বিয়ের প্রায় চৌদ্দমাস পর
রোজার দুয়েকদিন আগে থেকে শরীরটা তেমন ভালো লাগছে না। বসা থেকে উঠলেই চোখে অন্ধকার দেখি। সকালে দিকে শরীর খুব দুর্বল লাগে আর বমি পায়। ফারজানাপু বললো, প্রেগন্যান্সি চেক করে দেখ। আমার মাথায় অবশ্য সেসব চিন্তে নেই। করোনায় যখন স্কুল বন্ধ, সে সময়টায় কি যে ডিপ্রেশনে ছিলাম! কারো মা হওয়ার গল্প পড়ে কতো যে কেঁদেছি তার ইয়ত্তা নেই। একটা সময় আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ এক্সপেকটেশন কষ্ট বরাবরই আরো বাড়িয়ে দিতো
আজ করবো, কাল করবো ভাবতে ভাবতে চতুর্থ রোজায় টেস্ট করেই ফেললাম। পজিটিভ❤️ তবে আমি পজিটিভ শুনেই বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। চারদিন হলো হিফজ শুরু করলাম। এখন হিফজের কি হবে? আবার আমি এতো কষ্ট সইতে পারবো তো! ফারজানাপুকে বললাম, আম্মু কল দিয়ে আব্বুকে আর আমার হাসবেন্ডকে বললো। সবাই খুশি, আমিই শুধু টেনশন করছি। সবে সতেরো পেরোনো আমার “মা” হওয়াটা বড্ড কঠিন জার্নিই মনে হচ্ছিলো।
তখন মিতাপার সাথে নতুন নতুন কথা হতো। একদিন আপাকেও বললাম, সাথে আমার টেনশনের কথাও জানালাম। আপা একজন মোটিভেশনাল বক্তা তবে বেশ শক্ত । মানে মাঝেমধ্যে রাগ উঠলে কঠিন কঠিন কথা বলেন৷ তাই আমি ভয়ও পাই তাকে। কখন না জানি আমার মেসেজ আনসীন রেখে দিবেন। সে এক বিশাল দুশ্চিন্তার বিষয়৷
যাকগে সেসব কথা বাদ দেই। আপা বললো, আপনি কি কখনোই বাচ্চা হোক চাইতেন না? হয়তো কিছুদিন পর চাইতেন। তাহলে এখন হলেও সমস্যা কি! আমি নিশ্চিন্ত হলাম এতোদিনে। এবার শুরু হলো আমার প্রেগন্যান্সির সুখ-দুঃখের এক মিশেল জার্নি
এই রোজার পূর্ব প্রস্তুতি মোটামুটি বেশ ভালো ছিলো। প্রায় ২ মাস আগে থেকেই নানারকম প্ল্যান করে রেখেছিলাম। কিন্তু💔 এবার কিছুই পারলাম না৷ রেগুলার নামাজেই ক্লান্ত হয়ে যেতাম। কুরআন তিলাওয়াতও অনেক কম হচ্ছিলো, ইফতারের পর সবচেয়ে বেশি কষ্ট হতো। মনে হতো, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। মাঝেমধ্যে সেহরি শেষ করার পর বমি হয়ে যেতো। কি যে কষ্ট লাগতো তখন! প্রথম তিন মাস এভাবেই কাটলো।
প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই আমি প্রচন্ড ব্যস্ত এজন্য কষ্টগুলো বেশি অনুভব হতো না। দু বেলা হিফজ ক্লাস, ২ ঘন্টা আরবি শেখার ক্লাস, কয়েক ঘন্টা এ দু ক্লাসের পড়াগুলো প্রস্তুতিতেই চলে যেত, এছাড়া ছিলো নাজেরা ক্লাস আর মাঝেমধ্যে স্কুলের পড়াশোনা (উইথ লট’স অফ ফাঁকিবাজি)। আব্দুল্লাহ আসার ২ মাস আগ পর্যন্ত এভাবেই চলেছে। শেষে আর না পেরে শুধু হিফজ ক্লাস চালু রেখে বাকি সব অফ করে দিয়েছিলাম।
৩ মাস পার হওয়ার পর আলহামদুলিল্লাহ কিছু টুকিটাকি সমস্যা ছিলো শুধু। দাঁত দিয়ে রক্ত পড়তো, মাথা ব্যথা হতো। মাঝে প্রায় ১৭ দিন পেঁয়াজ, রসুন, তেল মসলার গন্ধ সইতে পারতাম না । আহা! কতো কান্না করেছি সে সময়টায়! নানারকম সবজি সিদ্ধ করে লবণ আর মরিচ দিয়ে ভর্তা করে খেতাম ঐ কয়েকদিন। এরপর আর কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ সহজ করে দিয়েছিলেন।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে কয়েকজন আপু মারকাজুন নাহদায় দেখা করি। দেখা হয় মিতাপু, ফারজানাপা, মাহমুদাপু, ফাতিমাপু, এছাড়া উসতাজাদের সাথে। আমার প্রিয় উসতাজার সাথেও অনেএএএক গল্প হয় সেদিন। আমাকে বকে দিয়েছিলেন, কারণ আমি সারাদিন খাটে বসে থাকতাম তখন। মিতাপু সব গোমর ফাঁস করে দিয়েছিলেন😁 জীবনের সুন্দর দিনগুলোর মধ্যে একটি দিন💌
মারকাজ থেকে ফিরে ভদ্র হয়ে গিয়েছিলাম। হিফজ ছাড়া সব পড়া অফ করে দিলাম। সকাল-বিকাল হাঁটা শুরু করলাম নিয়মিত। নরমাল ডেলিভারির জন্য উপকারী এমন কিছু এক্সারসাইজ করতাম দু/তিন বেলা। উসতাজার বকা কাজে দিয়েছিলো। কেনই বা কাজে দেবে না! আমি দুনিয়াতে যেসব (জীবিত) মানুষের মতো হতে চাই তিনিও তাদের অন্যতম।
নভেম্বরের মাঝামাঝিতে এসএসসি পরীক্ষা। সারাবছর তো কিছুই পড়িনি। মনে মনে, ফেল করি কিনা সেই ভয়ে ছিলাম। তখন ৯ মাস চলছিলো। তাই দুআ করছিলাম যেন আব্দুল্লাহ তখনই দুনিয়ায় এসে পড়ে (কি ফাঁকিবাজি দুআ! হি হি!)। কিন্তু যেহেতু আসলোই না, কি করার! ক’দিনের জন্য হিফজের সবক অফ রেখে দিন-রাত পড়া শুরু করলাম৷ মাঝেমধ্যে রাত ১২ টা, ১ টা পর্যন্ত পড়তাম। প্রায় সারাদিনই পড়েছি ঐ ১০ দিন৷ পরীক্ষা হলো, আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, তখন পর্যন্ত ক্লাসের কেউ(তিনজন বান্ধবী জানতো শুধু) আমার প্রেগন্যান্সির কথা জানতো না। অথচ পরীক্ষা শেষ হওয়ার ২০ দিন পর আব্দুল্লাহর জন্ম।
পরীক্ষা শেষ হলো। সেদিনই খিদমাহ হসপিটাল গেলাম। প্রায় দু ঘন্টার পথ। সেখানে বাবুর হার্টবিট ভালো না পাওয়ায় ডক্টর দুদিনের মধ্যে পেইন না উঠলে সিজারের জন্য আসতে বললো। এর আগে পুরো প্রেগন্যান্সি যাকে দেখিয়েছি তিনি তো বিনা কারণেই আমাকে সিজারের ডেট নিয়ে যেতে বলেছিলেন। সেদিন আসার পথটা কান্না করতে করতে এসেছি।
এরপর থেকে শুরু আমার ভয়ংকর অপেক্ষা। বাবুর নড়াচড়া ভালো থাকায় দু ডক্টরকেই দেখানো বাদ দিয়েছি। অপেক্ষা শুরু হলো নরমালি পেইন উঠার। মন খারাপ আর কান্নাকাটি করে দিন পার করছিলাম। তখন সব পড়াই বাদ। মন বসতো না পড়ায়। ডক্টর না দেখালেও রেগুলার চেকাপ করতাম। শেষের দিকে একবার গ্লুকোজ বেড়ে গেলো। তারপর ভাত, মিষ্টি এসব খাওয়া কমিয়ে দিলাম। তখন মিষ্টি এতো পছন্দের ছিলো! কিন্তু…💔
ডিসেম্বরের ৬ তারিখ ডিউ ডেট৷ কোনো পেইন নেই, লক্ষণও নেই। এরপর ৮ তারিখ আল্ট্রা করালাম। পানি সামান্য কম। ৯ তারিখ হাসবেন্ড আসলেন৷ আল্ট্রা রিপোর্ট নিয়ে তাঁর দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। সবাই বললো ১০ তারিখ দেখে, ১১ তারিখ হসপিটাল ভর্তি হয়ে যেতে। সিজার করে ফেলবে।
হাসবেন্ড জানে, আমি সহজে রাজি হবো না। তাই ইমোশনালি বোঝাচ্ছিলো। “দেখো! এটা আমাদের প্রথম বাচ্চা। কতো চেষ্টার পর আল্লাহ পাঠালো। তুমি এমন করো না। বড়দের কথা অমান্য করো না”। এদিকের কারোই পেইন ইনডিউসের বিষয়ে সামান্যতম ধারণাও নেই। এমনকি হসপিটালগুলোতেও না। আমি ডিপ্রেশড। কেউ বিশ্বাসই করতে চাচ্ছে না যে ন্যাচারালি পেইন না উঠলে পেইন ইনডিউস করে নরমালে ডেলিভারি হয়। ৯ তারিখ রাতে আমি সুমাইয়া আপুর সাথে কথা বললাম এসব বিষয়ে। হাসবেন্ড ঘুমায়, আর আমি একেকজনের সাথে পরামর্শ করি। কোনো পথই পাচ্ছিলাম না। রাতে দশটার দিকে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছি।
রাত বারোটায় হালকা ব্যাকপেইনে উঠে গেলাম। তবে লেবার পেইন উঠেছে এমনটা বিশ্বাস হলো না। কারণ এর আগে কয়েকবার এমন হয়েছে কিন্তু শেষে আশা ভেঙেছে। হালকা হলেও ঘুম আসছিলো না। রাত দুইটায় আম্মু কল দিলো ঐ রুমে যেতে। গেলাম। আম্মুকে বলায় আম্মুও বললো যে লেবার পেইনই উঠেছে। এরপরে আম্মু ডিম সেদ্ধ করে দিলো, খেজুর আর পানি খাচ্ছিলাম একটু পর পর। আর পাশাপাশি স্কোয়াটিং করছিলাম।
পেইন বাড়তে থাকলো। ভাই আর হাসবেন্ডকে ডাক দিলাম। ততক্ষণে ফজরের আজান হয়ে গেলো। সবাই নামাজ পড়ে নিলাম। মুহাম্মদ গিয়ে অটো নিয়ে আসলো। হসপিটাল ব্যাগ আগে থেকেই রেডি ছিলো৷ সব রিপোর্ট আর ব্যাগ নিয়ে আমরা বের হলাম
আমার পেইনও তখন প্রতি ৫ মিনিট গ্যাপে ২/৩ মিনিট ধরে হচ্ছিল। আর এ সময়েই হসপিটাল যেতে বলা হয়। ঐ ভোরে অটোতে করে হসপিটাল গেলাম।
যাওয়ার পর নার্স পিভি চেক করে বললো সার্ভিক্স নরম হয়নি, একটুও খোলেনি। যেহেতু ডেটও পার হয়ে গিয়েছে তাই চাইলে সেখানকার পুরুষ ডক্টরের কাছে ইমার্জেন্সি সিজার করতে, নইলে ৯ টা পর্যন্ত গাইনি ম্যামের অপেক্ষা করতে। আমরা অপেক্ষা করলাম। কেবিনেই হাঁটাহাঁটি, স্কোয়াটিং সহ আরও কিছু ব্যায়াম করছিলাম। আর যখন বেশি খারাপ লাগছিলো তখন বিছানায় সিজদার ভঙ্গিতে শুয়ে ছিলাম। ধীরে ধীরে পেইন অনেক বাড়লো, এমনকি আমি শুধু বলছিলাম, “আল্লাহ গো আমি আর পারবো না”(মনে মনে সিজার হয়ে যাক ভাবছিলাম😁)।
সাড়ে ৯ টা বাজলো, আমাকে হুইল চেয়ারে করে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। আলহামদুলিল্লাহ এই আড়াই/তিন ঘন্টায় আমার পিভি পুরো ৯/১০ সেমি. খুলে গিয়েছিলো। ডক্টর আমাকে লেবার রুমে নিয়ে যেতে বললেন। আমার তো বিশ্বাস হচ্ছিলো না, আমি বারবার নার্সকে বলছিলাম, সত্যিই পিভি ১০ সেমি. খুলেছে? নার্স বললো, হ্যাঁ মাথা দেখা যাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ ১০ টার দিকে আব্দুল্লাহ হলো।
আল্লাহ রহম করেছিলেন বলেই নরমাল সম্ভব হয়েছিলো। কথা ছিলো যে গাইনি ডক্টর সকাল ৯ টায় আসবে তখন সিজার করে ফেলবে। আলহামদুলিল্লাহ ততক্ষণে জরায়ু মুখ খুলে গিয়েছে, তখন চাইলেও সিজার করা সম্ভব না। মিডওয়াইফ আর নার্স দুজন অনেক ভালো ছিলো৷ আমি এখনো উনাদের জন্য দুআ করি।
আব্দুল্লাহ হওয়ার পর থেকে এইম ইন লাইফ হয়ে গেলো, ” আমি বড় হয়ে মিডওয়াইফ হবো ” হিহি!
কৃতজ্ঞতার মাথা নুয়ে আসে। কত্তো বড় হয়ে গিয়েছে লেখাটা। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা অনেক বেড়ে গিয়েছে আব্দুল্লাহ হওয়ার পর। আমি তো কান্নাকাটি করতাম ডিসেম্বরের শুরু থেকে। ছেলেটা এতো লেট করে দুনিয়ায় আসলো!! আল্লাহ সহজ করে দিয়েছিলেন।
অসম্ভব সুন্দর এক জার্নি । মনে পড়ে সেসব সুন্দর মুহূর্তগুলো। ইচ্ছে করে, বারবার মা হই। আল্লাহ তৌফিক দিন অনেকগুলো নেককার সন্তানের মা হওয়ার।
আলহামদুলিল্লাহ।
কৃতজ্ঞতা সুমাইয়া আপু, সুমাইয়া আপার জন্য। আপুটা প্রতি মুহূর্তে হেল্প করেছেন নিজের অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান দিয়ে। আর সুমাইয়া আপা হেল্প করেছেন তার সুন্দর চিন্তাগুলো দিয়ে, মাঝেমধ্যে বকা দিয়ে। মাতৃত্ব গ্রুপ, গ্রুপের ডক্টর আপুদের জন্যেও কৃতজ্ঞতা আর দুআ। শেষ মাসের দুঃশ্চিন্তাময় দিনগুলোতে মাতৃত্ব গ্রুপের আপুরা প্রচুর সাহায্য করেছেন।
লিখেছেন: আহলিয়া জাহিদ