সাধারনত প্রেগন্যান্সির ২৮ সপ্তাহের কাছাকাছি অনেক মায়ের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। ডায়াবেটিস আছে কিনা সেটা ব্লাডটেস্টের মাধ্যমে বোঝা যায়। রক্তে গ্লুকোজের পরিমান প্রয়োজনের তুলনায় বেশী থাকাটা ডায়াবেটিসের উপস্থিতি নির্দেশ করে।
প্রেগন্যান্সিতে ডায়াবেটিস কি?
প্রেগন্যান্সির ডায়াবেটিস বিশেষ এক ধরনের ডায়াবেটিস, যেটি কিনা কেবল প্রেগন্যান্সিতেই হয়ে থাকে। হরমোনের লেভেল ও নতুন শারিরীক পরিবর্তনের কারনে মায়ের শরীর সঠিক পরিমান ইনসুলিন তৈরী করতে ব্যার্থ হয়। ইনসুলিন এক ধরনের হরমোন, যা অগ্ন্যাশয়ে তৈরী হয়। এটি শরীরকে রক্তের গ্লুকোজের লেভেল নিয়ন্ত্রন করতে সাহায্য করে। যখনি শরীর যথেষ্ট পরিমান ইনসুলিন উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়, রক্তে গ্লুকোজের পরিমানও বেড়ে যায়। যাকে ডাক্তারী পরিভাষায় জ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিস মেলিটাস বলা হয়।
গর্ভস্থ শিশুর উপর প্রভাব
প্রেগন্যান্সিতে ডায়াবেটিস যদি সঠিক সময়ে ধরা না পড়ে বা অনিয়ন্ত্রিত থেকে যায়, তবে মায়ের শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা অনেকগুন বাড়িয়ে দেয়। এই অতিরিক্ত গ্লুকোজ প্রভাব ফেলে বাচ্চার ওজনের উপর। বাচ্চার ওজন যদি ৪ কেজি বা ৯ পাউন্ডের বেশী হয়ে যায়, তবে বাচ্চা ডেলিভারী কঠিন হয়ে পড়ে। আবার মায়ের প্রেগন্যান্সির ডায়াবেটিস, বাচ্চার ভবিষ্যতে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে।
উপসর্গ
সাধারনত এইধরনের ডায়াবেটিসে তেমন কোন লক্ষন থাকে না। ব্লাডটেষ্ট করলেই ধরা পড়ে ডায়াবেটিস আছে কিনা। তবে অতিরিক্ত ক্লান্তিভাব, ঘনঘন তৃষ্ণা পাওয়া, প্রস্রাবের বেগ ঘনঘন হওয়া, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা মনে হওয়া- এই ধরনের উপসর্গ দেখা যায় কখনো কখনো।
যেসব কারনে প্রেগন্যান্সিতে ডায়াবেটিস হতে পারে
- কারো প্রি-ডায়াবেটিস থেকে থাকলে।
- আগের প্রেগন্যান্সিতে ডায়াবেটিস থাকলে।
- নিকট আত্মীয় যেমন বাবা বা মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে।
- পলিসিস্টিক ওভারী সিন্ড্রোম থাকলে।
- অতিরিক্ত ওজন হলে (বি এম আই ৩০ এর বেশী হলে)।
- ৩৫ বছর বা উর্ধে বয়স হলে।
- ইতিমধ্যে ৪ কেজি বা ৯ পাউন্ডের বেশী ওজনের বাচ্চা জন্ম দিলে।
কিছু দেশের লোকজন এমনিতে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবন। যেমনঃ সাউথ এশিয়ান, আফ্রিকান, মধ্যপ্রাচ্যের লোকজন। শারীরিক গড়ন, খাদ্যাভাস এইগুলোর উপরও নির্ভর করে।
কিভাবে প্রেগন্যান্সীর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন সম্ভব?
ডায়াবেটিস শুনেই আঁতকে উঠার কোন কারন নেই। এর মানে এই না যে এটা নিয়ন্ত্রনযোগ্য না বা বাচ্চারো ডায়াবেটিস হবেই। স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল বা জীবন অাচরণ মেনে চললে এটা সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রনযোগ্য।
ডায়েট
স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকা অনুসরন করুন। তিন বেলার বড় তিনিটি খাবারকে ভেঙ্গে পাঁচটা খাবারে পরিনত করুন। একেবারে বেশী না খেয়ে পরিমানে অল্প করে বেশী বার খান। এটি রক্তের গ্লুকোজের লেভেল নিয়ন্ত্রনে রাখতে সাহায্য করবে। শর্করার পরিমান কমিয়ে প্রোটিন, হেলদি ফ্যাটের ইনটেক বাড়ান। প্রচুর শাক-সবজি, সালাদ যোগ করুন প্রতিদিনের ডায়েটে। মিষ্টি জাতীয় খাবারে লাগাম টানুন। দুধ বা দুধ জাতীয় খাবার অবশ্যই রাখুন।
প্রেগন্যান্সিতে ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখুন
প্রেগন্যান্সিতে এক একজন এক একরকমের ওয়েট গেইন করে, যেটা নির্ভর করে গর্ভধারনের আগে মায়ের ওজন কত ছিলো, তার উপর। কতটুকু ওয়েট গেইন আপনার জন্য স্বাস্থ্যকর তা আগেই ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিন। এতে মাত্রাতিরিক্ত ওজন গেইন করা থেকে দূরে থাকতে পারবেন।
শারীরিকভাবে এক্টিভ থাকুন
জটিলতাবিহীন সাধারন প্রেগন্যান্সিতেও যতবেশী এক্টিভ থাকবেন, ততই ডেলিভারীর জন্য উত্তম। আর বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস থাকলে এক্টিভ থাকাটা আবশ্যক। প্রতিদিনের ফিজিক্যাল এক্টিভিটি রক্তের গ্লুকোজের পরিমান নিয়ন্ত্রন করে। দুপুরের এবং রাতের খাবারের পর হাঁটা জরুরী। এছাড়া প্রেগন্যান্সীর ট্রাইমিষ্টার বুঝে হালকা এক্সারসাইজ করা দরকার।
বাড়ীতে নিয়মিত গ্লুকোজ লেভেল চেক করুন
বাড়ীতে ব্লাড টেষ্ট করার কিটস রাখুন, যা আপনাকে সকালে খালিপেটে, বিভিন্ন সময়ে খাবার পর গ্লুকোজ লেভেল পরিমাপ করতে সাহায্য করবে। নিয়মিত ডাক্তারের কাছে চেক-আপ ছাড়াও প্রতিদিনের টেস্ট আপনাকে সাহায্য করবে শারীরিক ব্যাপারে আপটুডেট থাকতে।
প্রয়োজনে ইনসুলিন নিন
যদি শরীরে কোনভাবেই গ্লুকোজের লেভেল ঠিক না থাকে, তাহলে প্রয়োজনবোধে ডাক্তারের পরামর্শে বাইরে থেকে ইনসুলিন নিন। খাবারের পর অন্তত আধাঘন্টা হাঁটা গ্লুকোজের লেভেল নিয়ন্ত্রনে রাখলেও, সকালে খালি পেটে গ্লুকোজ অনেকেরই নিয়ন্ত্রনে থাকে না। সেক্ষেত্রে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ইনসুলিন নিলে সকালের খালিপেটের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রন সম্ভব।
প্রেগন্যান্সির ডায়াবেটিস সাধারনত বাচ্চার ডেলিভারীর পর ভালো হয়ে যায়। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে কারোটা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের মতো থেকে যায়। সন্তান প্রসবের পর ডায়াবেটিস না থাকলে তিন/চার মাস পর আবার ফলো আপ করা প্রয়োজন। সাধারনত একবার প্রেগন্যান্সিতে ডায়াবেটিস হলে পরবর্তী প্রেগন্যন্সিতেও হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই এই ডায়াবেটিস, ডেলিভারীর পর চলে গেলেও প্রপার ডায়েট, নিয়মিত এক্সারসাইজ, মোটকথা স্বাস্থ্যকর জীবন অাচরন মেনে চলা উচিত।
সম্পর্কিত লেখা: প্রসব-পরবর্তী যত্ন নিয়ে বিস্তারিত
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সাবেরা সাঈদা খান
M.B.B.S (DU), MPH (Reproductive & Child Health)(NIPSOM),
Diploma in Ultrasonogram
Lecturer, Ibn Sina Medical College
Consultant Sonologist, Trust Medical Care
ছবি কৃতজ্ঞতা: GoodRx