প্রত্যেক মানুষ জীবনে কোন না কোন সময়ে দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগ অনুভব করে থাকে; আবার গর্ভাবস্থায় একজন নারীর মাঝে উদ্বিগ্নতা প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৮-১০ শতাংশ নারী তাদের গর্ভকালীন অবস্থায় ক্রনিক এংজাইটির শিকার হন। প্রেগনেন্সি একটি আবেগীয় সময়, এটি বিস্ময়কর কিছু নয় যে এই সময় নারীরা প্রচন্ড ভয় এবং উদ্বেগের মধ্য দিয়ে যায়।
অনেক সময় সাধারণ উদ্বেগ OCD(অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার) তে রুপান্তরিত হতে পারে৷ তখন চিন্তা গুলো না চাইলেও বার বার চলে আসতে থাকে যা অবসেশন বলে অভিহিত করা হয় আবার এই অবসেশনকে প্রতিহিত করার জন্য কম্পালশন করা হয় যা একই কাজের বার বার করা বোঝা। যেমন কেউ স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বার বার হাত ধুতে থাকে ইত্যাদি।
অনেকে গর্ভকালীন সময়ে এইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চায় না। কিন্তু শারীরিকভাবে পরিবর্তন আসার কারণে তা মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করবে এটি খুবই স্বাভাবিক। তাই এই সময়ে শারীরিক যত্নের পাশাপাশি মানসিক যত্নেরও প্রয়োজন। গর্ভবতী মায়েরা তাদের দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ কিভাবে কন্ট্রোল করতে পারে তা নিয়েই আজকে আলোচনা।
উদ্বিগ্নতা কি?
Anxiety বা উদ্বিগ্নতা হচ্ছে একটা প্রাকৃতিক আবেগ যখন বিপদ আসন্ন’ বা ‘খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে’ এই অনুভূতিগুলো এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন সব কিছু মিলিয়েই একটি অনুভূতি। ভয় এবং উদ্বেগের পার্থক্য হচ্ছে প্রথমটি নির্দিষ্ট একটি চেনা পরিবেশ বা বস্তুর প্রতি হঠাৎ সতর্ক হয়ে যাওয়া আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে অচেনা, মনের ভেতরের, বিবাদমান পরিস্থিতিতে হওয়া, অনির্দিষ্টভাবে সতর্ক হওয়ার অনুভূতি।
গর্ভকালীন সময়ে উদ্বিগ্নতার কিছু কারনঃ
প্রেগনেন্সির সময়ে শরীরে প্রচুর হরমোনের পরিবর্তন দেখা যায় ফলস্রুতিতে সাধারণ ভাবেই স্ট্রেস অনুভূত হয় যা ক্রমান্বয়ে এংজাইটিতে রুপান্তরিত হয়। বিভিন্ন নারীর ক্ষেত্রে এর তারতম্য দেখা যায়। শারীরিক কারণ ছাড়াও অনেক সময়ে বাইরের পরিবেশও উদ্বিগ্নতার কারণ হয়ে থাকে। উদ্বিগ্নতা বা এংজাইটির কিছু লক্ষণ:
১। অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তা করা।
২। নিজের স্বাস্থ্য এবং বাচ্চার স্বাস্থ্য নিয়ে ক্রমাগত চিন্তা করতে থাকা।
৩। পরিপূর্ণ মনোযোগ ধরে না রাখতে পারা
৪। খিটখিটে মেজাজ থাকা
৫। হ্দস্পন্দন বেড়ে যায়, বুক চেপে আসে, ঘাম হওয়া
৬। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া
৭। মাসল টেনশন অনুভব করা
৮। ভুলে যাওয়া
৯। প্যানিক এটাক হওয়া।
গর্ভকালীন সময়ে এংজাইটি যেসব কারণে হয়ে থাকে
গর্ভকালীন সময়ে এংজাইটি কিছু কারণে হয়ে থাকে যেমন:
১। শারীরিক পরিবর্তনে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারা
২। বাচ্চার স্বাস্থ্য নিয়ে সবসময় চিন্তা করতে থাকা
৩। ভবিষ্যতে একজন আদর্শ মা হয়ে পারবে কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তা
৪। দায়িত্ব বেড়ে যাওয়া নিয়ে ভয়
৫। আশে-পাশের মানুষের ব্যাপারে বিভিন্ন চিন্তা
৬। বাচ্চা প্রসব নিয়ে ভয় পাওয়া
৭। পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে করণীয় কাজ না জানা
৮। নতুন লাইফ স্টাইলে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া ইত্যাদি
গর্ভকালীন সময়ে নিজেকে দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখতে যে জিনিসগুলো অনুসরণ করা যেতে পারেঃ
১। ইতিবাচক চিন্তা করা। এই সময়টা নেতিবাচক চিন্তা আমাদের মনে আসতে পারে। একটু খেয়াল করেই দেখবেন এইসব চিন্তা গুলো আসলে অহেতুক এবং ভিত্তিহীন। তাই এই সময় বেশি বেশি ইতিবাচক চিন্তা করুন। নেতিবাচক চিন্তা আসলে মনকে তৎক্ষনাৎ থামিয়ে দিন। ইতিবাচক কথা বলে এমন মানুষদের সাথে কথা বলুন।
২। শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম। অতিরিক্ত উদ্বেগ থাকলে শারীরিক ভাবে ব্যাথা অনুভব হতে পারে এবং তা অতিরিক্ত বেড়ে গিয়ে প্যানিক এট্যাকে রুপ নিতে পারে৷ এমতাবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম আপনাকে শান্ত করবে। বুকে বা মাথায় যেখানে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে, সেখানে হাত রেখে ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিন এবং কিছুক্ষণ ধরে রেখে আবার ধীরে ধীরে ছাড়ুন। একই পদ্ধতিতে পুনরায় কিছুক্ষণ করলেই দেখা যাবে দুশ্চিন্তা কমে গেছে। শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সাপ্লাই আপনাকে শান্ত করবে।
৩। পর্যাপ্ত পানি পান করা৷ গবেষণায় দেখা গেছে উদ্বেগের সময় পানি পান করলে তা স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। তাই হাতের কাছে সমসময় পানি রাখুন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পান করুন। শরীরে কখনো পানি শূন্যতা হতে দিবেন না।
৪। হালকা শারীরিক ব্যায়াম। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হালকা ব্যায়াম করুন এতে আপনার মেজাজ ফুরফুরে থাকবে। এছাড়াও ঘরের ভিতর হাটাহাটি বা বিকেলে বাইরের পরিবেশে হাটতে যাওয়া মন ভালো রাখবে।
৫। বই পড়া। এ সময়ে বিভিন্ন রকম প্রেগনেন্সি সম্পর্কিত বই পড়ে জ্ঞানার্জন করতে পারেন। অনেক সময় প্রথমবার মা হওয়া নারীদের জ্ঞানের স্বল্পতা থাকতে পারে৷ তাই নিজের শারিরীক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন। এছাড়াও নিজের পছন্দের বই পড়া যেতে পারে যা মনকে ভালো রাখবে।
৬। নিজে কষ্ট চেপে না রেখে নিকট কারো সাথে শেয়ার করা। অনেক সময় অহেতুক মন খারাপ বা দুশ্চিন্তা দেখা দিতে পারে৷ এই সময়ে নিজের মধ্যে এগুলো চেপে না রেখে প্রকাশ করতে হবে। ভেন্টিলেশন একটি শক্তিশালী থেরাপিউটিক প্রসেস, এর মাধ্যমে ক্লায়েন্ট নিজের অজান্তের একটি থেরাপি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়।
৭। ধর্মের দিকে মনোযোগ দেওয়া। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকলে মানুষের মনে একটা স্বয়ংক্রিয় ভালো লাগা তৈরী হয় এবং ভরসা জন্মে- যা মানুষকে তাৎক্ষনিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেয়। এছাড়া সর্বশক্তিমানে বিশ্বাস মানুষের ভবিষ্যৎ ভয় দূর করে আশান্বিত করে।
৮। লেখালেখি করা। অনেক সময় লেখালেখি মানুষের দুশ্চিন্তা চ্যানেল করে বের করে দেয়। আবার এক্ষেত্রে অন্যের জাজমেন্টাল দৃষ্টিভংগীর শিকার হওয়া লাগে না। নিজের আবেগ গুলো সম্পর্কে জানা যায় এবং আবেগ নিয়ন্ত্রন করা যায়।
৯। কাউন্সেলিং নেওয়া। এই সময়ে একজন ভবিষ্যৎ মা একজন প্রফেশনালের কাছে নিয়মিত কাউন্সেলিং নিতে পারেন। এতে করে বাচ্চা জন্মের পর পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশনে পরার আগেই তা দূর করা যায়৷ এছাড়াও এই সময়ে কাপল কাউন্সেলিং এবং ফ্যামিলি কাউন্সেলিং নেওয়া যেতে পারে। একজন বাচ্চা জন্মের জন্য যেমন মায়ের নিজের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা প্রয়োজন তেমনি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের এক্ষেত্রে সাহায্য করা প্রয়োজন, পারিবারিক কাউন্সেলিং এক্ষেত্রে অতুলনীয় ভূমিকা রাখতে পারে।
(লেখিকা The Nafs Psychological & Spiritual Wellness Center এর ফাউন্ডার ও সিইও)
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ FabFitFun