বেশীরভাগ গর্ভধারণ পঞ্চম সপ্তাহে নিশ্চিত হয়। এই সময়ে এসে গর্ভধারনের এক মাস ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে। পিরিয়ডের ডেট চলে গেছে, এরই মধ্যে বাসায় প্রেগন্যান্সি টেস্ট করা হয়েছে এবং প্রেগন্যান্সী হরমোনের প্রভাবে গর্ভধারনের লক্ষনগুলো সুস্পষ্ট। এই পঞ্চম সপ্তাহে আল্ট্রাসাউন্ড করা হলে বহুল কাঙ্খিত ভ্রুনের দেখা মিলবে।

আপনার শরীরে যা পরিবর্তন আসবে

প্রেগন্যান্সি টেস্টে প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে হরমোনের উপস্থিতি প্রমান করে আপনি গর্ভবতী। সাধারনত বাসায় করা পরীক্ষা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্ভুল হয়। কারন একমাত্র গর্ভবতী অবস্থাতেই এই হরমোন নিঃসরন হয়। বমিভাব, খাওয়ায় অরুচি, ক্লান্তি, স্তনের নরমভাব সব এই হরমোনের কারনেই হয়। আকারে ছোট জরায়ু এইসময় বাড়ন্ত বাচ্চাটিকে জায়গা দেয়ার জন্য বেড়ে উঠছে। এইজন্য যে বেশী জায়গার দরকার পড়ে, তার জন্য আপনি অতিরিক্ত চাপ বোধ করতে পারেন। ঘনঘন বাথরুমে যাওয়ার দরকার হতে পারে আপনার। যদিও আপনাকে দেখে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই যে আপনি সন্তান-সম্ভবা। এই সময়ে যে লক্ষণগুলো পরিস্কার হবে-

  • মর্নিং সিকনেস (Morning Sickness)- সারাদিন মাথাঘুরানো এবং বমিভাব
  • তলপেটে ব্যাথা
  • ঘনঘন প্রস্রাব
  • হালকা রক্তপাত বা স্পটিং (Spotting)
  • ক্লান্তি বোধ
  • স্তন নরম ও ভারী বোধ হওয়া
  • খাবারে রুচি বা অনীহা
  • মেজাজের উঠানামা (Mood Swing)
  • কোষ্ঠকাঠিন্য
  • অতিরিক্ত ডিসচার্জ- হাল্কা গন্ধযুক্ত ঘন সাদা স্রাব

আপনার যদি যমজ বাচ্চা হয়ে থাকে, তবে এইসময়ের আল্ট্রাসাউন্ডে সেটা বোঝা যাবে। সেক্ষেত্রে দুটি জেস্টেশনাল স্যাক (Gestational Sac) দেখা যাবে। তবে অনেক সময় শুরুতে দুইটি স্যাক দেখা গেলেও, পরে দেখা যায় একটাই বাচ্চা। একে বলা হয় ভ্যানিশিং টুইন সিন্ড্রোম (Vanishing Twin Syndrome)। ঠিক কি কারনে এমনটা হয়, সেটা ঠিক জানা যায় না। আপনার তলপেটে ব্যাথা হতে পারে, হালকা রক্তপাত হতে পারে আবার কোনরকম লক্ষণ নাও থাকতে পারে।

বাচ্চার বেড়ে উঠা

এই সময়ে বাচ্চা খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। এই সপ্তাহের শেষের দিকে এসে বাচ্চাটির আকৃতি দাঁড়ায় একটা ব্যাঙ্গাচির মতো। এর আবার একটা লেজও থাকে। সবমিলিয়ে এর আকার ১-৫ মিলিমিটার। আকারে একটা কমলার বিচির সমান।

এই সপ্তাহে বাচ্চার কঙ্কালের গঠন হয়। এর সাথে হৃদপিন্ড, হাড়, মাংশপেশী দ্রুত গঠিত হতে থাকে। হার্ট খুব দ্রুত গঠিত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই পঞ্চম সপ্তাহে আল্ট্রাসাউন্ড করা হলে হার্টবিট পাওয়া যায়।

প্লাসেন্টার গঠন যেহেতু শুরু হয়ে গেছে, প্লাসেন্টা এবং এম্বেলিকাল কর্ডের মাধ্যমে ভ্রুন মায়ের শরীর থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করছে। নাক, কান, চোখ, পায়ের পাতা, আঙ্গুল এগুলো ধীরে ধীরে বোঝা যাওয়া শুরু হয়েছে।

এই সময়ে গঠিত হয় নিউরাল টিউব, যা পরে ব্রেইন এবং স্পাইনাল কর্ড তৈরি করে। এই গঠনের ত্রুটি হলো স্পাইনা বিফিডা (Spina Bifida)। এই ত্রুটি রোধ করতে ফলিক এসিড এই সময় খুব জরুরি।

অকাল গর্ভপাত বা মিসক্যারেজের (Miscarriage) লক্ষণ

পরিসংখ্যান বলছে, শতকরা ১৫ ভাগ গর্ভধারণ অকাল গর্ভপাত বা মিসক্যারেজের শিকার হয়। প্রেগন্যান্সির প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তা হয়। বেশীরভাগ মিসক্যারেজের লক্ষণ রক্তপাত এবং এই রক্তপাত স্পটিং এর থেকে অনেক বেশি হয় এবং চাকা চাকা হতে পারে। এর সাথে তলপেটে ও পিঠে ব্যাথা হবে। এরকম লক্ষণ থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

একটোপিক (Ectopic) প্রেগন্যান্সিতে ভ্রুন টিকে থাকে না। এতে আসলে ভ্রুনটি জরায়ুতে না বসে, ফেলোপিয়ান টিউবে চলে যায়। এতেও মিসক্যারেজের মতো লক্ষণ থাকে, যেমন রক্তপাত, তলপেটে ও ঘাড়ে ব্যাথা, পিঠে ব্যাথা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। এইসব লক্ষণ থাকলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ডাক্তার দেখান।

এই সপ্তাহে আপনার জন্য টিপস

  • এ সময়টাতে যেহেতু ভ্রুনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্ধন (Development) হয়,  তাই যে কোন ধরনের খাবার ঔষুধের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করুন। কারণ আপনার খাওয়া ওষুধের প্রভাব এখন ভ্রুণের উপরও পড়ছে।
  • হজমে সমস্যা হলে একবারে বেশী না খেয়ে, বড় খাবারকে ছোট ছোট ভাগে ভেংগে খান। অর্থাৎ দিনে ৩ বার বেশী খাবারের বদলে ছোট ছোট ভাগে ৪-৫ বার খান।
  • মর্নিং সিকনেসের কারনে একেবারেই যদি খাবার বা পানি কিছুই পেটে রাখতে না পারেন, ডাক্তার দেখান। কারো কারো ক্ষেত্রে মর্নিং সিকনেস খুব বেশী হতে পারে।
  • গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়, যেজন্য গর্ভবতী মা’র মাথা ঘুরায়। যদি এরকম হয়, তাহলে আপনার অবস্থান বদল করুন। দাঁড়িয়ে থাকলে বসে পড়ুন, বসে থাকলে, শোয়ার অবস্থা থাকলে শুয়ে পড়ুন।
  • এসময়ে স্পটিং হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে গর্ভসঞ্চারের সময় স্পটিং হতে পারে। ঘাবড়ে যাবেন না।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে প্রচুর পানি ও শাকসবজি খান।
  • মুড সুইং এর জন্য খারাপ লাগা, রাগ, অভিমান বেশী বেশী হতে পারে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু যদি মনে করেন, এটা একদমই আপনার নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে, ডাক্তারের সাথে এই বিষয়ে কথা বলুন।
  • ফলিক এসিড সমৃদ্ধ প্রি-ন্যাটাল মাল্টিভিটামিন খেতে থাকুন।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ মাদারসস্পেস ডট ইন

লেখাটি রিভিউ করেছেন –

ডাঃ মাশরুরা মাহজাবিন
MBBS
General Practioner, Trained Mental health counselor

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা