসটা একদিনে হয়না, একটু একটু করেই গড়ে ওঠে। বাবা মায়েরা সন্তানের জন্য নিজেদের সবটুকু বিলিয়ে দিলেও শুধু এই মানসিক গ্যাপটুকুর কারণেই ফলাফল অনেক নেগেটিভ হয়ে থাকে- সন্তান কোনদিন মন খুলে বাবা মায়ের সাথে কিছু শেয়ার করতে পারেনা বলে কষ্ট পায়, তেমনি বাবা-মায়েরা সন্তানের জন্য সর্বস্ব বিলিয়েও তাদের কাছে কাঙ্ক্ষিত ব্যবহার পান না বলে আজীবন আক্ষেপ করতে থাকেন।

তো এই এক্টিভ লিসেনিং এর পদ্ধতিটি কী? এর জন্য ৪ টি শর্ত পূরণ করতে হবে-

১. Listen (শুনুন)

সন্তানের কথা ও ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ দুটোতেই মনোযোগ দিতে হবে। অবাক হলেও সত্য যে, আমরা অন্যের কথার যতটুকু বুঝি, তার ২০% এরও কম আমরা উচ্চারিত শব্দ শুনে বুঝি, বাকি ৮০% ই বুঝে থাকি বডি ল্যাংগুয়েজ থেকে- গলার আওয়াজের টোন, চোখের ভাষা, মুখভঙ্গি, বডির পজিশিন এসব থেকে৷ এজন্য গুরুত্বপূর্ণ কথা বক্তার দিকে না তাকিয়ে (বিশেষ করে মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে) শোনাটা একদমই অনুচিৎ- তাতে বক্তা বিরক্ত হয়, শ্রোতারও পুরো বোধগম্য হয়না। সীরাতুর রাসূল থেকেও আমরা দেখি, তিনি কারো সাথে কথা বললে একদন পুরো শরীর তার দিকে ঘুরিয়ে, সবটুকু মনোযোগ দিয়েই বলতেন।

২. Reflect (পুনরাবৃত্তি করুন)

সন্তান যা বলছে, তা কোনরকম জাজমেন্ট ছাড়াই শুনুন, তার সব সমস্যার সমাধান বাতলে দেয়ারও দরকার নেই। মনোযোগ দিয়ে পুরো কথাটি শুনুন, কিছু কথা ইতিবাচকভাবে রিপিট করুন।

– আম্মু, জানো স্কুলের আজকের ঘটনাটিতে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি।

– ও আচ্ছা, তাইতো, তুমি তো অনেক কষ্ট পেয়েছো।

৩. Clarify (স্পষ্ট করে নিন)

তার কোন কথা শুনতে বাদ পড়ে গেলে তা আবার জিজ্ঞেস করে শুনে নিন, কোনকিছু অস্পষ্ট মনে হলে ভালো করে শুনুন, আপনার বোঝায় কোন ভুল হয়েছে কিনা তাও যাচাই করে নিন।

৪. Empathise (সমব্যথী হোন)

সন্তানের কোন কষ্ট বা অনুভূতির কথা শোনার সময় তার স্থানে নিজেকে বসিয়ে কল্পনা করুন, try to walk in his/her shoes. আপনি যে তার কষ্টটা বুঝতে পারছেন, তার অনুভূতিকে আপনি মূল্যায়ন করছেন, এ বিষয়ে তাকে আশ্বস্ত করুন।

এই ৪ টি ধাপ অনুসরণ করলেই আপনি এক্টিভ লিসেনার হতে পারবেন। আর আগ বাড়িয়ে সব সময় সন্তানকে উপদেশ দিতে যাবেন না, মাঝে মাঝে শুধু ‘শোনা’ই অনেক বড় স্বান্ত্বনা, সাইকোলজির ভাষায় এটাকে বলে cathersis, যার মানে হলো, নিজের কষ্টটা অন্য কাউকে বলে হালকা হওয়া। আমরা অন্যের কাছে সবসময় উপদেশ বা পরামর্শ চাইনা, নিজের কষ্টটা কেউ মন দিয়ে শুনলেও নিজেকে অনেকটা হালকা মনে হয়। তবে হ্যা, সন্তান যদি নিজেই আপনার কাছে তার কোন সমস্যার সমাধান চায়, তখন তাকে আপনার মত করে সঠিক সমাধানটি জানিয়ে দিন। তবে তা যেন সন্তানের উপর চাপিয়ে দেয়া না হয়, বরং পরামর্শ হিসেবেই দেবেন, যেটি সে গ্রহণ অথবা বর্জন করার এখতিয়ার রাখে।

তার মানে কি সন্তান ভুল পথ বেছে নিলেও তাকে উপদেশ দেবোনা? দেবেন, অবশ্যই দেবেন, কিন্তু তার আগে আস্থা অর্জন টা জরুরী। আপনার উপর আস্থা না থাকলে সন্তানকে আপনি যতই নীতিবাক্য শোনান, সে এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেবে, আপনার কথা তার কানে পৌছবে, মনে ধরবে না। কিন্তু আপনি যখন একজন এক্টিভ লিসেনার হতে পারবেন, সন্তান বুঝতে পারবে যে আপনাকে কোন কথা বললে আপনি জাজমেন্ট ছাড়াই তার কথা মন দিয়ে শোনেন, তাকে বোঝার চেষ্টা করেন, তার প্রতি এম্প্যাথি রাখেন, তখন আপনার প্রতি তার একটা আস্থা তৈরি হবে, ফলে আপনি কোন দরকারি উপদেশ বা গাইডলাইন দিলেও সে তখন তা গুরুত্ব দিয়ে শোনার চেষ্টা করবে।

সবশেষে একটা কথাই বলি- এই যে আপনি দিন নেই রাত নেই, বাচ্চা কী খাবে না খাবে, তা নিয়ে টেনশান করছেন, একটার পর একটা আইটেম তৈরি করছেন, আরেকটু বড় হলে নিজের দ্বীন-দুনিয়া বিসর্জন দিয়ে তার টিউটর আর কোচিংয়ের পেছনে ছুটছেন….আজ থেকে বিশ/ত্রিশ বছর পরের কথা কল্পনা করুন, তখন সন্তানের আর শরীরের যত্নেরও প্রয়োজন নেই, সার্টিফিকেটের প্রয়োজনীয়তাও অনেকখানিই নেই, সে নিজেই হয়তো স্ত্রী ও সন্তানের অভিভাবক, আপনার সাথে তার সম্পর্কটা তখন কেবলই মনের। শৈশবে যদি আপনি তার সাথে সেই যোগাযোগের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন তবে বৃদ্ধ বয়সেও সেটা কাজে দেবে। সে ব্যস্ততার মাঝেও সে আপনার মনের খোরাকটুকু মেটানোর চেষ্টা করবে, আপনার জায়গা থেকে আপনাকে বোঝার চেষ্টা করবে, যেমনিভাবে আজকে আপনি ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিচ্ছেন, তার জায়গা থেকে তাকে বুঝতে চেষ্টা করছেন। শরীরের খাদ্য তো সব বাবা-মাই দেন, আপনার সন্তানের মনের খাদ্য আপনি কতটুকু দিতে পারছেন, বাবা-মা হিসেবে সেটিই আপনার সার্থকতা নিরূপন করে। আকারে বড় মানুষ সবাই হয়, সার্টিফিকেটেও বড় অনেকেও হয়, মনে ও মননে বড় হয় কজন??

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা