ডেলিভারির দিন যত ঘনিয়ে আসে, একজন প্রেগন্যান্ট মায়ের দুশ্চিন্তা ততই ঘনীভূত হতে থাকে। বহুল কাঙ্খিত সেই মুহূর্তের জন্য আগে এক ঘটনাবহুল পথ পাড়ি দিতে হবে। এর মাঝে একটা বড় চিন্তার বিষয়- ‘পানি ভাঙল’ কি না? 

‘পানি ভাঙা’ আসলে কি?

পানি ভাঙা- আমরা সবাই এই দুটি শব্দের সঙ্গে পরিচিত। পানি ভাঙা প্রসব বেদনা বা লেবার (labour) শুরু হতে যাওয়ার বেশ কিছু লক্ষণের মাঝে একটি। কিন্তু এই ‘পানি’ আসলে কি? এটি হল অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড, গর্ভের সন্তান যে তরলে ভাসমান থাকে। এটা লেবার শুরু হওয়ার ২৪ ঘন্টা বা তারও আগে হতে পারে, আবার লেবারের ১ম স্টেজে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার পরও হতে পারে, আবার অনেকসময় প্রসবের মুহূর্ত পর্যন্তও মেমব্রেন অটুট থাকতে পারে, এমনকি প্রসবের পরও।

কি করে বুঝবেন?

পানি ভাঙার অভিজ্ঞতা বিভিন্ন নারীদের মধ্যে পৃথক হয়। কেউ কেউ পা বেয়ে তরল নামছে বলে মনে করেন, অন্যরা প্রচুর গন্ধহীন এবং বর্ণহীন তরল বয়ে যাওয়া অনুভব করতে পারেন। থলিটি কোথায় ফেটেছে এবং লেবারের জন্য প্রস্তুত কিনা তা সবই নির্ভর করে। আসলেই পানি ভেঙেছে কিনা তা বুঝতে হলে আরো কিছু পয়েন্ট মাথায় রাখা দরকার-

  • দাঁড়িয়ে দেখুন, সাধারণত দাঁড়ালে পানি বেশি জোরে প্রবাহিত হতে শুরু করে
  • এটা কি পিচ্ছিল জাতীয়? তাহলে তা মিউকাস প্লাগের বের হয়ে যাওয়া খানিক অংশমাত্র। 
  • অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড অবশ্যই পরিষ্কার হবে। সাথে গন্ধহীন।
  • একবার পানি ভেঙে আবার থলের ফুটা বন্ধ হয়ে যাওয়াও অসম্ভব না, এটা মাথায় রাখতে হবে। 
  • কোন কোন নারীর ক্ষেত্রে পানি ভাঙার ঘটনা ঘটে লেবার শুরু হওয়ার পর। তাই এর জন্য অপেক্ষা করাও বিপজ্জনক হতে পারে।

প্রস্রাব এবং অ্যামনিয়োটিক ফ্লুয়িড এর মধ্যে পার্থক্য করা কিছুটা জটিল। অ্যামনিয়োটিক ফ্লুয়িড পরিষ্কার, গন্ধহীন, হালকা হলুদ বা ফ্যাকাশে রঙের এবং কখনো শুরুতে কিছুটা রক্তও বেরোয়। অন্যদিকে যোনিগত স্রাব হল পাতলা সাদা শ্লেষ্মা যা আপনি পিরিয়ডের আগে যা দেখেন তার মতোই হয়, তাই সহজেই অ্যামনিয়োটিক ফ্লুয়িড থেকে আলাদা করা যায়।

হাসপাতালে গেলে নার্সরা দেখলেই বুঝতে পারবে, তাই নিজে বুঝতে না পারলে ডাক্তার, নার্স বা ধাত্রীর সাহায্য নিন। হাসপাতালে গেলে তারা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে পারেন। 

অনেক মায়েরা আশঙ্কা করেন যে তারা বাড়ির বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় পানি ভাঙতে পারে। এই নিয়ে বেশি চিন্তা করবেন না। যদি আশংকা করেন তবে গর্ভাবস্থার ৩৭তম সপ্তাহ থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন বা পাতলা সুতির পরিষ্কার নরম কাপড় ব্যবহার করতে পারেন, যেন পানি ভাংগলে কাপড় নষ্ট না হয়- আবার আপনিও বুঝতে পারেন। 

পানি ভাঙার পর কি?

যদি নিশ্চিত ভাবে জানা যায় যে পানি ভেঙেছে, তাহলে ডাক্তার নিচের বিষয় গুলো দেখে সিদ্ধান্ত গুলো নিবেন- 

  • বাচ্চার পজিশন কেমন
  • মায়ের শারীরিক অবস্থা এখন কিরূপ 
  • বাচ্চার শরীর কেমন
  • অন্যান্য কোনো জটিলতা আছে কিনা

হবু মায়েদের মনে একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খায়- পানি ভাঙার পরে লেবার কতক্ষণে শুরু হয়? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, অ্যামনিয়োটিক থলির ভাঙার পরেই প্রসব শুরু হয় এবং সচরাচর তাতে সময় লাগে ২৪ ঘন্টা। খুব বিরল ক্ষেত্রে এটি বিলম্ব হতে পারে, যদি মেমব্রেন অকালে ফেটে যায়। এই ক্ষেত্রে, ডাক্তার লেবার ইনডিউস করতে পারে, কারণ পানি ভাঙার পরে যত বেশি সময় কাটতে থাকে, আপনার এবং আপনার শিশুর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়তে থাকে, বিশেষত ইনফেকশন।

মনে রাখতে হবে, ইনফেকশন শুধু শিশুর না, মায়েরও হতে পারে। এর সম্ভাব্য লক্ষণগুলো হলো-

  • জ্বর
  • দ্রুত হৃদস্পন্দন (মা বা শিশুর)
  • মায়ের অস্বাভাবিক  ঘাম
  • শিশুর নড়াচড়া কমে আসে
  • জরায়ুর চারপাশে নরম হয়ে আসা
  • দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা
  • গন্ধযুক্ত স্রাব নিঃসরণ

যদি সবুজ, হলুদ বা খয়েরি কোন নিঃসরণ দেখতে পাওয়া যায় তাহলে তা ইনফেকশন বা মিকোনিয়াম (শিশুর পরিপাককৃত বর্জ্য) ত্যাগ এর একটি লক্ষণ। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ জন্মের পর এটি বিভিন্ন জটিলতার পূর্বাভাস দেয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইনফেকশন কোনরকম লক্ষণহীনও হতে পারে।

যদি আপনি ইতিমধ্যে লেবারে না যান তবে অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড আপনার পা বেয়ে নামতে শুরু করার ১২ ঘন্টা পরে আপনি প্রথম কন্ট্রাকশন বা  সংকোচনের অনুভব করতে পারেন; কিছু ক্ষেত্রে, যদিও সংকোচনগুলি ২৪ ঘন্টা পরে শুরু হতে পারে। তাই যদি আপনার অন্যান্য জটিলতা না থাকে তাহলে ডাক্তার ২৪ ঘন্টাই অপেক্ষা করবেন লেবার শুরুর জন্য। কেউ কেউ অবশ্য ৪৮ ঘন্টা পর্যন্তও সময় নেন। এ সময়ে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষন করা হবে আপনাকে, কোন ইনফেকশন হল কিনা বোঝার জন্য।

সময়ের আগেই পানি ভাঙলে কি করবেন?

যদি পানি ভাঙ্গার বিষয়টি সময়ের আগেই ঘটে যায় তাহলে একে বলে প্রিম্যাচিউর রাপচার অফ মেমব্রেন (PROM)। এটি সাধারণত ৮-১০ ভাগ নারীর ক্ষেত্রে ঘটে এবং ঘটলে প্রেগনেন্সির ৩৭তম সপ্তাহের ভেতরই ঘটে। এর কারণ গুলো হল:

  • পূর্ববর্তী গর্ভাবস্থায় PROM এর ইতিহাস
  • গর্ভাবস্থায় ধূমপান বা কোন ড্রাগ নেয়া
  • জরায়ুর ছোট দৈর্ঘ্য
  • জরায়ুর ইনফেকশন
  • পুষ্টির অভাব
  • কম ওজন
  • ভ্রূণের মেমব্রেন বা ঝিল্লিতে প্রদাহ
  • দ্বিতীয় বা তৃতীয় ট্রাইমেস্টারের সময় যোনিতে রক্তপাত
  • গনোরিয়া, ক্লেমাইডিয়া সহ বিভিন্ন যৌনরোগ
  • অপর্যাপ্ত বিশ্রাম ও যত্ন।

গবেষণায় দেখা গেছে যাদের সময়ের আগেই পানি ভেঙে গিয়েছে (অর্থাৎ PROM), তাদের শতকরা ২৮ ভাগই সি-সেকশন এর মধ্য দিয়ে গেছে। তাদের ক্ষেত্রে হয় ইন্ডাকশন কাজে লাগেনি, বা মা ও শিশু ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া PROM এর পর ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে বাচ্চার মৃত্যুও হতে পারে।

PROM এর সময় যদি আপনি ৩৪ সপ্তাহের গর্ভবতী হন তবে ডাক্তার প্রাথমিক পর্যায়ে প্রসবের পরামর্শ দিতে পারেন, তবে যদি আপনি ২৪ থেকে ৩৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভবতী হন তবে ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে বিলম্ব করার চেষ্টা করবেন। এ সময়ে আপনার শিশুর ফুসফুসের গতি বাড়ানোর জন্য আপনাকে শক্তিশালী স্টেরয়েড (কর্টিকোস্টেরয়েডস) এর একটি ইঞ্জেকশনও দেওয়া হতে পারে।

পানি যদি নিজে নিজে না ভাঙে?

যদি আপনি লেবারের দিকে যান এবং আপনার সার্ভিক্স প্রসারিত ও পাতলা হয়ে আসে এবং শিশুর মাথা ইতিমধ্যে পেলভিসের মধ্য দিয়ে চাপ দেয় তবে আপনার ডাক্তার সংকোচন শুরু করতে বা বাড়ানোর জন্য অ্যামনিওটমি ব্যবহার করতে পারেন। এই কৌশলটিতে অ্যামনিয়োটিক থলিটি খোলার জন্য একটি পাতলা প্লাস্টিকের হুক ব্যবহার করা হবে, যা অ্যামনিয়োটিক তরল প্রবাহিত করবে।

তবে এই বিষয়টা একেকজন ডাক্তার একেকভাবে ম্যানেজ করেন। একেকজন ডাক্তার লেবারের একেক পর্যায়ে পানি ভেঙ্গে দেন। যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অ্যামনিওটমি প্র্যাকটিস করা হয়, কখনো রুটিন হিসাবে সব মায়েদের ওপর আবার কখনো সেই সব মায়েদের ওপর যাদের লেবার দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তবে মা বা শিশুর জন্য স্বল্পতম সময়ের লেবার বেশি উপকারী এর সপক্ষে প্রমাণ সামান্যই। সেই সাথে, অ্যামনিওটমির সাথে কিছু সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিরল ঝুঁকিও জড়িত আছে, যার মাঝে আম্বিলিক্যাল কর্ড অথবা বাচ্চার হৃদস্পন্দন নিয়ে সমস্যাও অন্তর্ভুক্ত। ককরেন (Cochrane) গবেষণা থেকে প্রাপ্ত প্রমাণ স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফুর্তভাবে অগ্রসর হওয়া লেবার অথবা দীর্ঘায়িত লেবারে রুটিনমাফিক পানি ভেঙ্গে দেয়া সমর্থন করে না। তাদের গবেষণা দেখায় যে এর ফলে লেবারের প্রথম স্টেজের সময় কমে আসে না এবং সিজারিয়ান সেকশনের সম্ভাব্য বৃদ্ধি ঘটে।

ইনডিউসড লেবার না চাইলে

যদি আপনি এই পর্যায়ে ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়েই যান তবে আপনাকে ডাক্তার শিরাপথে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার পরামর্শ দিবেন। এবং সেইসাথে আপনাকে ও আপনার শিশুকে আরো সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য আপনাকে লেবারে প্রেরণ করার পরামর্শ দেয়া হবে।

কখন ডাক্তারের প্রয়োজন?

আপনি পানি ভাঙার লক্ষন গুলো পর্যবেক্ষণ করার পরে আপনার ডাক্তারকে তা অবহিত করবেন এবং পরামর্শ নিবেন। তবে কিছু কিছু পরিস্থিতিতে অবশ্যই আপনার ডাক্তার এর সাহায্য লাগবে-

  • আপনি যদি লক্ষ্য করেন যে জল ভাঙার রঙ সবুজ বা বাদামী।
  • আপনি ৩৭ সপ্তাহের কম সময় ধরে প্রেগন্যান্ট কিন্তু আপনার পায়ের মধ্যে ধীরে ধীরে লিক হওয়া অনুভব করছেন।
  • আপনি যদি মনে করেন যে কোন কিছু আপনার যোনিতে নাড়ির মতো আটকে আছে। এটি কেবলমাত্র PROM–এর ক্ষেত্রে ঘটে (হয় শিশুটি ব্রিচ বা প্রিটার্ম)।
  • আপনি ডাক্তারের কাছে গেলে সাথে সাথে পানি ভাঙার পরীক্ষা করবে। যদি এটি একটি মিথ্যা অ্যালার্ম হিসাবে দেখা যায় তবে আপনাকে আবার বাড়িতে পাঠানো হবে বা পর্যবেক্ষনে রাখা হবে।

পানি ভাঙার সময়টা একজন নারীর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক সময়। এ বিষয়ে উদাসীনতা বা অতি দুশ্চিন্তা- উভয়ই মা ও সন্তানের জন্য ভয়াবহ বিপদ, এমনকি মৃত্যু ডেকে আনতে পারে! তাই মানসিক ভাবে দৃঢ় হোন, পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নিন, আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে থাকুন। যুগ যুগ ধরে প্রতিটি নারী এ সময় পার করেই সন্তান জন্ম দিয়েছেন, আপনিও একইভাবে সফল হবেন, ইন শা আল্লাহ। 

রেফারেন্স:

(১) Healthline
(২) Firstcry
(৩) Cochrane
(৪) Active Birth বই

ছবি: Verywell Family

লেখাটি রিভিউ করেছেন –

ডাঃ সারওয়াত জাবীন আনিকা
এমবিবিএস
KMC (IMCS) – এ বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত

সম্পাদনায়- হাবিবা মুবাশ্বেরা

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা