(এই মায়ের প্রথম সন্তান হওয়ার গল্প পড়তে দেখুন প্রসব অভিজ্ঞতা আমার মুহাম্মাদ হওয়ার গল্প)

এবার ২য় প্রেগন্যান্সি প্রথমটা থেকে ব্যতিক্রম। কারণ প্রথম বার তিন মাস পর থেকে মায়ের বাসায় ছিলাম। আর এবার মায়ের বাসা থেকে ৩/৪ মাসের মাথায় নিজের বাসায় ব্যাক করি। এবার মোটামুটি বেশ এক্টিভ ছিলাম। কাজকর্ম করতে হয়েছে বেশ। বড়টাকে দেখা, খাওয়ানো সব ই করতে হয়েছে। দুধ ও খাওয়াতে হতো। খাওয়া দাওয়া ঠিক ঠাক মত হয়নি। ওষুধও ঠিক মত খেতাম না। ফলশ্রুতিতে এবার হিমোগ্লোবিন লেভেল ছিল ৮.৩। লেবারের দিন ব্লাড লেগেছিল। তাছাড়া প্রচুর পা টানত যেটা আগের বার ছিল না। নিঃশ্বাসের কষ্ট হতো প্রায় রাতে। চুলকানিও ছিল এবার। ওজন আগের বারের অর্ধেকও বাড়েনি। যদিও আল্ট্রাতে সবসময়ই বাবুর ওয়েট নর্মাল আসতো। পরে দেখা যায় বাবুর ওয়েট বর্ডার লাইন বরাবর ই ছিল আলহামদুলিল্লাহ।

প্রথম ৩ মাস খুবই খারাপ লাগতো। আস্তে আস্তে খারাপ লাগা কমে এসে ৪ মাসের পর থেকে একদম সবই করতে পারতাম আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহই সহজ করে দিয়েছিলেন আসলে। আলহামদুলিল্লাহ। ডেইটের প্রায় ১৮-২০ দিন আগে বাসায় আসি। এবার অপেক্ষার পালা। ২য় বাচ্চা, তাই ভেবেছিলাম সময়ের আগেই হয়তো হবে এবার সব। কিন্তু আস্তে আস্তে ডেইটের দিন চলে আসতে থাকে, কিন্তু কোন লক্ষণই নাই। এবার এতটা এক্টিভ ছিলাম যে ভেবেছিলাম এবার আগেই সব হবে, দ্রুত হবে। সবার ক্ষেত্রে আসলে ব্যাপারটা এক না।

২৪ তারিখ ছিল আমার ডেইট। এর ১০-১২ দিন আগ থেকে নিয়মিত আজওয়া খেজুর ৭টা করে এক নিয়তে খেতাম। ২৩ তারিখ অনেক্ক্ষণ দাঁড়ালাম, হাঁটলাম। ২৪ তারিখ যখন ফজর পড়ে ঘুমাবো, এরপর দেখি কন্ট্রেকশন আসছে। অনেক্ক্ষণ পর পর আসে। আর ঘুমাতে পারছি না তখন। এর আগে এক বার একদিন এক ঘন্টা এরকম ছিল। তাই ভাবলাম দেখি কি হয় এবার। ধীরে ধীরে ৫-৬ মিনিট পর পর আসা শুরু হল। ৮.৩০ বেজে গেছে। ছেলেও উঠে গেছে। এরপর আম্মুকে ডেকে বললাম মনে হয় ব্যথা শুরু হয়েছে। তারপর তাড়াতাড়ি সবাই সব ঠিক করে হাসপাতালের জন্যে বের হলাম। হাসপাতালে লেবার রুমে পি/ভি করে ডিউটি ডাক্তার বলল লেবার প্রসেস শুরু হয়ে গিয়েছে। ১.৫ সে. মি খুলেছে জরায়ুর মুখ। আর হিমোগ্লোবিন কম থাকায় ম্যাম রক্ত দিতে বললেন ফোনে।

আগের বারের ভয়াবহতায় লেবার রুমে ঢুকে আমার অস্থির, খারাপ লাগা বেড়ে গেল। আবার আম্মুদের কাউকেও ঢুকতে দিচ্ছে না৷ তারা সময় যে আরো লাগবে জানে না। না জানি কত অস্থির হয়ে আছে। এ অস্থিরতায় আমার নিজের অস্থির লাগতে থাকল। তার উপর ভয়, আতংক। দুপুরে ব্লাড নেওয়ার আগে দেখা করতে পারলাম আম্মুদের সাথে আর জানিয়ে দিতে পারলাম যে দেরি হবে, টেনশন না করতে। আলহামদুলিল্লাহ রিলিভড লাগল। মনে হল মূসা (আ) এর মায়ের মত আল্লাহ তায়ালাও যেন আমার অন্তরকে প্রশান্ত করলেন।

এদিকে ব্যথা কমে গেল, ঘন্টায় ২টা বা ৩টা কন্ট্রেকশন। বিকেলে পি/ভি করে দেখা গেল ২.৫ সে.মি। প্রগ্রেস খুব স্লো। আর ৪ সে.মি না খোলায় পিটন দেওয়া যাবেনা এখন। আমি তো পিটনের ভয়ে শেষ। কিভাবে এবার পিটন সহ্য করব। গতবারের অভিজ্ঞতা তো ছিল ভয়ংকর। শুধু দুয়া করতে থাকলাম সহজতার জন্যে, কল্যাণের জন্যে৷ পরে আমি কেবিনে যেতে চাইলাম। অন্তত আম্মু একটু রিলিভড থাকবে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর মনে হল ব্যথা আবার বাড়ছে। ঘন্টায় ৩/৪ টা হলেও সেগুলো আস্তে আস্তে দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। এবার আগেরবারের থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম। পেইন ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারগুলি এবার জেনে গিয়েছিলাম। breathing exercise আর hip rotation করলে ব্যথা সহ্য করা যেত। হাঁটলে লেবার প্রগ্রেস হয়, তারপরও হাঁটতে ইচ্ছে করে নাই। এবার যতটুক পেরেছি ঘুমিয়ে নিয়েছি বা রেস্ট নিয়েছি আর খাওয়ার চেষ্টা করেছি কারণ জানি পুশের জন্যে এনার্জি লাগবে। শুয়ে শুয়েই হিপ মুভমেন্ট করতাম কন্ট্রেকশনের সময়। আর সহ্যকর না পারলে মনে হলে ওড়না মুখে দিয়ে দিতাম যাতে চিৎকার না করি। আম্মুর জন্যে বেশি ভয় লাগতো। আমার এ অবস্থা দেখলে আম্মু সহ্য করতে পারবে না। ২টার পর আর পারি না। কন্ট্রেকশন আধা ঘন্টায় ২/৩ টা। কিন্তু অনেকক্ষণ স্থায়ী। চিৎকার বের হয়ে যাবে এমন অবস্থা। পরে আম্মুকে উঠিয়ে বললাম লেবার রুমে যাব। ওখানেই থাকি।

২.৩০ টার দিকে ওখানে গেলাম। পি ভি করে দেখল ৪ সেমি খুলে গেছে, বাচ্চার মাথা একদম নিচে। ডেক্সট্রোজ স্যালাইন দিল, এত রাতে তো আর পিটন দেওয়া সম্ভব না। আর বলল ব্যথা বাড়লে বলতে। এবার কন্ট্রেকশন বেশ কয়েক মিনিট পর পর আসতে থাকল। কন্ট্রেকশন ফ্রি টাইমে কী শান্তি। কিন্তু কন্ট্রেকশনের সময় প্রথম দিকে সহ্য করা গেলেও শেষের সময় hip movement, breathing, মুখে কাপড় কিছুতেই কাজ হয়নি। চিৎকার করে উঠি আর পারি না আল্লাহ। আল্লাহর নাম গুলি শিখে গিয়েছিলাম এবার। আল্লাহর নাম ধরে, তাঁর মাহাত্ম্য, তাঁর বড়ত্ব, তাঁর নামের উসিলায় কন্ট্রেকশন ফ্রি টাইমে দুয়া করতে থাকি। শেষে আর পারি না। ৪ টার দিকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় লেবারের সব রেডি করে। মনে হচ্ছিল পুশ করা সম্ভব হবেনা। আমার প্রেশারও ছিল খুব লো। পিটন দেওয়া হল এবার স্যালাইনে। এবার আর কোন ফ্রি পিরিয়ড নাই। শুধু কন্ট্রেকশন। দাঁতে দাঁত চেপে ( গত বার নিষেধ করা হয়েছিল ঠোঁটে চাপ না দিতে, ঠোঁট কেটে যায়) চিৎকার করে প্রেশার দিই। বের হয় না। তারা বলল চিৎকার না করতে। আমি চিন্তা করি চিৎকার না দিলে কী সম্ভব নাকি প্রেশার দেওয়া। আমি ভ্রুক্ষেপ না করে সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করি। এবার বাথরুম বের হওয়ার সাথে সাথে পানি ভেংগে বাচ্চাও বের হয়ে আসল। আলহামদুলিল্লাহ…. কী শান্তি! অবসান হল সব যন্ত্রণার…… ছেলে বাবু হল আমার আলহামদুলিল্লাহ। আমার ২য় ছেলে।

আমার এপিসিওটমি লেগেছিল। স্টিচ পড়ল। তবে গতবার তো অনেক স্টিচ পড়েছিল। টিয়ার হয়েছিল সে সময় বেশ। আলহামদুলিল্লাহ সে অনুযায়ী এবার ব্যথা তাই কম ছিল। নর্মাল হাঁটাচলাও করতে পারছিলাম এবার। যেখানে ওই বার বসতেও পারছিলাম না। আলহামদুলিল্লাহ। এবার আগের বারের চেয়ে কম কষ্ট হয়েছিল। যদিও আগের বারের চেয়ে বেশি সময় ধরে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল এবার পেইন ঠিকমত না উঠায়। আসলে আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। ২য় বাচ্চার ক্ষেত্রে সাধারণত কম সময় লাগার কথা ছিল। আর ওরকম হলে আমাকে ইন্ডাকশনই দিত। কিন্তু রাত হওয়ার আর জরায়ুর মুখ ধীরে খোলায় ইন্ডাকশন দেওয়া হয় নাই। অক্সিটোসিন দিলে ব্যথা আসতে থাকে একটার পর একটা, ঢেউয়ের মত তীব্র ভাবে, কঠিন ভাবে, আরো শক্ত ভাবে। এই ব্যথার তুলনা নাই আসলেই। শেষের দিকে তো ব্যথা ফ্রি সময়ও পাই নাই। প্রাকৃতিক ভাবে যে ব্যথা উঠে আর যে মাত্রার ব্যথা হয়, কন্ট্রেকশন যেভাবে প্রগ্রেস করে সেটাই আসলে উত্তম, তাহলে নর্মাল ডেলিভারি অন্তত এতটা ভয়ংকর লাগে না।

যদিও এবারের কষ্ট সামান্য ছিল ব্যাপারটা কখনোই তা না। এত চেষ্টা করেও শেষের দিকে চিৎকার করা ছাড়া থাকতে পারিনি। মা হওয়ার কষ্ট যে এর মধ্যে দিয়ে যায় সেই আসলে বুঝে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্মদাত্রী মায়েদের উপর রহম করুক। আমার বড় ছেলের ডেইট ছিল ৩০ আগস্ট। সেবার আমার ব্যথা উঠে ৩০ আগস্ট বিকেলে। বাবু হয় ৩১ আগস্ট সকালে। এবার ডেইট ছিল ২৪ মে। এবার ব্যথা উঠে ২৪ মে সকালে। বাবু হয় ২৫মে ভোরে। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহরই অনুগ্রহ। পোস্ট ডেটেড হওয়াকে সবসময় ভয় পেতাম খুব। আলহামদুলিল্লাহ যে আল্লাহ অনেক সহজ করে দিয়েছেন আমার জন্যে। আমার মাও এত দুয়া করত। আমার মা বাবা, ভাই, বোন, হাজবেন্ড, পাশের আন্টি সবারই অনেক অনেক কন্ট্রিবিউশান ছিল এবারের প্রেগ্ন্যাসিতে। আল্লাহ সবাইকে অনেক অনেক উত্তম প্রতিদান দিক। আমার বার বার মনে হচ্ছিল ” হে আমার রব! আমি তো তোমায় ডেকে কখনো ব্যর্থ হয় নি।” আমি এত ভয়ে থাকতাম। আর সব সময় দুয়া করতাম, নফল নামাজ পড়ে সাহায্য চাইতাম আল্লাহ আমি যেন সহজভাবে, সুন্দরভাবে, প্রাকৃতিক ভাবে সুস্থ, সুন্দর, নেককার সন্তানের জন্ম দিতে পারি। আল্লাহ তায়ালা আসলেই দুয়া কবুল করেছেন আমার কল্পনার চেয়েও সুন্দর ভাবে আলহামদুলিল্লাহ। নিঃসন্দেহে তিনি আল মান্নান, আল ওয়াদুদ, আল ওয়াহহাব, আমাদের সত্যিকারের একমাত্র রব। আলহামদুলিল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ।

(লিখেছেন উম্ম মুহাম্মাদ)

ছবি কৃতজ্ঞতা: Kids Stores

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা