আলহামদুলিল্লাহ, মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লার কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া যে উনি আমাদেরকে একজন ছেলে সন্তান দান করেছেন। বাবা/মা হওয়ার আনন্দ অনেক ।এবং সেটা যদি হয় প্রথমবার সেটার আনন্দ আরও অনেক বেশি। সেই আনন্দের সাথে রয়েছে অনেক ত্যাগ ও দায়িত্ব। বিশেষ করে ডেলিভারির দিন বাবার ভূমিকা ও তার দায়িত্ব। কেননা সেদিন মায়ের জন্য যেমন খুশির দিন, তেমনি অনেক কষ্টের দিনও।

আমাদের মনে রাখতে হবে, ডেলিভারির দিন মায়ের ভূমিকা হচ্ছে বাচ্চা প্রসব করা(যেটা দুনিয়ার সবচেয় কষ্টের কাজ গুলোর মধ্যে একটা)। সিজারিয়ান ও নরমাল ডেলিভারি দুইটাই কষ্ট। তবে আমি নিজে দেখেছি নরমাল ডেলিভারী কতটা কষ্ট। আলহামদুলিল্লহ আমার স্ত্রী নরমাল ডেলিভারীর জন্য ডিটারমাইন্ড ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ রহমতে সফল হয়েছেন।

বাচ্চা ডেলিভারির দিন আমি চেষ্টা করেছি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে বাবার ভূমিকা পালন করার। জানিনা কতটুকু পেরেছি। এই লিখাটির উদ্দেশ্য হলো আমার ভূমিকা  তুলে ধরা। সেটা যদি কোন বাবার জন্য উপকারে আসে, সেটাই আমার জন্য অনেক। 

এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমার বাচ্চা আসা উপলক্ষে তার মা কে আমি প্রিন্যাটাল কোর্সটি উপহার দিয়েছিলাম। যেহেতু কিছু কন্টেন্ট ব্যাতিত বাকিগুলো বাবার দেখার পারমিশন ছিলো, সেগুলো আমাকে অনেক কিছু জানতে ও বুঝতে শিখিয়েছে।

আমি আমার অভিজ্ঞতা গুলো নিম্নের পয়েন্টগুলোর মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বাংলা লিখায় আমি তেমন পারদর্শী না। তাই ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ থাকলো।


১। আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা রাখাঃ

বাচ্চার জন্মের ব্যাপারে পরিপূর্ণ আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে। উনার কাছে নেক ও সুস্থ সন্তান লাভের জন্য দোয়া করতে হবে। আমি ও আমার স্ত্রী আল্লাহ তা’লার কাছে সেই দোয়াই করে এসেছি। আল্লাহ যা ভালো মনে করবেন সেটার উপরই ভরসা রাখা। এবং যেকোন ধরনের পরিস্থিতিতে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। যেকোন ধরনের সাহায্য আল্লাহর কাছে প্রথমে চাইতে হবে। আমার স্ত্রী যখন লেবার রুমে, তখন সময় ছিলো রাত আনুমানিক ৮/৯ টা। তখনও আমার ইশার সালাত আদায় বাকি ছিলো। হাসপাতালের নামাজ ঘরে ইশার সালাত আদায় করে, নফল নামাজের পর আল্লাহর কাছে বলেছিলাম যেন আমার স্ত্রীর কষ্টটা কমিয় দেন এবং সকল কিছু সহজ করে দেন।

২। স্ত্রীর কষ্ট অনুধাবন করাঃ

আসলে যার কষ্ট সেই বুঝে। এটাই চিরন্তন সত্য। এই কথাটা আমি অনেককেই বলি। আমার লিগামেন্ট সার্জারির উদাহরণ দিয়ে বুঝাই, যে আমি বুঝেছি সেটার কষ্ট কী। আমার মত যারা এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, তারাই সেটার কষ্ট বুঝতে পারবেন। সেরকম যেসব মায়েরা প্রসব ব্যাথার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, তারাই সে কষ্টটা ভালো করে বুঝেন। তারপরও হাজব্যান্ড হিসেবে আপনিও বুঝতে পারবেন কিছুটা স্ত্রীর কষ্ট। আমার এখনো মনে পরে, আমার স্ত্রীর আর্তনাদগুলো আমার বুকে তীরের মত বিধছিলো। লেবার রুমে যাওয়ার পারমিশন ছিলো না আমার। আমি সেই রুমের কাছেই ছিলাম। কোন প্রয়োজনে যখন দরজা খোলা হত লেবার রুমের, তখনই স্ত্রীর আওয়াজ আমার কানে আসতো। 

৩। স্ত্রীর প্রয়োজনীয়তার গুরত্ব দেওয়াঃ

ছোট থেকে বড় যেকোন জিনিসের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া বাবার কাজ। স্ত্রী যদি কোন কিছু চান সেটা না করা যাবে না। তবে হ্যাঁ সেটার যদি ডাক্তারের নিষেধ থাকে সেটা মানতে হবে। ডেলিভারির দিন আমার স্ত্রী যা চেয়েছিলেন, সেটা যোগার করার চেষ্টা আমি করেছি। অলিভ অয়েলের কথা বলেছিলেন। সবচেয়ে ভাল অলিভ অয়েলটা নিয়ে এসেছিলাম। চা খাওয়ার কথা বলেছিলেন। বেস্ট বাই থেকে ফ্লাস্ক কিনে, রব্বানী হোটেল থেকে চা আর নান নিয়ে এসেছিলাম। 

৪। বাবাই ডিসিশন মেকারঃ

এখানে মনে রাখা ভালো, স্ত্রী যখন লেবার পেইনের মধ্য দিয়ে যাবেন তখন মোটামুটি সব ডিসিশন বাবারই নিতে হবে। আমার স্ত্রী একজন এমবিবিএস ডাক্তার। অনেক আগে থেকেই উনি আমাকে এই ডিসিশনের ব্য্যপারে বলে আসতেন। যেমন লেবার রুমে যাওয়ার আগে ডাক্তার এসেছিলেন দেখতে। যখন আমার স্ত্রী ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলেন, ডাক্তার ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন সিজার করবে কিনা। আমার স্ত্রী আমাকে আগেই বুঝিয়েছিলেন কোন পর্যায়ে গেলে সিজারের কথা চিন্তা করতে হবে।
তাই আমি ও আমার স্ত্রী ডাক্তারকে বলেছিলাম নরমালেই ট্রাই করবে। যদিও ডাক্তার আগে থেকেই জানতেন আমার স্ত্রী নরমাল ডেলিভারির জন্য ডিটারমাইন্ড আলহামদুলিল্লাহ। 

৫। বাচ্চা ও মায়ের জিনিস পত্র রেডি রাখাঃ

বাচ্চা হওয়ার আগেই আমার স্ত্রী মাদার ও বেবি ব্যাগ রেডি করে রেখেছিলেন। ব্যাগে কী কী নিতে হবে প্রিন্যাটাল কোর্সে দেওয়া ছিলো। কিন্তু ডেলিভারির সময় যখন স্ত্রী লেবার রুমে থাকবেন বাবাকেই সেই জিনিসগুলো সময়ে সময়ে দিতে হবে। যেমন বাচ্চার তোয়ালে, তাহনিক করানোর খেজুর, খাবার পানি, মায়ের অতিরিক্ত কাপড়, ইত্যাদি। বাচ্চার মা আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন কোথায় কোনটা আছে। তাই সময়ে সময়ে যোগান দেওয়া আমার জন্য সহজ হয়েছিলো।

৬। অনেক দৌড়াদৌড়ি করার মানসিকতা রাখাঃ 

মা যখন ডেলিভারি প্রসেস এর মধ্য দিয়ে যায় তার আগে পরে অনেক কাজ থাকে। আমাকে নার্সরা বলছিলেন এইটা নিয়ে আসেন, ওইটা নিয়ে আসেন। মোটামুটি দৌড়ের উপরে ছিলাম। আমার কাছে এইগুলো কোন কষ্টই মনে হয়নি, যখন চিন্তা করছিলাম আমার স্ত্রী যেই কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন সেটার তুলনায় এটা কিছুই না। আক্ষরিক অর্থেই কিছুই না, তুলনাই করা যায় না। 

৭। আযান দেওয়াঃ

বাচ্চার কানে আযান দেওয়া বাবার অন্যতম দায়িত্ব। এর মাধ্যমে শিশুকে দুনিয়াতে স্বাগত জানানো হয়। আল্লাহর রহমতে জীবনে অনেকবার আযান দিয়েছি। কিন্তু বাচ্চাকে কোলে নিয়ে যেন আযান মুখ দিয়ে বের হচ্ছিলো না। খুশির কান্না আসছিলো যখন আমার ছেলের মুখ দেখলাম। কিন্তু আমাকে যে আযান দিতেই হবে। বাচ্চা হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই প্র্যাক্টিস করতাম আযানের। তাই বাবাদের প্রতি অনুরোধ বেশি বেশি করে স্পষ্ট আযান প্র্যাক্টিস করবেন। যদি মনে করেন অই সময়ে দিয়ে দিবেন, হয়ত দিতে পারবেন, কিন্তু আমার মত হলে একটু কঠিন হয়ে যাবে। 

৮। তাহনীক করানোঃ 

বাচ্চার জন্মের পরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ  হলো তাহনীক করানো। আমাদের কাছে মক্কা শরীফ থেকে আনা খেজুর ছিলো। আমাদেরও ইচ্ছে ছিলো সুন্নাহ মোতাবেক বাচ্চাকে খেজুর দিয়ে তাহনীক কারনো। খেজুর ভালো করে ধুয়ে, হাতে পিষিয়ে বাচ্চার মুখে ধরেছিলাম আমি। তাহনীক করানোর খেজুর আগে থেকে রেডি রাখা উত্তম। 

৯। স্ত্রীকে প্রশংসা করাঃ

এই অংশটা ডেলিভারীর পরের মুহূর্ত। মনে রাখেবেন আপনার স্ত্রী অনেক কষ্ট করে আপনার জন্য বাচ্চা উপহার নিয়ে এসেছেন। তাই তাকে প্রশংসা করতে যেন ভুল হা হয়। আমি সুযোগ খুজছিলাম কীভাবে তাড়াতাড়ি আমার স্ত্রীর কাছে যেতে পারবো। তাকে বলেছিলাম, অনেক কষ্ট হয়েছে। আল্লাহ এর উত্তম প্রতিদান দিবেন তোমাকে। তাছাড়া তুমি সফল হয়েছো, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ এই কষ্টের বিনিময়ে গুনাহও মাফ করে দিবেন ইংশা আল্লাহ। 


পরিশেষে আবারও মহান আল্লাহ তা’আলার কাছে অনেক শুকরিয়া সব কিছু সহজ করে দেওয়ার জন্য। আমার সাথে আমার ছোট বোন, আমার স্ত্রীর  মা ও বোন ছিলেন। পরে শুনেছিলাম আমার শাশুরি থাকাতে আমার স্ত্রী অনেক সাহস পেয়েছিলেন। এরকম যদি কেউ থাকে যাকে আপনার স্ত্রী কাছে পেলে সাহস পাবেন ও ভালো বোধ করবেন, তাহলে উনাকে আপনার স্ত্রীর কাছে রাখা উত্তম। আল্লাহ রব্বুল আলামিন সকলকে সুস্থ ও নেক সন্তান দান করুন । আমিন।

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা