সন্তান মানবজীবনের এক আনন্দময় অনুভূতি ও আল্লাহ তায়ালার দেয়া বিশেষ আমানত। বিবাহিত দম্পতির কোলে সন্তান আসবে – এটা যেমন অনুমিত, তেমনিভাবে প্রচুর দম্পতি আছেন যারা একটি সন্তানের জন্য সারাজীবন বুকে হাহাকার বয়ে বেড়ান। বর্তমান সময়ে বন্ধ্যাত্ব একটি প্রকট সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে

আশার কথা হলো, বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা আছে। সমস্যা নির্ণয় করে উপযুক্ত নিয়মে চিকিৎসা নিলে বন্ধ্যাত্ব নিরাময় সম্ভব। বন্ধ্যাত্ব নিরাময়ে ইসলামি সুন্নাহভিত্তিক একটি চিকিৎসা পদ্ধতির নাম হিজামা।

বন্ধ্যাত্ব কী?

শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার দরুন সন্তান ধারণের অক্ষমতাকেই বন্ধ্যাত্ব বলে। মেডিকেল সায়েন্স’র ভাষ্যমতে, ১২ মাস ধরে সেক্সুয়াল রিলেশন চালিয়ে যাবার পরেও যদি গর্ভধারণ সম্ভব না হয় তখন সেই অবস্থাকে বন্ধ্যাত্ব বলা হয়। এক্ষেত্রে শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি লাইফস্টাইলের বিভিন্ন প্রভাবও থাকতে পারে।

শারীরিক ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীদের সমস্যার ধরণ আলাদা হলেও লাইফস্টাইলের ব্যাপারে দুজনেরই মিল থাকে। যেমন স্ট্রেস বা উদ্বেগ, সুষম খাবারের ঘাটতি, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাগ, কায়িকশ্রম না করা, মানসিক প্রফুল্লতার অভাব, অতিরিক্ত বয়স ইত্যাদি।

পুরুষ ও নারীর বন্ধ্যাত্বের স্বরূপ/পার্থক্য

যেহেতু শারীরিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে নারী ও পুরুষ আলাদা হয়, তাই তাদের বন্ধ্যাত্বের ধরণও আলাদা। সেক্ষেত্রে পার্থক্য অনুসারেই চিকিৎসা নেয়া হয়।

পুরুষের ক্ষেত্রেবেশিরভাগ ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্বের মূল কারণ হয় বীর্যের (semen) গুণগত মান ভালো না হওয়া।সহবাসের সময়পুরুষের যৌনাঙ্গ থেকে বের হওয়ার তরল পদার্থই হল বীর্য যেখানে সন্তান জন্মদানের প্রয়োজনীয় উপাদান শুক্রানু (sperm) থাকে।

শুক্রাণু বা স্পার্মের সমস্যার তিনটি ধরন থাকে

  • শুক্রাণুর সংখ্যা বা sperm count কম থাকা
  • দুর্বল শুক্রাণু, যেটা সাতার কেটে স্ত্রী জরায়ুতে পৌঁছে ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারেনা
  • শুক্রানুর আকৃতি (shape) না হওয়া, যার কারণে এটি ঠিকমত সামনে যেতে এবং ডিম্বানু নিষিদ্ধ করতে পারে না

এছাড়া পুরুষের টেস্টোস্টেরন হরমোন অসামঞ্জস্যতাও পুরুষের বন্ধ্যাত্বের কয়েকটি বিশেষ দিক।ক্ষেত্রবিশেষে অণ্ডকোষজনিত সমস্যা থাকতে পারে।

নারীদের ক্ষেত্রে সন্তানধারণের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় ফ্যালোপিয়ান টিউবজনিত সমস্যা। এই টিউবের মূল কাজ হচ্ছে ডিম্বাশয় থেকে জরায়ুতে ডিম্বাণু বহন করে নিয়ে যাওয়া। কোনো কারণে যদি এই টিউবে পরিবর্তন আসে অথবা টিউব বন্ধ থাকে, তাহলে ডিম পরিবহনের কাজটি বাধাগ্রস্ত হয়। ফলস্বরূপ, সন্তানধারণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় না।

তাছাড়াও নারীদের ক্ষেত্রে অন্যান্য সমস্যার মধ্যে আছে ডিম্বাণুর প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া (সাধারণত অতিরিক্ত বয়েস আর শরীরে প্রোজেস্টেরন-এস্ট্রোজেন হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে এটি ঘটে থাকে), ডিম্বাণুর পরিমাণ কমে যাওয়া, নিয়মিত মাসিক না হওয়া ইত্যাদি।

এখন আমরা আমাদের আজকের লেখার মূল প্রসঙ্গে চলে এসেছি।

হিজামা বা কাপিং থেরাপি

হিজামা কী

হিজামা শরীরের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক করার একটি চিকিৎসা। এর মাধ্যমে ত্বকের বিভিন্ন স্থান থেকে চোষণযন্ত্রের মাধ্যমে রক্ত বের করা হয়। মূলত মাথাব্যথা, ঘাড়-কাঁধব্যথা, পিঠব্যথা বা শরীরের বিশেষ কোনো অঙ্গের ব্যথা, বাতব্যথা, প্রসবব্যথা, যৌন সমস্যা, পা ফোলা, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় হিজামা আদিকাল থেকেই জনপ্রিয়।

প্রায় ৫ হাজার বছর (মতান্তরে ৩ হাজার) পুরোনো একটি চিকিৎসা পদ্ধতি হলো হিজামা। তৎকালীন চীন, মিশর ও আরবের মানুষের মাঝে এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আরামদায়কও ব্যয়সাশ্রয়ী বলে এই ব্যবস্থাটি মানুষের কাছে বেশ প্রচলিত ও জনপ্রিয় ছিল। 

মুসলমানদের মাঝে হিজামা জনপ্রিয় হবার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে হিজামা চিকিৎসাকে আমাদের নবীজী (সা:) নিজেই সুপারিশ করেছেন। তাঁর বিভিন্ন হাদিস এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়।

ধীরে ধীরে হিজামা চিকিৎসায় বিবর্তন এসেছে, আরও উন্নত হয়েছে। এখন আধুনিক ও উন্নত বিশ্বেও হিজামা বেশ প্রচলিত একটি থেরাপি যা Cupping Therapy নামে পরিচিত।

হিজামা চিকিৎসার পদ্ধতি

হিজামা চিকিৎসা কিভাবে করা হয়, এটা নিয়ে প্রায় সবারই একটা কৌতুহল থাকে। অনেকে গ্রামীন শিঙ্গা লাগানো বা চায়নিজ আকুপাংচার’র সাথে সুন্নাহভিত্তিক হিজামাকে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু এটি আসলে ভুল।

হিজামা থেরাপিতে শরীরের রক্ত সঞ্চালনের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। আমাদের শরীরের পরিষ্কার বা ভালো রক্ত যেন সহজে চলাচল করতে পারে এর জন্য দূষিত রক্ত(toxic blood) বের করে দেয়ার দরকার পড়ে। হিজামা করার মাধ্যমে শরীরের নির্ধারিত স্থানে ছোট ছোট ছিদ্র বা আঁচড় দেয়া হয় এবং তারপর সেখানে কাপ(Cup) সেট করা হয়। আস্তে আস্তে দূষিত রক্ত বের হতে থাকে এবং সেই জায়গায় মাসাজ হতে থাকে। এতে শরীর আরাম পায় ও শরীরে রক্ত সঞ্চালন সহজ হয়। 

মাথাব্যথা, অন্যান্য ব্যথা, ঠান্ডা-সর্দি, পিরিয়ডের সমস্যা, শারীরিক দুর্বলতা, যৌন সমস্যা, সন্তানধারণজনিত সমস্যা এবং আরও অনেক সমস্যায় সঠিক পদ্ধতির হিজামা উপকারী বলে প্রমাণিত।

হিজামা ও বন্ধ্যাত্ব নিরাময়

আগেই বলা হয়েছে, নারী ও পুরুষের বন্ধ্যাত্বে কিছু বৈচিত্র্য রয়েছে। হিজামা যেহেতু শরীর থেকে দূষিত রক্ত বের করে দিয়ে রক্তসঞ্চালনকে উন্নত করে, এই সুযোগে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু মধ্যকার মিলিত হবার বাধাগুলো দূর হয়ে যায়। 

বন্ধুত্ব চিকিৎসায় হিজাবের সব ভূমিকা দেখা যায় তা নিম্নরূপ:

  • নারীর জননেন্দ্রিয়ে রক্ত সঞ্চালন এবং অক্সিজেন সরবরাহের উন্নতি করে
  • মহিলাদের মধ্যে ডিম্বস্ফোটন (Ovulation) এবং ইমপ্লান্টেশনে ভূমিকা রাখে
  • পুরুষদের শুক্রাণু গুণমান এবং গতিশীলতা বৃদ্ধি করে
  • পেলভিক এলাকায় প্রদাহ এবং সংক্রমণ হ্রাস করে
  • হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং মাসিক চক্র নিয়মিত কারণে ভূমিকা রাখে 
  • স্ট্রেস এবং উদ্বেগ থেকে মুক্তি দেয়, যা প্রজনন ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে
  • শরীর থেকে টক্সিন এবং বর্জ্যপদার্থ বের করে দেয়
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক সুস্থতায় সহায়তা করে

এখানে বলে রাখা ভাল যে, শারীরিক অবস্থার পাশাপাশি মানসিক অবস্থাও গর্ভধারণের সাথে সম্পৃক্ত। হিজামা যেহেতু সামগ্রিক মানসিক অবস্থাকেও উন্নত করে, তাই গর্ভধারণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে হিজামা বেশ সহায়ক।

এছড়াও মাসিকের সমস্যা, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম(PCOS), থাইরয়েড, লিউটেয়াল ফেজ’র ত্রুটি, ফ্যালোপিয়ান ব্লক ইত্যাদি সমস্যায় হিজামা করালে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। এই সবকিছু সমন্বিতভাবে একটি সুস্থ গর্ভধারণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

এখানে মনে রাখা দরকার, হিজামার সর্বোচ্চ কার্যকরী ফলাফল পাওয়ার জন্য অবশ্যই দক্ষ থেরাপিস্টের কাছ থেকে হিজামা করাতে হবে।

গর্ভাবস্থায় হিজামা করা

গর্ভাবস্থায় হিজামা করা সাধারণত কতটুকু নিরাপদ এই বিষয়ে যথাযথ গবেষণা নেই।তাই বলা যায় এটা মূলত গর্ভবতী নারীর শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করবে। অনেকে প্রথম তিন মাসে হিজামা করতে নিরুৎসাহিত করেন। অনেকে পেটের উপরে এবং নিজের অংশে হিজামা করতে নিষেধ করেন।

এটাও ঠিক যে গর্ভাবস্থার জনিত অনেক ধরনের শারীরিক অস্বস্তি এবং কষ্টের ক্ষেত্রে হিজামা আরামদায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তাই আপনি হিজামা করতে চাইলে অবশ্যই একজন দক্ষ হিজামা কনসালটেন্টের পরামর্শ নিন।

হিজামা সম্পর্কিত কিছু বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন(FAQ) ও উত্তর

১. হিজামা কি নারী-পুরুষ সবাই করাতে পারে?

– হ্যাঁ। সাধারণভাবে নারী-পুরুষ সবাই হিজামা করতে পারে। 

২. হিজামা করানোর উপযুক্ত বয়স কতো? 

– যে কোনো বয়সীরা হিজামা করাতে পারেন। তবে এখানে যেহেতু কাটাছেঁড়া বা ছিদ্র করার বিষয় জড়িত তাই যাদের শরীরে সহজে ক্ষত শুঁকায় না বা যাদের ডায়াবেটিসের মাত্রা অত্যধিক তাদের এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

৩. হিজামা করার সময় কি ব্যথা লাগে?

– না। সাধারণত কোনো ব্যথা অনুভুত হয় না। তবে হাল্কা অস্বস্তি লাগতে পারে যেটা অভ্যাস হয়ে যায় বা কিছুক্ষণ পরে চলে যায়। 

৪. হিজামাতে কি মেডিসিন/কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়?

– না। সাধারণত হিজামাতে আলাদাভাবে মেডিসিন বা ক্যামিকেল ব্যাবহার করা হয় না। হিজামার কাপ, সুই ইত্যাদি দিয়েই কাজ করা হয়। 

৫. বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তির জন্য কতদিন হিজামা করতে হয়?

– এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এক্ষেত্রে রোগীর শারীরিক ও লাইফস্টাইলের অবস্থাও প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তাই হিজামাস্পেশালিস্টের পরামর্শ মতো হিজামা চালিয়ে যেতে হয়। সফলতা একমাত্র আল্লাহর হাতে। 

৬। বন্ধ্যাত্ব নিরাময়ে হিজামা কি শতভাগ সফল?

– না। পৃথিবীর কোনো চিকিৎসার ক্ষেত্রেই শতভাগ সফলতার ইতিহাস নেই আসলে। আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্তের উপর ভরসা করে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। হিজামা ও বন্ধ্যাত্ব নিয়েযেসব একাডেমিক গবেষণাপাওয়া যায়তাতে বেশিরভাগ সময় ইতিবাচকফলাফল দেখা গেছে। তাই বলা যায়, বন্ধ্যাত্ব নিরাময়ে হিজামার সফলতা আশা জাগানিয়া।  

৭. নিয়মিত হিজামা করালে কি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া(Side effect) হয়?

– না। হিজামা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত একটি চিকিৎসা। সঠিক জায়গায় সঠিকভাবে হিজামা করালে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। 

৮. হিজামা করালে কি শরীরে দাগ হয়?

– হ্যাঁ, সাময়িক দাগ হয়। আমরা হিজামা পদ্ধতি নিয়ে যা লিখেছি, তাতে বলা আছে হিজামা ব্লাড সার্কুলেশন নিয়ে কাজ করে। তাই সেই স্পটগুলোতে (ছিদ্র বা আঁচড়) কিছুটা লালচে দাগ হয় যা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। 

৯. হিজামা কি খুব ব্যয়বহুল?

– না। বর্তমান চিকিৎসা খরচের হিসাব চিন্তা করলে হিজামা থেরাপিকে খুব বেশি ব্যয়বহুল বলা যায় না। তবে, খরচের মাত্রা নির্ভর করে মোট কত সেশন হিজামা করাতে হবে তার উপর। একবার ডাক্তার দেখালে যা ভিজিট দিতে হয়, একবার হিজামা সেশনেও প্রায় সেরকম ফি ব্যয় হয়। তবে বিস্তারিত জানতে কোন হিজামা সেন্টারে যোগাযোগ করতে হবে।

১০. অন্য চিকিৎসার পাশাপাশি হিজামা করানো যাবে?

– এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া যাবে না। এটা নির্ভর করে আপনি কী ধরণের চিকিৎসা নিচ্ছেন সেটার উপর। একজন হিজামা বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে ভালো পরামর্শ দিতে পারেন।

তথ্যসূত্র:

১। Causes: Infertility
২। What is hijama?
৩। Can Hijama help with fertility?
৪। Hijama and pregnancy

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা