![](https://matritto.b-cdn.net/wp-content/uploads/2020/08/30792681-1.jpg)
সিরিজ ইনডেক্স
১. প্রথম পর্ব
২. দ্বিতীয় পর্ব
৩. শেষ পর্ব
শিরোনাম পড়ে হয়তো আপনি ভ্রু কুঁচকে ভাবছেন মাতৃত্বে বাবার কী ভূমিকা থাকতে পারে? অথবা হয়তো স্বামী বা বাবার আসনে বসে এই আর্টিকেল আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করেছেন নিজের জন্য দিকনির্দেশনা পাওয়ার খোঁজে।
যেটাই হোক এই লেখাটি পড়তে শুরু করায় আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার আগ্রহ জানান দিচ্ছে যে আপনি দায়িত্বের প্রতি সচেতন।
মাতৃত্বে বাবার ভূমিকা নিয়ে আমরা একটি ওয়েবিনার আয়োজন করেছিলাম। ভিডিওর রেকর্ড দেখুন মাতৃত্ব ইউটিউব চ্যানেলে
- স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় স্বামীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ কেন?
- মাতৃত্বে বাবার ভূমিকা কখন থেকে শুরু হয়?
- গর্ভবতী স্ত্রীর কাছে স্বামীর ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
- স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় স্বামী কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন?
- প্রেগন্যান্সী নিয়ে পড়ুন
- প্রেগন্যান্সীকালীন খাদ্যাভ্যাস নিয়ে জানুন
- প্রেগন্যান্সীকালীন ব্যায়াম নিয়ে জানুন
- নিজ থেকেই করুন
- লেবার পেইনের সময় স্ত্রীর পাশে থাকুন
- ছোট-বড় আরও কিছু বিষয়
- নবজাতকের দেখাশোনায় বাবা কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন
স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় স্বামীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ কেন?
আপনি যদি গর্ভাবস্থা ও ডেলিভারিকে মেয়েলী বিষয় মনে করে থাকেন তাহলে সবিনয়ে বলতে চাই যে আপনার ধারণার পরিবর্তন প্রয়োজন। স্বাভাবিক অবস্থায় যদি আপনার স্ত্রীর আপনাকে প্রয়োজন হয়, তাহলে গর্ভাবস্থা এবং ডেলিভারির মত নাজুক সময়ে আপনাকে তার আরও অধিক প্রয়োজন। গর্ভাবস্থার ভালো-মন্দ ও ডেলিভারির ফলাফল আপনার স্ত্রী ও সন্তানের উপর যেমন পড়বে ঠিক তেমনি আপনার উপরও এর একটা প্রভাব থাকবে। ফলাফল যদি ভালো হয় তাহলে আপনিই আনন্দে ভাসবেন, অন্যদিকে যদি ভোগান্তি থাকে তাহলে আপনাকেও সেটা ভাগাভাগি করে নিতে হবে। তাই বিচক্ষণ মানুষ মাত্রই জীবনের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নিজের দায়িত্বটা বুঝে নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন।
মাতৃত্বে বাবার ভূমিকা কখন থেকে শুরু হয়?
একজন স্ত্রী যখন গর্ভবতী হন তখন থেকেই তিনি একজন মা। ঠিক তেমনই একজন স্বামীও তখন থেকেই একজন বাবা। অথবা আরেকটু পেছনে গিয়ে বলা যায়, যখন থেকে একজন পুরুষ বিয়ে করেছে তখন থেকেই সে ভবিষ্যৎ বাবার দায়িত্ব পালন শুরু করেছে। দাম্পত্যের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো থেকেই তার বাবা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই সময়ের বিচক্ষণ ও সহানুভূতিশীল আচরণ একজন ভবিষ্যৎ বাবার কাছ থেকে একান্তই কাম্য।
গর্ভবতী স্ত্রীর কাছে স্বামীর ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
এটা হয়তো আপনি যেমনটা আশা করছেন তেমনই অথবা তার চেয়েও কিছুটা বেশি। গর্ভবতী মায়েরা সাধারণত স্বামীকে কতখানি পাশে চান সেটা বোঝার জন্য আমরা মাতৃত্ব ফেসবুক গ্রুপে কয়েকটি জরিপ আয়োজন করেছিলাম। জরিপের ফলাফল অনেকটা অবাক করার মত ছিল।
১ম জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে গর্ভাবস্থায় কার সহযোগিতা, ভালোবাসা, যত্ন মায়েরা সবচেয়ে বেশি আশা করেন? ১০২ জন অংশগ্রহণকারীর মাঝে প্রত্যেকেই স্বামীর কথা বলেছেন। শুধু ৬ জন পাশাপাশি বাবা-মায়ের কথাও বলেছেন।
এ থেকেই বোঝা যায় গর্ভাবস্থায় একজন মা তার নাজুক শারীরিক ও মানসিক অবস্থায় কার প্রতি নির্ভরশীলতা সবচেয়ে বেশি বাড়িয়ে দেন। একটা সুপ্ত ধারণা বিদ্যমান থাকতে পারে যে গর্ভবতী মায়েরা হয়তো এই সময় নিজের বাবা-মায়ের কাছে থাকতে বা তাদের যত্ন পেতেই বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু আমাদের জরিপবলছে যে মায়েদের এই সময় স্বামীর প্রতি নির্ভরশীলতা থাকে আরও অনেক বেশি।
২য় জরিপের প্রশ্ন ছিল লেবার পেইনের সময় কাকে মা সবচেয়ে বেশি পাশে চান? যদিও আমাদের দেশে বেশিরভাগ জায়গায় লেবার রুমে মায়ের সাথে কাউকে ঢুকতে দেয়া হয় না কিন্তু যদি ঢোকার সুযোগ থাকে তাহলে মা কাকে সাথে নিতে চান? ৯২ জন অংশগ্রহণকারীর মাঝে ৭২ জন বলেছেন যে লেবার পেইনের সময় স্বামীকে সবচেয়ে বেশি পাশে চান এবং উনাকেই লেবার রুম এর ভেতরে নিতে চান। ১৫ জন বলেছেন স্বামীকে লেবার পেইনের সময় সবচেয়ে বেশি পাশে চান এবং কাউকে ভেতরে নিতে চান না। ৩ জন বলেছেন স্বামীকে লেবার পেইনের সময় সবচেয়ে বেশি পাশে চান এবং অন্য কোন মহিলা আত্মীয়াকে লেবার রুমের ভেতর নিতে চান। ২ জন বলেছেন কোন মহিলা আত্মীয়াকে লেবার পেইনের সময় সবচেয়ে বেশি পাশে চান এবং কাউকে ভেতরে নিতে চান না।
আমাদের এবারের জরিপের চিত্রও প্রচলিত ধারণার ব্যতিক্রম। ৯০ জন অংশগ্রহণকারীই লেবার পেইনের সময় স্বামীকে সবচেয়ে বেশি পাশে চান। সুযোগ দেয়া হলে কাকে লেবার রুমের ভেতরে নিতে চান এই প্রশ্নের উত্তর তো আরো চমকপ্রদ! ৭৮% নারী বলেছেন যে উনারা স্বামীকে লেবার রুমের ভেতরে নিতে চান। এ থেকেই বোঝা যায় লেবার পেইনের সময় এবং সন্তান জন্মের সময় স্বামীর উপস্থিতি স্ত্রীর জন্য কতখানি অর্থ বহন করে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে অনেক স্বামীরাই এই সময় স্ত্রীর পাশে থাকতে চান না। কেউ হয়তো ভয় পান অথবা নিজেদের ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় কী করতে হবে বুঝতে পারেন না বিধায় উপস্থিত থাকাকে এড়িয়ে যেতে চান। এমনকি সিজারিয়ান ডেলিভারির সময়ও স্বামীর উপস্থিতি স্ত্রীর মনে অনেক সাহস যোগাতে পারে। প্রবাসে এই সুযোগ অনেক জায়গায় থাকলেও স্বামীরা সবসময় সেই সুযোগ নিতে চান না। স্বামীর পক্ষ থেকে কিভাবে এই বাধা দূর করা যায়? এই নিয়ে আমরা সামনে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
৩য় জরিপের প্রশ্ন ছিল সন্তান জন্মের পর, সন্তানের দেখাশোনায়, নিজের শারীরিক ও মানসিক যত্নে, সংসারের কাজে কার সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি আশা করেন? এই প্রশ্নে ১২২ জন অংশগ্রহণকারীর মাঝে ১১৪ জন বলেছেন স্বামীর কথা এবং শুধুমাত্র ৮ জন বলেছেন মা বা শাশুড়ির কথা।
এখানে অনেকে বলেছেন একক পরিবারে স্বামীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ আবার অন্যদিকে যৌথ পরিবারে শাশুড়ির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যৌথ পরিবার হলেও রাতে বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য, রাতে মায়ের শারীরিক যত্নে যে সহযোগিতার প্রয়োজন হয় সেটা মায়েরা স্বামীর কাছ থেকেই বেশি আশা করেন।
মায়ের জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের ব্যবস্থা করা, কাজে সাহায্যকারী রাখা, অথবা পরিবারের অন্য কাউকে সাহায্যকারী হিসেবে এনে রাখা অথবা নিজেই যথাসম্ভব সহযোগিতার চেষ্টা করা মায়ের শারীরিক ও মানসিক যত্নে অত্যন্ত জরুরি। এ কারণে মাতৃত্বে বাবার ভূমিকা অন্য সকল আত্মীয়দের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে চিত্রটা আশানুরূপ নয়। মাতৃত্বকে এবং ঘরের কাজ করাকে মেয়েলী বিষয় মনে করা এর পেছনে একটা বড় কারণ। এই মানসিকতার কিভাবে পরিবর্তন করা যায় এবং এর সমাধান কিভাবে হতে পারে সেটাই আমরা এই লেখায় দেখব ইনশাআল্লাহ।
আমাদের দেশের মায়েরা সাধারণত অল্পেই তুষ্ট থাকেন। বাবা যখন বাসায় থাকেন, তখন মা ও বাচ্চার যত্ন করতে সামান্য একটু চেষ্টা অথবা মুখে একটু ভালো আচরণ-ই তাদের খুশি করে দেয়। পেশাজনিত ব্যস্ততার কারণে যদি বাবারা সময় দিতে না পারেন, সেটা মায়েরা মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। তবে ডাক্তারের কাছে নিয়ে না যাওয়া, ভালো আচরণ না করা, ঘরের কাজে যতদূর সম্ভব সহযোগিতা না করা, সাহায্যকারী না রাখা, অন্যের প্রেগনেন্সির সাথে তুলনা করা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে মানিয়ে নেয়া যায় না বলে মায়েরা জানিয়েছেন।
স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় স্বামী কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন?
প্রথমবার মা হতে যাওয়ার সময় আনন্দ, উত্তেজনার পাশাপাশি উদ্বেগ, ভয়ও কাজ করে হবু মায়ের মনে। সেটা সঞ্চারিত হয় বাবার মাঝেও। তবে অনেকসময়ই বাবারা বুঝে উঠতে পারেন না কিভাবে নিজের ভূমিকা পালন করবেন বা কতটুকুই বা উনার করা প্রয়োজন। প্রথমেই,
প্রেগন্যান্সী নিয়ে পড়ুন
এর আসলে কোন বিকল্প নেই। এখন হাতের কাছে ইংরেজীতে প্রচুর জানার সুযোগ আছে। যদি আপনি বাংলায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তাহলে মাতৃত্ব সাইটের লেখাগুলো পড়ুন। আপনার স্ত্রী কিছু পড়ে আপনাকে জানাতে চাইলে মনোযোগ দিয়ে শুনুন। প্রেগন্যান্সীতে যে ধরণের জটিলতাগুলো হতে পারে সেগুলো নিয়ে বেশি পড়াশোনা করা মায়ের মনের ওপর চাপ ফেলতে পারে। তাই ভালো হয় বাবা নিজেই এগুলো নিয়ে ধারণা রাখলে যেন কিভাবে এসব সমস্যা থেকে কম ঝুঁকিতে থাকা যায় বা এসব সমস্যা মোকাবেলা করা যায়। তেমন কোন লক্ষণ স্ত্রীর মাঝে দেখলে তাহলে আপনি নিজেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবেন। গর্ভাবস্থায় সহবাস নিয়ে জানুন, আল্লাহ্ না করুক আপনার ভুলের মাসুল যেন আপনার স্ত্রী ও অনাগত সন্তানকে দিতে না হয়।
প্রেগন্যান্সীকালীন মুড সুয়িং নিয়ে জানতে চেষ্টা করুন। দাম্পত্য সম্পর্কে খিটিমিটি হয়ত অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারবেন, বুঝতে পারবেন যে অনেক রকম হরমোন এখন আপনার স্ত্রীর ভেতর কাজ করছে যা সামাল দিতে সে নিজেই হিমশিম খাচ্ছে। এ সময় আপনার সহযোগিতা তার একান্তই প্রয়োজন। নরমাল ডেলিভারী, সিজারিয়ান সেকশন, ব্রেস্টফিডিং, ফর্মুলা দুধ এগুলো নিয়ে জেনে রাখুন যেন প্রয়োজনমতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে স্ত্রীকে সাহায্য করতে পারেন। দেশে বা বিদেশে যদি প্রিনাটাল ক্লাস করার সুযোগ পান তাহলে তা কাজে লাগানোর সুযোগ কোনভাবেই নষ্ট করবেন না। এই ক্লাসগুলো সন্তানের আগমনে প্রস্তুতি নিতে কতটা উপকারী সেটা শুধু আপনি ক্লাস করার পরই বুঝতে পারবেন।
প্রেগন্যান্সীকালীন খাদ্যাভ্যাস নিয়ে জানুন
পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রেগন্যান্সীতে, এমনকি প্রেগন্যান্সীর পরিকল্পনা করার সময় থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনার বাচ্চা তার সঠিক বিকাশের জন্য আপনার ওপরই নির্ভর করছে, এমনকি তার জন্মের পরও। এক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা যেমন প্রত্যক্ষ, বাবার ভূমিকা পরোক্ষ হলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ তার উপরই মায়ের খাদ্যাভ্যাস অনেকটাই নির্ভর করে, বিশেষ করে আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে।
প্রেগন্যান্সীর পরিকল্পনা করার সময় থেকেই ভালো হয় একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিলে। তিনি হয়ত গর্ভধারণের তিন মাস আগে থেকে ফলিক এসিড খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিবেন। গর্ভধারণের পর জেনে নিন এই সময় আপনার স্ত্রীর কী পরিমাণ প্রোটিন, ক্যালশিয়াম ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। খেয়াল রাখুন এই সব তিনি প্রয়োজন মাফিক গ্রহণ করছেন কি না। যদি কাজ থেকে ফিরে দিন শেষে দেখতে পান স্ত্রী পর্যাপ্ত ক্যালশিয়াম বা প্রোটিন গ্রহণ করেননি তাহলে নিজেই এক গ্লাস দুধ বা একটি ডিম সিদ্ধ এনে তাকে দিন। মনে রাখবেন, এভাবে আপনি আপনার অনাগত সন্তানের দেখাশোনাও করছেন। দৈনন্দিন পুষ্টি যতটা সম্ভব খাবার থেকে গ্রহণ করতে চেষ্টা করাই শ্রেয়। তবে প্রয়োজনে ডাক্তার সাপ্লিমেন্ট ওষুধ দিলে স্ত্রী সেগুলো ঠিকমত খাচ্ছেন কি না লক্ষ্য রাখুন।
প্রেগন্যান্সীকালীন ব্যায়াম নিয়ে জানুন
প্রেগন্যান্সীতে স্বাভাবিক হাঁটাচলা, কাজ করা, সিড়ি ভাঙ্গা এসব নিয়ে আমাদের দেশে প্রচুর ভুল ধারণা রয়েছে। এগুলো নিয়ে জানুন। স্ত্রীকে যদি বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে ভাবেন তার আরামের ব্যবস্থা করে দিলেন এবং ডেলিভারির সময় যদি দেখা যায় তিনি দিনরাত শুয়ে-বসে থাকার কারণে নরমাল ডেলিভারির জন্য উপযোগী না তাহলে এর দায় কিন্তু আপনার উপরও বর্তায় ।
অন্যদিকে তার শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা না করে তাকে দিয়ে এসময় সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ করানো অনেক সময়ই স্ত্রী ও অনাগত সন্তানের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। মূলত, আপনার স্ত্রী যদি সুস্থ ও কম ঝুঁকির মাঝে থাকেন তাহলে তিনি স্বাভাবিক সব কাজই করতে পারবেন এবং এটা উনার প্রেগন্যান্সীর জন্যও উপকারী। অন্যদিকে, প্রেগন্যান্সীর কোন পর্যায়ে স্ত্রী যদি বলেন কোন বিশেষ কাজ করা উনার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে তাহলে উনার কথায় গুরুত্ব দিন ও সেই ব্যপারে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চেষ্টা করুন।
গর্ভকালীন ব্যায়াম নিয়ে জানুন। স্ত্রীকে উৎসাহিত করুন নিয়মিত অনুশীলন করতে। যেদিন বাড়িতে থাকবেন সেদিন স্ত্রীর সাথে আপনিও ব্যায়াম করুন। হাঁটা এসময়ের অত্যন্ত উপকারী ও খুবই সহজ একটি ব্যায়াম। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে ছাদে বা খোলা জায়গায় কোথাও হাঁটতে বের হোন। গর্ভাবস্থা থেকেই স্ত্রীকে ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে উৎসাহ দিন। নিজেও সাথে করুন।
নিজ থেকেই করুন
গর্ভাবস্থা অত্যন্ত ক্লান্তিকর একটা সময়। স্বাভাবিক কাজ করাও এই সময় আপনার স্ত্রীর পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে। তাই উনার বলার জন্য অপেক্ষা করবেন না। ঘরের কাজ, রান্না, কাটাকুটিতে, আগের বড় বাচ্চা থাকলে তাদের দেখাশোনায় নিজ থেকেই এগিয়ে আসুন। আপনি একজন গর্ভবতী নারীর দু’য়া পাবেন। এই নিয়ে মাতৃত্ব’তে প্রকাশিত “দুইজনের একসাথে জটিলতাপূর্ণ প্রেগনেন্সি যাত্রা পাড়ি দেওয়ার” চমৎকার গল্পটি পড়তে পারেন।
সন্তানের আগমনের পরও স্ত্রীর উপর থেকে ঘরের কাজের চাপ কমাতে সচেষ্ট থাকুন। নবজাতকের দেখাশোনায় অংশগ্রহণ করুন। স্ত্রীর পর্যাপ্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিন। স্ত্রীর দ্রুত সেড়ে ওঠায় প্রসবোত্তর যত্ন ও ব্যায়াম নিয়ে ধারণা রাখুন। ব্রেস্টফিডিংকালীন সময়ে উনার খাদ্যাভ্যাসের প্রতি যত্নশীল হোন।
লেবার পেইনের সময় স্ত্রীর পাশে থাকুন
আপনার স্ত্রীর এই সময় আপনাকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, যদি না উনি নিজ থেকেই অন্যরকম কিছু বলেন। এই নিয়ে আগে থেকে পড়াশোনা করা থাকলে স্ত্রীকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা আপনার জন্যই সুবিধা হবে । ব্রিদিং এক্সারসাইজ এই সময় খুবই উপকারী ব্যাথা সামলানোর জন্য। স্ত্রীকে মনে করিয়ে দিন এটার কথা, নিজেও উনার সাথে করুন কন্ট্রাকশনের সময়।
যতক্ষণ সম্ভব স্ত্রীকে হাঁটতে উৎসাহিত করুন, নিজেই উনার সাথে হাঁটুন। লেবার পেইন কম থাকার সময়ই ভালো করে দুপুরের বা রাতের খাবার যেটা সামনে থাকবে খেতে বলুন। যখন পেইন বেড়ে যাবে তখনও উনাকে খেজুর, পানি খেতে মনে করিয়ে দিন যাতে উনার শেষ পর্যন্ত শক্তি থাকে, পানিস্বল্পতা না হয়। প্রতি ১ থেকে ২ ঘন্টায় বাথরুমে গিয়ে প্রস্রাবের মাধ্যমে ব্লাডার খালি করার কথা মনে করিয়ে দিন। এতে বাচ্চা নিচের দিকে নামতে সুবিধা হবে।
তীব্র কন্ট্রাকশনের সময় কন্ট্রাকশনের মাঝে উনাকে বিশ্রাম নিতে বলুন, বালিশ বা কুশন ইত্যাদি দিয়ে উনার আরামের ব্যবস্থা করে দিন। যদি কোমর ব্যথা থাকে ম্যাসাজ করে দিতে পারেন, হট ওয়াটার ব্যাগ ওই স্থানে লাগানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারেন, উনি আরাম পাবেন। উনাকে উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলুন যেন উনি সাহসের সাথে ব্যথা মোকাবেলা করতে পারেন।
যদি কোন বিশেষ পরিস্থির উদ্ভব হয় এবং আপনার স্ত্রীকে হাসপাতাল পর্যবেক্ষণের মাঝে থাকতে হয় তাহলেও উনার পাশে থাকুন, উনি সাহস পাবেন। কোন প্রয়োজনে সহযোগিতা করুন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে এবং আপনার স্ত্রী চাইলে লেবার রুমে বা সি-সেকশনের সময় ওটিতে উনার সাথে থাকুন। আপনার আগে থেকে অর্জিত জ্ঞান এই সময় আপনাকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও সাহস যোগাবে সন্তানের আগমনের মূহুর্তে স্ত্রীর পাশে থাকতে। শুধুমাত্র আপনার শান্ত, দৃঢ় উপস্থিতি, উনার হাতটা ধরে রাখা বা এক দুইটা উৎসাহমূলক কথাও আপনার স্ত্রী আজীবন মনে রাখবেন। আপনি বিশ্বাস করুন বা না করুন, এই সময় আপনাকে পাশে পাওয়া আপনার স্ত্রীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ! এমনকি লেবার রুমে যদি কোন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে এবং ডাক্তারদের মায়ের আত্মীয়দের কারো সাথে কথা বলার প্রয়োজন পড়ে তাহলে আপনার উপস্থিতি সেখানে একান্তই প্রয়োজন। তাই স্ত্রীর লেবারের তারিখটাকে নিজের মাথায় গেঁথে নিন, যত ব্যস্ততাই থাকুক সেই বিশেষ দিনটায় কাজ থেকে অব্যাহতি নেয়ার প্রস্তুতি আগে থেকেই গ্রহণ করে রাখবেন।
ছোট-বড় আরও কিছু বিষয়
প্রেগন্যান্সীতে সঠিক ডাক্তারের খোঁজ করতে স্ত্রীকে সাহায্য করুন। ডাক্তারের ভিজিটে স্ত্রীর সাথে যান। স্ত্রীর মনের যত্ন নিন, সন্তান হওয়ার পরও। প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা নিয়ে জানুন। প্রেগন্যান্সীতে ও সন্তান জন্মের পরও স্ত্রীকে বাইরে ঘুরতে নেয়া, তার পছন্দের খাবার খাওয়ানো, তাকে সময় দেয়া এবং তার মতো করে তাকে কিছুটা সময় কাটাতে দেয়া খুব জরুরী।
হাসপাতালে নেয়ার ব্যাগে কী কী গোছানো উচিত, কিভাবে কোন পথে হাসপাতালে সহজে যাওয়া যাবে, নবজাতকতে স্বাগত জানানোর জন্য কী কী কেনা উচিত, করা উচিত (স্বাস্থ্যগত ও ধর্মীয় দিক থেকে) এগুলো আগেই জেনে রাখুন। সন্তানের জন্ম উপলক্ষ্যে আপনার অফিস থেকে কতদিনের ছুটি নিতে পারবেন সেটাও আগে থেকে জেনে রাখুন।
অনেক সময় স্বামীরা জানেন না বলে প্রেগন্যান্সী, লেবার ও নবজাতকের দেখাশোনা বিষয়ে পিছিয়ে থাকেন। যখন উনারা বিষয়গুলো নিয়ে জানেন তখন নিজেদের ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা রাখতে পারেন ও পুরো প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহ বোধ করেন। এটা আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও সত্যি। এর চমৎকার উদাহরণ পাওয়া যায় মাতৃত্ব’তে প্রকাশিত প্রসব অভিজ্ঞতা “আমার আলিয়া হওয়ার গল্পে”।
নবজাতকের দেখাশোনায় বাবা কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন
শিশুর জীবনে বাবার সক্রিয় অংশগ্রহণের অসাধারণ উপকারীতা আছে! সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া গেছে:
- বাবা যদি বাচ্চার একজন প্রাথমিক সেবাপ্রদানকারী হিসাবে ভূমিকা রাখেন, তাহলে বাচ্চারা অপরিচিতদের সাথে ভালো মানিয়ে নিতে পারে।
- যে সব বাচ্চাদের মা ও বাবা দুইজনের সাথেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে তাদের বড় হয়ে সফল সম্পর্ক গঠনের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- মায়ের পাশাপাশি বাবার ভিন্নধর্মী স্পর্শ, কণ্ঠস্বর, খেলার ধরণের স্বাদ বাচ্চারা পেলে তারা বিভিন্ন রকমের মানুষ ও ব্যক্তিত্বের সাথে আরও ভালোভাবে মানিয়ে নেয়া শেখে।
- মায়ের মতো বাবারাও নবজাতকের বিভিন্ন আচরণের প্রতি স্পর্শকাতর হতে পারেন ও প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন।
- বাচ্চার সাথে বাবাদের খেলার ধরণ মায়েদের তুলনায় বেশি সবল ও উপভোগ্য হয় যার ফলে তারা বাচ্চাদের মনোযোগ বেশি সময় ধরে রাখতে পারেন। বাচ্চারা যখন এই ভিন্ন ধরণের খেলার প্রতি উজ্জীবিত হয় তখন তাদের মস্তিষ্কের শেখার ক্ষমতা বাড়ে।
- যেসব ছেলে শিশুদের বাবারা তাদের সযত্নে প্রতিপালন করে তারা বড় হয়ে আত্মবিশ্বাসী, পড়াশোনায় সফল, উদার ও সহানুভূতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- যেসব ছেলে শিশুদের বাবারা তাদের বই পড়ে শোনায় তাদের পড়ুয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- যেসব মেয়ে শিশুদের বাবারা তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও তাদের সযত্নে লালন করে তারা নিজের লিঙ্গের ব্যপারে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার এবং কিশোরী বয়সে ও বড় হয়ে তাদের বিপরীত লিঙ্গের সাথে ভালো সংযোগ স্থাপনের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এতগুলো ইতিবাচক দিকের কথা পড়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে বাবাদের ভূমিকা শিশুর জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ! যেসব বাবারা এক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন তাদের জন্য ভাবনার খোরাক আছে এতে। সেই সাথে সন্তানের সাথে কিছু অপার্থিব সুন্দর মুহূর্ত কাটানোর সুযোগ হেলায় হারাচ্ছেন কিনা ভেবে দেখুন। এই নিয়ে জনপ্রিয় প্যারেন্টিং আলোচক শিবলী মেহেদীর বক্তব্য শুনতে পারেন “বাবারা শুনুন” ভিডিও থেকে।
আপনি কী চান বড় হয়ে আপনার সন্তান আপনাকে ভয় পাক নাকি যে কোন সমস্যায় সে আপনার কাছেই ছুটে আসুক? আপনার থেকে ভালো মন্দ শিখে নিক? আপনাকে দেখেই সুঅভ্যাস গড়ে তুলুক? এই দীর্ঘমেয়াদী অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলার ভিত্তি তার নবজাতক অবস্থাতেই শুরু হয়ে যায়। তাই বীজ বপনের পরও নিজের যে ভূমিকা রয়েছে সে সম্পর্কে সচেতন হোন।
![](https://matritto.b-cdn.net/wp-content/uploads/2020/08/d0a8c6ef36a8d68b1f865076f9ce2779.jpg)
অন্যদিকে, বাবাদেরও পরিবারের সদস্যদের কাছে থেকে উৎসাহ পাওয়ার প্রয়োজন আছে। লেবারের সময় অংশগ্রহণ করতে উনাকে উৎসাহ দিন ও নবজাতকের সাথে উনাকে কিছু সময় একা কাটাতে দিন। উনার সন্তান প্রতিপালনের ধরন যদি কিছুটা ভিন্নরকমও হয় তাহলেও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান। বাবাকে নবজাতকের সাথে সময় কাটানোর পর্যাপ্ত সুযোগ করে দিন।
মায়েরা অনেক সময় মনে করেন উনাকেই সব করতে হবে বা বাবারা ঠিকমত করতে পারবেন না। এই ভাবনায় পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করুন। বাবাদের সুযোগ দিন, দেখবেন তারাও অনেক কিছুই করে ফেলতে পারেন যদিও সেটা হয়ত আপনার চেয়ে কিছুটা অন্যরকম। কিন্তু দিন শেষে আপনিই কিছুটা বিশ্রাম পাবেন যদি আপনার স্বামী শিখে যান। প্রবাসে বা একক পরিবারে বাবা যদি বাচ্চার প্রতিপালনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তাহলে মায়ের জন্য অত্যন্ত উপকার হয়।
মাতৃত্ব ফেসবুক গ্রুপের একজন মা বলেছেন,“প্রেগন্যান্সীর সময় আমি যা কিছু পড়তাম, হাসব্যান্ডের সাথে শেয়ার করতাম। বলতে গেলে তাকে শিখাতাম। যেহেতু আমাদের প্রথম বাচ্চা এবং আমার হাসব্যান্ড ফ্যামিলিতে কোনো ছোট বাচ্চা সেভাবে দেখেনি তাই বাচ্চা সম্পর্কিত তার তেমন কিছু জানা ছিল না। এমনকি ডায়াপার পড়ানোর সিস্টেমও আমি তাকে বলতাম। ডেলিভারি রুমে কী কী হতে পারে সব বলতাম যেন ভয় না পায়। মায়েদের চিৎকার থেকে শুরু করে বাচ্চার নাড়ী কাটা সব। সবকিছু বলার কারণ হল যেহেতু জানে না, সে যেন ভয় না পায়। একটা মানসিক প্রস্তুতি যেন থাকে আর যদি এমন পরিস্থিতি আসে যে তার একাই বাচ্চা পালা লাগছে তাহলে বাচ্চা নিয়ে যেন সে হিমশিম না খায়। আমি মনে করি সব মায়েদের এই কাজটা করা উচিত।”
পরের পর্বে আমরা প্যারেন্টিং বিষয়ে সচেতন এমন কয়েকজনের কেস স্টাডি দেখব।
ছবি কৃতজ্ঞতা: Vector Stock, Pinterest