সন্তান মহান আল্লাহতা’আলার তরফ থেকে আমাদেরকে দেয়া শ্রেষ্ঠতম উপহার। কিন্তু কখনো কখনো নানা কারণে গর্ভধারণ বিলম্বিত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে সাময়িক গর্ভ নিরোধক ব্যবস্থা গ্রহনের প্রয়োজন হয়। যদিও গর্ভ নিরোধক পদ্ধতির বৈধতা নিয়ে আমরা অনেকেই দ্বিধান্বিত থাকি। এক্ষেত্রে যেটা আমাদের মনে রাখতে হবে খাদ্যাভাবের আশংকা বা দরিদ্রতার ভয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রন করা সর্বস্মমতভাবে হারাম।

আল্লাহ তা’আলা বলেন: وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَاقٍ ۖ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ ۚ إِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْئًا كَبِيرًا “দারিদ্রের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মারাত্নক অপরাধ।” Sura Al-Isra’, Ayah 31

তবে শারীরিক অক্ষমতা, মারাত্মক দূর্বলতা বা মায়ের এমন কোন রোগ যা গর্ভধারণের কারণে বেড়ে গিয়ে মার প্রাণনাশের আশঙ্কা তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ডাক্তার যদি সন্তান গ্রহন থেকে বিরত থাকতে বলেন তবে সর্বসম্মতভাবে তা জায়েয। এছাড়া দাম্পত্য জীবনকে গুছিয়ে নেয়া বা দাম্পত্য জীবনকে উপভোগ্য করা বা বিশেষ প্রয়োজনে কেউ যদি সাময়িকভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রন করেন সেটাও জায়েয। সুতরাং আযল পদ্ধতি, কনডম ব্যবহার, ইনজেকশন, পিল ইত্যাদি ব্যবহার করে সাময়িকভাবে গর্ভনিরোধ করা জায়েয ইনশাআল্লাহ। 

মাসিকচক্র সেইফ পিরিয়ড বা নিরাপদ সময়ের হিসাব

কিন্তু অনেকেই নিয়মিত কোন জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (যেমন পিল, কনডম ) গ্রহণে আগ্রহী না, অনেকে নিয়ম করে পিল খেতে ভুলে যান। সেক্ষেত্রে আপনি যদি প্রতি মাসের নিরাপদ দিনগুলো চিহ্নিত করতে পারেন তবে অন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই আপনি কিছুদিনের জন্য গর্ভ ধারণ বিলম্বিত  করতে পারেন। একে প্রাকৃতিক পরিবার পরিকল্পনা বা Natural method বা Rhythm method ও বলা হয়। এ পদ্ধতিতে Ovulation বা ডিম ফোটার সময়টা চিহ্নিত করে সেই সময় সহবাস থেকে বিরত থাকা বা স্বল্পসময়ের জন্য কোন গর্ভ নিরোধক ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। 

কিভাবে বুঝবেন কোন দিনগুলো নিরাপদ?

ক্যালেন্ডার পদ্ধতি

নারীদের স্বাভাবিক ঋতুচক্র প্রাকৃতিকভাবে নির্ধারিত। এতে এমন কিছুদিন রয়েছে, যাকে নিরাপদ দিন বা সেইফ পিরিয়ড বলা হয়। এ দিনগুলোতে সহবাস করলে গর্ভধারণের ঝুঁকি থাকে না। এই নিরাপদ দিনগুলো (Safe period) বের করার জন্য আগে আপনাকে ডিম্ব স্ফুরণের সময় বা অনিরাপদ দিনগুলো (Danger period) চিহ্নিত করতে হবে। 

এ পদ্ধতির জন্য প্রথমেই জানতে হবে মাসিক ঋতুচক্র নিয়মিত হয় কিনা। হলে তা কত দিন অন্তর হয়। আপনার পূর্ববর্তী ৬ মাসের মাসিকের হিসাব রাখতে হবে। প্রতি মাসের মাসিক শুরুর তারিখটি লিখে রাখলে ভাল। একে ক্যালেন্ডার পদ্ধতিও বলা হয়। যাদের ঋতুচক্র একদম নিয়মিত অথবা যাদের শেষ ৬ মাসের ঋতু চক্রের গড় দৈর্ঘ্য ২৬ থেকে ৩২ দিনের মধ্যে এবং সর্বনিম্ন ও দীর্ঘতম ঋতু চক্রের মধ্যে পার্থক্য ৭ দিন বা তার কম সময়ের, তারাই নিরাপদে এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবেন। সবচেয়ে কম যত দিন পর মাসিক হয়, তা থেকে ১৮ দিন বাদ দিতে হবে। পিরিয়ড শুরুর প্রথম দিন থেকে এ দিনটিই হলো প্রথম অনিরাপদ দিন। আবার সবচেয়ে বেশি যতদিন পর পিরিয়ড হয়, তা থেকে ১১ দিন বাদ দিলে মাসিক শুরুর প্রথম দিন থেকে এ দিনটিই হলো শেষ অনিরাপদ দিন। 

ধরুন আপনার পিরিয়ড ২৬ থেকে ৩০ দিন অন্তর হয়। তবে ২৬-১৮=৮, অর্থাৎ পিরিয়ড শুরুর পর থেকে প্রায় ৮ দিন আপনার জন্য নিরাপদ, মাসিক ভালো হওয়ার পর এ দিনগুলোতে কোনও পদ্ধতি ব্যবহার না করেও সহবাস অনায়াসেই করা সম্ভব। ৯ম দিন থেকে অনিরাপদ দিন শুরু। তাই এ দিন থেকে সহবাসে সংযত হতে হবে।

৩০ দিন হল দীর্ঘতম মাসিকচক্র। তাই ৩০-১১=১৯, অর্থাৎ ১৯তম দিনটিই হল শেষ অনিরাপদ দিন। ২০তম দিন থেকে আবার অবাধে সহবাস করা যেতে পারে। এতে গর্ভধারণের সম্ভাবনা নেই। 

অর্থাৎ প্রতি মাসের প্রথম ৮ দিন এবং শেষের ১১ দিন আপনার জন্য নিরাপদ। অন্যদিকে ৯ম থেকে ১৯তম দিনের মধ্যে অবাধ সহবাসের ফলে গর্ভধারন হতে পারে। 

ক্যালেন্ডার পদ্ধতির সাথে আরও দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করে ডিম্ব স্ফুরণের দিনটিকে আপনি আরও সুক্ষভাবে নির্ণয় করতে পারেন। 

শারীরিক তাপমাত্রার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ

ওভ্যুলেশনের সময় শারীরিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। কয়েক মাস প্রতিদিন তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এটি বুঝা যায়। মাসিক শুরুর প্রথম দিন থেকে প্রতিদিন একই সময়ে তাপমাত্রা মাপতে হবে। ঘুম থেকে উঠবার পরই মাপাটা ভাল। অভুলেশনের আগে শরীরের তাপমাত্রা সাধারণত ৯৭ থেকে ৯৭.৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট থাকে। অভুলেশনের পর প্রজেসটেরণ হরমোনের কারনে তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রী বেড়ে যায়। সাধারণত ডিম্ব স্ফুরণের ১-২ দিন পর তাপমাত্রার এই পরিবর্তন ধরা পড়ে। সাবধানতার জন্য তাপমাত্রা বাড়ার পরবর্তী ৩ দিন পর্যন্ত সহবাসে সংযত হতে হবে।

ভ্যাজাইনাল মিউকাস এর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ

এই পদ্ধতির দ্বারা ঋতু চক্রের বিভিন্ন সময়ে ভ্যাজাইনাল মিউকাসের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে অভুলেশনের সময় নির্ধারণ করা যায়। সাধারণত মাসিকের ১০ম-১২তম দিনে একটু ঘন আঠাল সাদাটে ভ্যাজাইনাল মিউকাস দেখা দেয় যা ধীরে ধীরে পরবর্তী ২-৩ দিনের মধ্যে ডিমের সাদা অংশের মত পাতলা স্বচ্ছ পিচ্ছিল মিউকাসে রূপ নেয়। এই সময়টাতেই অভুলেশন হয়। যে কয়দিন এই মিউকাস দেখা যায়, সেই দিনগুলো এবং পরবর্তী আরও ৩ দিন পর্যন্ত সহবাসে সংযত হতে হবে।

যদিও সবার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনগুলো সবসময় খুব ভাল বুঝা যায় না তবে অনেকেই বেশ ভালভাবে তা বুঝতে পারেন। এছাড়া বাজারে অভুলেশন কিট পাওয়া যায় যেটা দিয়ে পরীক্ষা করেও আপনি অভুলেশন হল কিনা নিশ্চিত হতে পারেন। ওভুলেশন হওয়ার পর ডিম্বাণু সাধারণত ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থাকে। কিন্তু শুক্রাণু ৩-৫ দিন পর্যন্ত নারীর যোনিপথে জীবিত থাকতে পারে। তাই অভুলেশনের আগে পরে মিলে লম্বা একটি সময় এই সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।  

আলহামদুলিল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ তাঁর সৃষ্টির প্রতিটি পরতে পরতে আমাদের জন্য চিন্তার খোরাক রেখে দিয়েছেন। ঋতুচক্র নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে একদিকে যেমন আপনি নিরাপদ দিনগুলো খুঁজে বের করতে পারেন, অন্যদিকে যারা বাচ্চা নিতে চান, তারা এই অনিরাপদ দিনগুলোতে বা Danger period এ সহবাস করলে তাদের গর্ভ ধারণের সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কারন এই ডেঞ্জার পিরিয়ডই আসলে Fertile period ।

মনে রাখবেন সেইফ পিরিয়ড শুধুমাত্র যাদের মাসিক নিয়মিত তাদের জন্য প্রযোজ্য। অনেক সময় অনিয়মিত পিরিয়ড বা পিরিয়ডের হিসাবে গন্ডগোল, অনিরাপদ দিনে সহবাসের ফলে প্রাকৃতিক গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ব্যর্থ হতে পারে। যে কারণে এ পদ্ধতির ফেইলিউর রেট অনেক বেশি, প্রায় ১৪ শতাংশ। তবে সঠিকভাবে গণনা করতে ও মেনে চলতে পারলে এটি অনেক বেশি সহজ ও আরামদায়ক। সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, এতে কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই।

তথ্যসূত্র

১. ইসলাম কিউএ
২. ইসলাম কিউএ বিডি
৩. Jeffcoate’s Principles of Gynaecology

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ মম জাংশন

সম্পাদনায়ঃ হাবিবা মুবাশ্বেরা

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা