পাইলোরিক স্টেনোসিস

পাইলোরিক স্টেনোসিস | ছবি কৃতজ্ঞতা: মেয়ো ক্লিনিক

গত বছর (২০১৬ সালে) সেপ্টেম্বর মাসে জানতে পারি আমার বাবু রাইফের সার্জারি করানো লাগবে। তার রোগের নাম পাইলরিক স্টেনোসিস (Pyloric Stenosis)। নবজাতকের ক্ষেত্রে এটা বেশ দূর্লভ অবস্থা। সাধারণত এধরনের ক্ষেত্রে খাবার বাচ্চার অন্ত্রে প্রবেশে বাধা পায়, যার কারণে খাবার হজম না হয়ে বাচ্চা খাওয়ামাত্র বমি করতে থাকে। এধরনের বাচ্চারা পানিশূন্যতায় ভুগে এবং সবসময় ক্ষুধায় কান্না করে।

আমাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরল। এমনিতেই রাইফ ছিল অপরিণত (Preterm) ও কম ওজন নিয়ে জন্মানো বাচ্চা (১.৭ কেজি আলহামদুলিল্লাহ্‌, ৩৫ সপ্তাহ) । তার উপর এই কথা শুনে বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। আমার বেবি তখন দেড় মাসের কাছাকাছি। এক মাস ধরে আমি রাতে বড়জোর ২ ঘন্টাও ঘুমাতে পারতাম না। বাচ্চাটা প্রতি ফিডের পর কুলির মত বমি করত তা ছিটকে গিয়ে দূরে পরত। বমিতে বিছানার চাদর, মেক্সি সয়লাব,চেঞ্জের আগেই আবার বমি। কখনো চেঞ্জ করে আসার ৫ মিনিটের মধ্যেই। হাসবেন্ড অফিসে, সারাদিন পুরা বাসায় আমি একা। রাতে দুজন জেগে বাচ্চার পাশে বসে থাকতাম। কি এক আতংক। একবার দুধ খাইয়ে খাড়া অবস্থায় (upright) ধরে রাখতাম ৩০-৪৫ মিনিট। তাও খানিকক্ষণ পর বমি হয়ে যেত আর বাচ্চা চিৎকার করে ক্ষুধায় কাঁদত। কঠিন পরীক্ষার সময় আমাদের জীবনে। যদিও ডাকতারদের মতে ছোট একটা অপারেশন, অনেকসময় ৪ দিন বয়সের বাচ্চারো করা হয়ে থাকে, কিন্তু মায়ের মন এত কিছু হিসেব-নিকেশ বুঝতে তখন রাজি ছিলনা।

রাইফ যখন দিন-রাত ২৪ ঘন্টা বমি করত মুরুব্বীরা ভেবেছিলেন হয়ত আমি নতুন মা বলে বেশী টেনশান করি। সব বাচ্চারাই তো একটু আধটু বমি করে। আমি যে সারাদিন- রাত বাবুকে নিয়ে বমির মাঝেই পড়ে থাকতাম সেটা সবাইকে বুঝাতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল যেহেতু আমি একা থাকি। শাশুড়ি বহু আগে মারা গেছেন, উনাকে আমি কোনদিন দেখিনি, আম্মা শিক্ষকতা করেন, নেই আমার কোন বোন বা ভাবী, একা একা বাচ্চাটাকে নিয়ে সংগ্রাম আমার। আমার বাবাটাকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম। একজন মাতৃস্থানীয় মুরব্বীকে খুব মিস করতাম।

বমি হয়ে পেট খালি হয়ে যখন আমার বাচ্চাটা চিৎকার দিয়ে কেঁদেছে তখন ওর সাথে আমিও কেঁদেছি। মায়ের মন কিভাবে যেন বুঝে গিয়েছিল যে আমার বাবুর এই সমস্যা স্বাভাবিক না। শেষ এর দিকে ওর বাবা আর আমি খেতে পারতাম না, আমাদের বাচ্চাটা যে না খেয়ে আছে। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে এত ছোট বয়সে অপারেশন করতে নিষেধ করলেন। এই ছোট প্রিটার্ম বেবি এই ধকল নিতে পারবেনা। যেই সার্জনকে দেখালাম উনি জানালেন, দেরি করলে এসব বাচ্চারা বেঁচে থাকেনা, উনি শিশু হাস্পাতালে অনেক দেখেছেন। বাবুর চামড়া কুঁচকে যাচ্ছিল, ও প্রতিবার বমির পর নেতিয়ে পরে ঘুমাত, কারণ শরীর থেকে লবণ বের হয়ে যেত।
বাবুকে হাসপাতালে ভর্তি করে সেলাইন আর ব্লাড দিয়ে অপারেশন এর জন্য প্রস্তুত করা হবে। ফুল এনেস্থিসিয়ার ঝুঁকি তো আছেই। ডাক্তার নিশ্চিত হবার জন্য ২য় বার USG করতে দিয়েছেন বেলা ৩ টায়। সন্ধ্যা ৭ টায় সার্জনকে দেখাতে পারলাম। উনি যত দ্রুত সম্ভব বাচ্চাকে ভর্তি করাতে বললেন। পরদিন সকাল পর্যন্ত আমরা সময় চেয়ে নেই। ফিরে এসে সবাই বাবুকে জড়িয়ে ধরে কেদেছি। এ যেন ছিল শেষ বিদায়। সেদিন রাতে আমি ৩ বার জ্ঞান হারাই। সারারাত কিভাবে কেটেছে তা লেখার ভাষা আমার জানা নেই। পরদিন সকালে বাবুর ব্যাগ গুছানোর সময় আবার জ্ঞান হারাই। অবশেষে বুকে পাথর বেধে বেলা ১২ টার দিকে বাবুকে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে।

২৪ ঘন্টার উপরে রাইফকে দুধ খেতে দেয়া হয়নি। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ওর গলা ভেঙে গিয়েছিল। ক্যানোলা ফিট করতে গিয়ে procedure room এ ৫ জন nurse এর সাথে এতটুকু বাচ্চার ধস্তাধস্তি আর চিৎকার আজও আমার কানে বাজে। গজ দিয়ে nurse রা fake nipple বানিয়ে দিয়েছিল। ক্ষুধার সময় ওইটাই বাবুর মুখে গুঁজে দিতাম। আল্লাহকে শুধু কেঁদে বলেছিলাম ওহ আল্লাহ আমার বুক খালি করোনা। ইন্নাল্লিলাহ হি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন পড়ে রাইফকে কোলে করে অপারেশন থিয়ে‌টারে দিয়ে অাসলাম।

রাইফকে ওটি তে নেয়ার পর বাইরে চেয়ারে নামাজ এ বসি। কারো সাথে কথা বলার মত মানসিক অবস্থা ছিলনা। শুধু আল্লাহ’র কাছে আমার সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছি। দুই হাত ফেলে চেয়েছি। দুইবার ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন পরে বাচ্চার বাঁচার আশা আল্লাহ এর কাছে ছেড়ে দিয়েছি, আমার মালিক আমাকে দুইবারই খালি হাতে ফেরত পাঠাননি আলহামদুলিল্লাহ্‌। আরেকবার বাবুর জন্মের সময় ওর বেঁচে থাকা নিয়ে খুব অনিশ্চয়তা ছিল। সেইদিন ও এই দুঅা পরে হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম।

যেই ব্যাপারটা আমাকে সবথেকে বেশী মানসিক কষ্ট দিয়েছে তা হল আমার প্রেগনেন্সির শেষ মাসে আমার উচ্চরক্তচাপের জন্য রাইফ পর্যাপ্ত খাবার ও পুষ্টি পাচ্ছিল না। শেষ ২ সপ্তাহ বাবুর কোন growth হয়নি। ডাক্তার বলেছিলেন অাগেভাগেই সিজারিয়ান করে বাচ্চা বের করবেন যাতে বাচ্চাকে মুখে খাওয়ান যায়। বুকটা ফেটে যেত যখন এত কিছু করেও এই সামান্য দুধ বাবুর পেটে থাকতো না। নিজেকে এত লাচার, এত অপরাধী‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ মনে হত! বুকের দুধ ও আমার বাচ্চাটা তেমন পায়নি। বাধ্য হয়ে ডাক্তার ফর্মূলা দেয়ার কথা বলেছেন। খালি ভাবতাম ওই সামান্য খাবারটুকুও কি আমার পাখিটার নসিবে জুটবে না?!! একবার মরিয়া হয়ে এত চাপাচাপি করেছিলাম যে নিপল দিয়ে ব্লিডিং হয়েছিল। সেই ছোট্ট রাইফ আমার আজ ওটিতে। ১ ঘন্টা পরে খবর আসলো যে মাকে খোঁজা হচ্ছে। ছুটে গেলাম। সার্জন জানালেন অপারেশন সফল হয়েছে। বিশাল বড় একটা বেডে বাবু একা শুয়ে, মুখে অক্সিজেন মাস্ক, এনেস্থেশিয়া হাল্কা হয়ে এসেছে, রাইফ নড়ছে। এক ঝলক দেখিয়ে নিয়ে গেল, আমার সন্তান বেচে আছে আলহামদুলিল্লাহ্‌। আল্লাহু আকবর।

ভাবলাম যাক ফাড়া বুঝি কেটেছে, বিপদ টলেছে। জানতাম না আমার সবর এর পরীক্ষার এখনো অনেক কিছু বাকি। খানিকবাদে আমার ডাক পরল post operative ward এ। বাবুর হাত, পা, নাক কিছু বাদ নেই নল ফিট করা থেকে। বাবুকে ঘুম পাড়ানো সম্ভব হচ্ছেনা, নার্সরা একা পারছেনা, তাই আমাকে বলা হলো রাইফকে কোলে নিয়ে বসতে, পুরা ওয়ার্ডে রোগীদের মাঝে আমি একা একমাত্র attendant. ছেলে ব্যথায় চিৎকার দিয়ে কাঁদছে। পেথেড্রিন পুশ করা হল। ঘুমাতে চায় বাবু, ঘুমাতে পারেনা, কারণ দুধ ত দেয়া যাবেনা, শুধু স্যালাইনই ভরসা।

রাইফকে কোলে নিয়ে আমি ঢুলছিলাম, নার্সরা আমাকে খুব judgemental look দিচ্ছিলেন। বলছিলেন বাসায় গিয়ে ঘুমাবেন। উনারা তো জানেন না আমি কত রাত ঘুমাইনি, এক পলকের ঘুম বাচ্চার বমির আওয়াজ আর কান্নায় ভেঙে যেত। এরিমধ্য বাবু হঠাৎ নাকে টান মেরে ফিস্টুলা খুলে ফেলে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নার্সরা জানালো কোন ধরনের এনেস্থেশিয়া ছাড়াই বাবুর নাকে আবার সেটা ফিট করা হবে, এত ছোট বাচ্চাকে এত ঘনঘন ‌এনেস্থেশিয়া দেয়া যাবেনা। সেই নলটা যে পেট পযন্ত যায় সেদিন প্রথম জানতে পারি। আমাকে বাইরে যেতে বলা হল, আমার বাচ্চার তীব্র চিৎকার যখন post operative ward ছাপিয়ে হলের বাইরে আসছিল সেদিনই আমি ভিতর থেকে মরে গেছি। ওয়ার্ড এ ফিরে আমার সন্তান এর ভীত বড় বড় চোখ আমার ভিতরের নরম অংশটাকে পাথর বানিয়ে দিয়েছে। সারা গায়ে নল জড়ানো ওই বাচ্চাটাকে নিতে আমার খুব ভয় করত। কেউ ওকে কোলে নিতে চাইতো না। নিষ্প্রাণ আমি ওকে কোলে তুলে নিতাম। কেবিনে দেয়ার পর ওর ডায়াপার বদলাতে আমি নার্সদের ডাকতাম। তারা বিরক্তি প্রকাশ করতেন কিন্তু আমার ওকে ধরতে ভয় লাগতো, পাছে কিছুতে টান লাগে যদি!

এর মাঝে কিছু কাছের মানুষ এর কথা, আচরনে এত কস্ট পেয়েছিলাম তা শুধু আমার রব-ই জানেন। উনার কাছ থেকেই শুধু এর উত্তম প্রতিদান আশা করি। আবার রাইফের দুধের জন্য সেই কান্না, আবার সেই ফেইক নিপেল টানা ৩৬ ঘন্টার সেই তড়পানি বাচ্চাটার। খালি নিপল টানতে টানতে বাবুর মুখে শুধু ফেনা জমত। সাথে আমিও ডানাভাঙা মা পাখির মত তড়পাচ্ছিলাম। টেস্ট বেসিসে শুরু হল নাকের নল দিয়ে মাত্র দুই এম. এল পানি, এরপর দুধ। বাবু নল দিয়ে তা পাস হওয়ার সময় চিৎকার দিয়ে কাঁদত। হাসপাতালের পানির কারনে বাবুর এর মধ্যে হল সিভিয়ার ডায়রিয়া। একা বাসায় আমি পেটে ব্যান্ডেজ বাধা এক বাচ্চা নিয়ে, আমার চারদিক ঘিরে খালি অস্থিরতা আর ভয়। বাচ্চা ঘুমাতে চায় কিন্তু loose motion এর কারনে বারবার তার ঘুম ভেঙে যায়। অপারেশন এর পরে রাইফ দুর্বল হয়ে যাওয়ায় খুব ধীরে দুধ টানত। এক সপ্তাহ পরে ডাক্তারের কাছে চেকাঅাপে নিলে ব্যান্ডেজ খুললে দেখলাম ছোট পেটে বড় একটা কাটা দাগ, দাগটা এখনো দেখা যায় বাবুর পেটে কিন্তু পরেছে কোন এক মায়ের অন্তরে।

আমার রাইফ এখন অনেক ভালো আছে আলহামদুলিল্লাহ্‌। রাব্বুল আলামীনের কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। আল্লাহ আমার পরীক্ষা নিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ্‌ কারণ উনি আমাকে এর যোগ্য মনে করেছেন। বিনিময়ে উনার ক্ষমা আর জান্নাতে একটু ঠাই ছাড়া আর কিছুই চাইনা ইনশাআল্লাহ।

আমার রাইফ এর জন্ম, ওকে নিয়ে আমার সংগ্রাম আমাকে বদলে দিয়েছে। Those experiences have made me a stronger person Alhamdulillah. জেনেছি শত অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করা মা ও বাচ্চার জন্য লড়তে শিখে যায়, বুঝেছি আমার পাশে কারা আছেন যারা বিপদের সময় পাশ থেকে‌ সরে যাবেন না, অন্তর দিয়ে বুঝেছি যত বড় বিপদআপদই আসুক না কেন রাহমানুর রাহীমের রাহমার ছায়া আমাদের চারদিক ছেয়ে থাকে।

ভালো থাকুক জান্নাতের ফুলগুলো তাদের মায়েদের কোলে।

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা