ইউসুফ খাদিজাকে কখনো ফরশা কালো শিখাই নি, খানিকটা এক্সপেরিমেন্টালি বলা চলে। ইউসুফের এখন চার বছর। আমি জানতে চাচ্ছিলাম ও নিজে থেকে কখনো বিভিন্ন গাত্র বর্ণের কথা আমাকে জিজ্ঞেস করে নাকি। যখন ওদেরকে নিয়ে বাসে উঠি,কালো,সাদা, বাদামী, হলদে নানান কমপ্লেক্সনের মানুষ থাকে স্বাভাবিকভাবেই। অপেক্ষা করেছি ও বা খাদিজা কোন প্রশ্ন করে কিনা। কারণ,তাঁরা আমাকে কুকুর বিড়ালের ভিন্ন ভিন্ন রঙ আর ছোপ থাকার কারণ ইতিমধ্যে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে। মানুষের ব্যপারেও কৌতূহল থাকবে এটা ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা আমাকে এ বিষয়ে কখনোই কিছু জিজ্ঞেস করে নি। সামনের বাসার বুড়ো নানির কুঁচকে যাওয়া চামড়ার কথা জিজ্ঞেস করেছে, কোন পাঙ্ক ছেলের মাথায় নায়াগ্রা ফলসের মতন বেণীর বাহার নিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, অথবা কারো শরীরের উল্কি তাঁদের প্রশ্নের বিষয় হয়েছে। কিন্তু কারো রঙ না। অদ্ভুত লাগলেও আমি নিজে থেকে তাঁদেরকে কিছু বলিনি।

মজার কথা হলো, ইউসুফের তিন টিচার তিন বর্ণের। একজন সাদা,একজন কালো আর একজন ব্রাউন।গত সপ্তাহে কথা বলতে বলতে ক্যাযুয়ালি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, সে কোন টিচারের সাথে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জানতে চাই নি, কারণ আমি এখনো তাঁকে ফেভারিটিজমের সাথে ইন্ট্রোডিউস করাতে চাই না। নিজে থেকেই বুঝে যাবে, এটা নিশ্চিত। ফেভারিটিযম জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে কতটা যন্ত্রণাদায়ক, যারা নন-ফেভারিট তাঁদের জন্য সেটা মনে হয় প্রতি ধাপে ধাপে শেখার বিষয়। আমার ক্লাস থ্রিতে এক টিচার ছিলেন, ক্লাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই মেয়ের নাম জপতেন। বার বার বলতেন, তোমরা ওর মতন হতে পারবা না।কি মন খারাপ করা ব্যাপার না? গা সওয়া হয়ে যায় অবশ্য। যাই হোক, ও অনেক ভেবে চিন্তে উত্তর দিলো, যে সবচেয়ে সুন্দর টিচারটা, তাঁর সাথেই ওর খেলতে সবচেয়ে ভালো লাগে। এবার আমার অবাক হবার পালা। চার বছরের বাচ্চার সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কি এটা আমি জানি না, মাপকাঠি কি তাও বলতে পারবো না। মনে মনে শংকা ছিলো যে সাদা যে জন, তাকেই কি অবচেতন মন সবচেয়ে সুন্দর ধরে নিয়েছে?

নাম জিজ্ঞেস করলাম। যিনি ব্রাউন তাঁর কথা বলছিলো সে। বুঝলাম, তিনিই ইউসুফের সবচেয়ে প্রিয়। আস্তে ধীরে নিজে থেকেই বললো যে উনি সবচেয়ে সুন্দর করে শেখান, কথা বলেন হেসে হেসে এবং প্রচুর এপ্রিসিয়েট করে। ব্যস, সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা এতটুকুই। মজার বিষয় না? ও যদি জানতো যে ফরশা বেশী সুন্দর, তাহলে হয়তো যিনি সাদা তাকেই যবচেয়ে সুন্দর আখ্যায়িত করতো। পোস্ট কলোনিয়ালিযমে আমরা যারা আটকে আছি, তাঁরা এখনো বুঝে উঠতে পারি না যে আমাদের কতটা এক্সপ্লয়টেশন করা হয়েছে যে আমাদের চিন্তা ধারার সে বিবর্তন আমরা এখনো রিভার্স করতে পারি না। যাই হোক,এটা অবশ্য আমার টপিক না। আরেকটা জিনিস দেখেছি, বাংলাদেশ থেকে এখানে আসার পর একেজনের ভিন্ন চুলের রঙ, চোখের রঙ ইউসুফকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেয়াল করতে দেখেছি,কিন্তু ও সেটা নিয়েও জিজ্ঞেস করে নি।ও হয়তো বুঝে নিয়েছে যে এটাই স্বাভাবিক। একেক মানুষের একেক রঙ থাকবে, চুল আর চোখের রঙ ভিন্ন হবে, এখানে হয়তো আন-ন্যাচারাল কিছু মনে হয়নি তাঁর। অবশ্য একবার একজনের দাঁত কুচকুচে কালো দেখে জিজ্ঞেস করেছিলো কারণ। এটা যে নরমাল না, সেটা সে বুঝেছে। অদ্ভুত না? আমার ধারণা আল্লাহ প্রতিটা বাচ্চাকে বিপুল হিকমাহ দিয়ে পাঠান। তারপর আমাদের হরেক প্রি-কন্সিভড চিন্তাধারার যাঁতাকলে পড়ে তাঁদের সঠিক বিকাশটা হয় না।

(লিখেছেনঃ নাবিলা নোশিন সেঁজুতি)

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা