আমাদের শরীর থেকে নিঃসৃত প্রাকৃতিক রাসায়নিক পদার্থকে হরমোন বলে। শরীরের ভেতর ছোট বড় বিভিন্ন ক্রিয়ায় এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। অন্য অনেক কিছুর মতোই সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রেও রয়েছে হরমোনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। প্রাকৃতিকভাবে প্রসবের জন্য কিছু হরমোনের অবাধ প্রবাহ যেমন প্রয়োজন, তেমন আবার কিছু হরমোন আছে যা প্রসবের বিপরীতে কাজ করে। প্রসবব্যথা চলাকালীন কোন কারণে যদি সহায়ক হরমোনের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয় বা বিরতি পড়ে, অথবা প্রসবের বিপরীতমুখী হরমোন প্রবাহিত হয় তাহলে প্রসবে বাধা পড়ার বা সেটা কষ্টসাধ্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই প্রসবব্যথা চলাকালীন প্রসবকে স্বচ্ছন্দে অগ্রসর হওয়ার জন্য আমাদের হরমোনগুলো কখন কিভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে সেটা জানা থাকলে আমাদের উপকার হবে।

আমাদের আবেগের সাথে হরমোন প্রবাহের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রসবের জন্য যেসব হরমোন সহায়ক তা মমতাময়, আস্থাভাজন পরিবেশে বেশি প্রতিক্রিয়াশীল থাকে। তাই এই সময় মানসিকভাবে নিরাপদ বোধ করা খুব জরুরী। আমরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করব যে, আমাদের চারপাশের পরিবেশ আমাদের আবেগকে এবং ফলশ্রুতিতে আমাদের হরমোনের ধারাকেও প্রচণ্ডরকম প্রভাবিত করে।

প্রসব করার পরিবেশে আমাদের নিরাপদ অনুভব করা জরুরী কেন? কারণ তাহলে আমরা শান্ত ও শিথিল থাকতে পারব যা সহায়ক হরমোনের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করবে ইনশাল্লাহ।

আপনি জেনে হয়ত অবাক হবেন যে প্রসবের সময় সাহায্যকারী হরমোন এবং একজন নারীর প্রচণ্ড যৌন উদ্দীপনার সময়ে যে হরমোনগুলো কাজ করে তা মূলত একই। প্রাকৃতিক প্রসবের জন্য সহায়ক প্রধান যে হরমোন তা হচ্ছে অক্সিটোসিন। একে “ভালবাসা হরমোন” বলেও অভিহিত করা হয়। একজন সন্তান জন্মদানকারী নারীর মাঝে অপ্রতিরোধ্যতা ও আত্মসমর্পনের এই হরমোন কার্যকরভাবে শুধু তখনই প্রবাহিত হতে পারে যখন নারী ভালবাসা ও নিরাপত্তা বোধ করতে পারে এবং তার চারপাশের মানুষকে বিশ্বাস করতে পারে। এর আরেকটি নাম হচ্ছে “লাজুক” হরমোন। অনেক সময় এই হরমোন ভালোভাবে প্রবাহিত হওয়ার জন্য একজন নারীর নির্জনতার প্রয়োজন হয়।

অন্য যে হরমোনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে সেটা হচ্ছে এড্রেনালাইন। একে “ভয় বা পলায়ন” হরমোন নামেও অভিহিত করা হয়। যখন একজন নারী উদ্বিগ্ন, অস্বস্তিবোধ, আতঙ্ক, স্নায়ুচাপ, আহত, বিপর্যস্ত, রাগান্বিত, অথব অতিরিক্ত উত্তেজনা অনুভব করে তখন এড্রেনালাইন হরমোন প্রবাহিত হতে শুরু করে। ফলে নারীর প্রসবব্যথা আরও বেশি যন্ত্রণাদায়ক ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। এই হরমোন মূলত আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে প্রসবকারী নারীকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য কাজ করে এবং বিপদের সম্মুখীন হলে তাকে লড়াই করার বা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। এই হরমোনের প্রবাহ নাড়ীর স্পন্দন বাড়িয়ে দেয়, চোখ বিস্ফারিত করে দেয়, এবং স্ফিঙ্কটারকে(sphincter) বন্ধ করে দেয় (স্ফিঙ্কটার হচ্ছে চক্রাকার পেশী যা মলদ্বার, মূত্রথলি এবং প্রসব নালার বাহিরের দিকের পথকে নিয়ন্ত্রণ করে)। বন-জঙ্গলে যখন প্রাণীরা বিপদের সম্মুখীন হয় তখন এই হরমোন তাদের গর্ভস্থ সন্তানকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে।

দুঃখজনক যে আধুনিক প্রসব ব্যবস্থায় প্রায় সময় এই হরমোনকে উসকে দেয়া হয়। অনেকসময় দেখা যায় যে ঘরের পরিচিত পরিবেশ থেকে হাসপাতালের অপরিচিত পরিবেশে গেলে মায়ের প্রসবব্যথায় ব্যঘাত ঘটে। কেউ প্রচণ্ড যৌন উদ্দীপনার মাঝে যখন থাকে তখন নিজেকে আত্মসমর্পণ করার জন্য যেমন পরিবেশ প্রয়োজন প্রসবব্যথার সময় আক্সিটোসিন প্রবাহিত হওয়ার জন্যও তেমন অনুকূল পরিবেশ জরুরী। হাসপাতালের পেশাদার ডাক্তার, উজ্জ্বল আলো, অনবরত মেশিনের বিপ বিপ শব্দ ও বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা নিরীক্ষার মাঝে এমন পরিবেশ অনুভব করা বেশ কঠিন ব্যপার বটে!

আর তাই, প্রসবের মতো অত্যন্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে সেভাবেই অর্জনের সুযোগ দিলে বেশিরভাগ নারী নিজের পরিচিত পরিবেশে একা বা ভরসা করতে পারে এমন মানুষদের সাহচর্যে বেশি ভালোভাবে প্রসবব্যথা মোকাবেলা করতে পারে। অনেকে এর মাধ্যমে পেশাদার সহায়তা নিয়ে ঘরে প্রসব করা বোঝে, আবার অনেকে হাসপাতালে যাওয়ার আগে যতক্ষণ সম্ভব ঘরে অবস্থান করা বোঝে। কেউ আবার প্রসবব্যথার সময় হাসপাতালের পরিবেশের প্রতি মনোযোগ না দিয়ে নিজের মাঝে মনোযোগ দেয়া বোঝে। তবে, প্রসবের বেশ কিছুদিন আগে থেকে হাসপাতাল ঘুরে আসলে সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় এবং কেমন পরিবেশ পাওয়া যেতে পারে সেটা জানা থাকলে মা কিছুটা স্বস্তিবোধ করতে পারেন।

তথ্যসূত্র

বই AMANI Birth লিখেছেন Aisha Al Hajjar

লেখাটি রিভিউ করেছেন –

ডাঃ সাবরিনা আফরোজ
MBBS, MPH
লেকচারার, ঢাকা কমিউনিটি মেডিসিন কলেজ

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা