ভাই বোনদের মাঝে দ্বন্দ্ব নেই এমন পরিবারের সংখ্যা নেহাৎ কম। প্রচুর মা এই অভিযোগ করেন যে, তার বাচ্চারা সারাক্ষণ ঝগড়া করে, মারামারি করে, বড়জন ছোটজনকে দেখতে পারেনা। এই দ্বন্ধ তখন আর খুনসুটির মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেনা। সন্তানদের সামলাতে মায়ের তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

সহোদরের রেষারেষি
সহোদরের রেষারেষি

কেস ১ঃ বড় সন্তানের বয়স ৬, আর ছোটজনের প্রায় সাড়ে তিন। মায়ের অভিযোগ দুইজনের সারাদিন মারামারি হয়। উনি আর পারছেন না সহ্য করতে। জিজ্ঞাসা করলাম, সাধারণত উনি কি করেন তাদের থামাতে? উনার স্বীকারোক্তি, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মারেন, স্পেশালি বড়জনকে, কারন ও তো বড়, কেন বুঝবে না ও?

কেস ২ঃ বড় সন্তানের বয়স প্রায় পাঁচ, আর ছোটজনের দেড়। উনার বড় ছেলে খুব বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। মায়ের কথা শুনেনা, বাসার কারো কথাই না। ছোট ভাইকে দেখতে পারেনা। বাচ্চাটিকে আলাদা ডেকে জানতে চাইলাম, “তোমাকে আম্মু বেশী আদর করে নাকি আব্বু?” বাচ্চার জবাব, “কেউ না, আমায় কেউ ভালোবাসেনা। আমার সব কিছু মা ভাইকে দিয়ে দেয়। সবাই আমাকে বকে।”

বোঝা যাচ্ছে কি সমস্যাটা আসলে কোথায়? আমাদের দক্ষিন এশিয়ার অধিকাংশ মা বাবা এভাবেই সন্তান পালেন।

প্রথমেই সমস্যার গোড়ায় যাই। কেন বড় সন্তান ঈর্ষা বোধ করে ছোটজনের প্রতি?

আচ্ছা ভাবুন তো, আপনার স্বামী ৩/৪ বছর সংসার করার পর আরেকটি মেয়েকে নিয়ে এল বিয়ে করে। আপনার কি অনুভূতি হবে? রাগ, ক্রোধ, জেলাসি? ঠিক একই অনুভুতি গুলোই হয় একটি বাচ্চার। হঠাৎ করে সে দেখে যে মা বাবা শুধুই তার ছিল, তাকে ভালোবাসতো, তারা আর শুধু তার মা বাবা নেই। আরেকজন চলে এসেছে।

তাও হয়তো তার মন মেনে নিতে পারতো, কিন্তু সে দেখে মা সারাক্ষন নতুন বেবিকেই সময় দেয়। তাকে আর আগের মতো আদর করেনা। উলটো বকা দেয় পান হতে চুন খসলেই। আত্মীয়স্বজন সবাই নতুন বাচ্চাটিকেই আদর করে, তার জন্য জিনিস আনে। বড়জন যেন তখন ব্রাত্য।

মায়েরা একটা অজুহাত খুব দেয়, ছোট বাচ্চা নিয়ে মেজাজ খিটখিটে থাকে, তার উপর বড়জনের বায়না অসহ্যকর। তারা এটা ভাবেনা, বাচ্চাটার মনে কি চলছে। মায়েরা নিজের মেজাজ হতাশা অবসাদ সব সন্তানের উপর ঝাড়ে। একজন এডাল্ট হয়ে নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করতে পারেন না, অথচ আশা করেন একটা শিশু তার ইমোশনকে কন্ট্রোল করবে??

বাংগালী পরিবারে সাধারণত যেভাবে Sibling দের ঝগড়া থামানো হয়, বা চেষ্টা করা হয়-

মা এসে বড়জনকে চড় থাপ্পর মারে। কেন তুই ছোট ভাইয়ের/বোনের সাথে ঝগড়া করছিস?
ছোটটি যা চাইবে তাই তাকে দিয়ে দেয়, খেলনা বা জিনিসটি বড়জনের হলেও। তাকে বলা হয়, ও তো ছোট ওকে দিতে হয়। দুজনকেই ধমকে মেরে সরিয়ে দেয়।

এছাড়াও সারাক্ষন তুলনা চলতে থাকে। বাসায় আত্মীয়স্বজন আসলেই তারা একজনের সাথে অন্যজনের তুলনায় বসে যায়। গায়ের রঙ, স্বভাব, ব্যাবহার কিছুই বাদ যায়না তুলনা হতে। এর সাথে যুক্ত হয়, মা বাবার পরিষ্কার পক্ষপাতিত্ব এক সন্তানের প্রতি।

এরকম একের পর এক স্ফুলিঙ্গ জমা হতে থাকে যা (আমাদের কাছে সামান্য কিন্তু বাস্তবে নয়) একসময়ে গিয়ে আগুনে পরিনত হয়। অথচ মা বাবার একটু সতর্কতা, একটু ব্যালেন্স করে চলা, এসবই পারে তাদের সন্তানদের মাঝে এই দ্বন্ধ কমাতে বা দূর করতে।

মা বাবা ভাবেন, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে সব। কিন্তু সবসময় তা হয়না। ভাই বা বোনের প্রতি তীব্র ঘৃনা নিয়ে বড় হয় এমন ছেলে মেয়ের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। কাজেই মায়েরা বাবারা, সচেতন হোন এখন হতেই।

লেখক: কানাডা প্রবাসী, Early Childhood Development নিয়ে কাজ করছেন।
ছবি কৃতজ্ঞতা: ফ্রিপিক

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা