একটি শিশুকে পৃথিবীতে স্বাগত জানাতে বেশ কিছু প্রস্তুতি দরকার হয়। গর্ভবতী মায়ের সঠিক পরিচর্যা, একটি নিরাপদ প্রসব ও শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর ধর্মীয় বিধান পালন করার সাথে সাথে চিন্তা করতে হয় শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ সংগ্রহ করে রাখার ব্যাপারে।

অনেক নতুন মা- বাবা বুঝে উঠতে পারেন না শুরুতে কী কিনবেন। তাদের সাহায্যেই আজকের এই লিখা।

কেনার আগে যা খেয়াল রাখতে হবে

১। বাচ্চার জন্মের সময়কার ও পরবর্তী কয়েক মাসের ঋতু  খেয়াল রাখতে হবে। যেমন বাচ্চা একদম শীতের শেষে জন্ম নিলে শীতের কাপড় কম আর শীতের শুরুতে জন্ম নিলে শীতের কাপড় বেশি- এভাবে কিনতে হবে।

২। খুব জমকালো কারুকার্য করা জিনিস না কিনে আরামদায়ক কাপড় কিনতে হবে।

৩। সোশ্যাল মিডিয়া বা দোকানদারের কথায় হুট করে কিছু না কিনে নিজে যাচাই করে নেয়া ভালো।

৪। নিজের সামর্থ্য বিবেচনায় রাখা উচিত। অযৌক্তিক শখ করে বা লোক দেখানোর জন্য কেনা উচিত নয়।

৫। ব্র্যান্ড না দেখে মান দেখা উচিত কারণ ব্র্যান্ড মানেই সবসময় সেরাটা নয়।

৬। বাচ্চার অভিভাবকরা অল্প পোশাক, খেলনা ও প্রসাধনী কিনবেন কারণ বাচ্চারা এমনিতেই অনেক উপহার পায়।

৭। প্রয়োজন ও অপব্যায়ের ভারসাম্য থাকা উচিত।

৮। কেনাকাটার পর অতিরিক্ত হয়ে গেলে বা উপহার বেশি হয়ে গেলে, দরকারি জিনিসগুলো রেখে বাকি সব গুছিয়ে রেখে দেয়া যায়, যা পরে কাউকে গিফট করা যায় বা নিজের অন্য বাচ্চার জন্য কাজে লাগানো যায়।

শিশুর জন্য নানান অনুষঙ্গ

এবারে জেনে নেয়া যাক একজন নবজাতকের জন্য কী কী কেনাকাটা করা উচিত।

পোশাক

একজন মানবশিশুর জন্মের পরেই প্রয়োজন হয় পোশাকের। গ্রীষ্মে জন্মানো শিশুর জন্য পাতলা নিমা ও নরম কাঁথা, ডায়পার বা ন্যাপি দরকার হয়।

আর শীতের শিশুর জন্য এগুলোর পাশাপাশি দরকার হয় শীত পোশাকের।

*পোশাকের ক্ষেত্রে প্রথমেই ২০-৩০ পিস নিমা/ ফ্রক দরকার নেই, কারণ সব পরতে পরতে বাচ্চার সাইজ বদলে যাবে, আবার বেশ কিছু জামা উপহার হিসেবেও পাওয়া হবে।

তাই প্রাথমিকভাবে ৫-১০ পিস নিমা, ২৫-৩০ পিস ছোট নরম কাঁথা, ডায়পার, ওয়েট টিস্যু/ ছোট কাপড়ের টুকরা হলেই যথেষ্ট।

*কাঁথার বদলে পাতলা শাড়ি, উরনা , নরম বিছানার চাদর ভাঁজ করে কেটে নেয়া যায়, যেন কাঁথার সমান পুরু হয়, এতেও কাঁথার কাজ চলে যাবে।

*কেউ চাইলে বাচ্চাকে ফুল টাইম ডায়পারিং করতে পারেন, সেক্ষেত্রে কাঁথা ৪-৫ টা হলেও চলে, অথবা না হলেও চলে।

কেউ যদি চান ডায়পার দেবেন না একদমই তবে কাঁথা লাগবে বেশি।

*বাচ্চার পি-পটির হাত থেকে নিজে পবিত্র থাকতে ও বিছানা পরিচ্ছন্ন রাখতে ব্যাবহার করুন ইউরিন ম্যাট/ রেক্সিন/ ওয়েল ক্লথ।

বাচ্চা যতদিন শুয়ে থাকবে, মানে প্রায় ৩ মাস পর্যন্ত, ততদিন ইউরিন ম্যাট এর উপর একটি কাঁথা দিয়ে বাচ্চাকে কোলে নিলে পি-পটি ছড়িয়ে পড়বে না।

*যাদের সামর্থ্য আছে তারা ডায়পার ইউজ করতে পারেন।

*বাচ্চার পি-পটি সামলাতে একটি দরকারি জিনিস হচ্ছে ওয়াশেবল ডায়পার। দারুণ এই পণ্য নিয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ে ফেলুন এই লিখাটি-

*অনেকেই বাচ্চার মুখ, শরীর মুছার জন্য ওয়েট টিস্যু, টয়লেট/ ন্যাপকিন টিস্যু ব্যাবহার করে। এটা একদম অপ্রয়োজনীয় । বাচ্চার পটি এরিয়া ওয়েট টিস্যু দিয়ে ক্লিন করা যায় কিন্তু মুখ বা শরীর মুছতে নরম সুতি কাপড় সবচে ভালো।

এবার নিজেদের প্রয়োজনমত এগুলো সংগ্রহ করে রাখুন।  

প্রসাধনী

মেডিক্যাল সায়েন্স কী বলে সেটা না দেখেই বিজ্ঞাপনের মোহে পরে নবজাতকের জন্য বাহারি প্রসাধনী যেমন সাবান, বডি ওয়াশ, শ্যাম্পু, লোশন, বেবি ওয়েল, পাউডার সহ নানান জিনিস কিনে ব্যাবহার শুরু করে দেই আমরা।

অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে নবজাতকের শরীরে কিছু উপকারী প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া থাকে, প্রসাধনী ব্যবহারে যেগুলোর ক্ষতি হয়।

তাই বলা হয়, শিশু জন্মের পর অন্তত ৩০-৪৫ দিন কোন প্রসাধনী ব্যাবহার না করতে। এরপর ব্যাবহার করলেও খুব হালকা কিছু অল্প পরিমাণে ব্যবহার করা উচিত।

তবে সুগন্ধমুক্ত অলিভ ওয়েল লাগানো যায়। এছাড়াও হাসপাতালের ডাক্তার আপনার জন্য বিশেষ কিছু সাজেস্ট করতে পারেন।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে অল্প প্রসাধনী ব্যাবহার করা যায়।

শিশুর জন্য প্রসাধনী কেনা ও ব্যাবহারের বিস্তারিত জানতে এই লিখাটি পড়ুন, এখানে কী কিনবেন এবং কিভাবে ও কখন ব্যাবহার করবেন সে বিষয়ে বিস্তারিত দেয়া আছে।

খাবারের অনুষঙ্গ

শিশুর জন্মের আগেই অনেকে ফর্মুলা দুধ, ফিডার ইত্যাদি কিনে রাখেন।

কেউ আবার ব্রেস্ট পাম্প, মিল্ক কালেক্টর, নিপল শিল্ড, ব্রেস্ট প্যাড ইত্যাদি কিনে রাখেন।

এগুলো সন্তান জন্মের আগে কেনার জিনিস না। বরং শিশু জন্মের পর প্রথমে শাল দুধ খাবে যা এক দুই ফোঁটা, বা বিন্দু বিন্দু আকারে আসে, সেটা খেয়ে খেয়েই শিশু বুকের দুধ টানতে শেখে এবং শিশু যত টানে মায়ের বুকে ততো দুধ আসে। তাই ফিডারের কোন দরকারই নেই। যদি ডাক্তার পরামর্শ দেন তবেই কেবল ফর্মুলা দুধ দেয়া যেতে পারে।

মায়ের বুকে নিয়মিত দুধ আসলে ব্রেস্ট পাম্প করার দরকার হয় না, মা যদি বাচ্চাকে দুধ দিতে উপস্থিত থাকে তবে মিল্ক কালেক্টর দরকার হয়না। অবশ্য মা যদি অসুস্থতা বা চাকরির জন্য সরাসরি দুধ খাওয়াতে না পারেন তবে মিল্ক কালেক্টর দরকার হতে পারে।

মায়ের নিপল স্বাভাবিক থাকলে নিপল শিল্ড লাগে না, যদি নিপল ক্র্যাক হয়ে যায় তবে নিপল শিল্ড লাগবে।

ব্রেস্ট প্যাড লাগবে কিনা সেটা আগে বোঝা যাবে না, যদি মায়ের বুকের দুধ উপচে পড়ে তবে ব্রেস্ট প্যাড লাগতে পারে, তবে এক্ষেত্রে উরনা বুকে চেপে রেখেও কাজ হয়।

শিশুর ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয়

নবজাতকের জন্য অনেকেই সরিষা বালিশ, পাশ বালিশ, কাপড়ের গোল বালিশ/ বিড়া , বেবি নেস্ট বা সেট করা বিছানা বালিশ ইত্যাদি কিনে রাখেন।

তবে চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে ছোট্ট শিশুর বালিশের কোন প্রয়োজন-ই নেই, বরং সমতল বিছানায় শোয়ানো বড়- ছোট সবার জন্য ভালো।

সরিষা বালিশ দিয়ে মাথা গোল করার একটা হিড়িক পড়েছে ইদানীং- সেটাও অপ্রয়োজনীয়। বাচ্চাদের মাথা বড় হতে হতে কিছুটা গোল হয় আর না হলেও অসুবিধা নেই, এটা স্বাস্থের জন্য হুমকি নয়, চুলের নিচেই ঢাকা পরে যাবে। সরিষা বালিশে বরং গরম বেশি লাগে।

পাশ বালিশ কিছুটা কাজে লাগে।

বেবি নেস্ট নামে কিছু সেট পাওয়া যায়, সেগুলো আসলে খুব দরকারই কিছু নয়।

“বাচ্চার ঘুমের জন্য একটা মশারি, আরামদায়ক কাঁথা/কাপড়/ডায়পার, ভরা পেট আর মায়ের উম-ই যথেষ্ট”।

তাছাড়া বাচ্চার বিছানায় বেশি বালিশ কাঁথা রাখাও উচিত নয়, অনেক সময় বাচ্চার নাকের উপর এগুলো চাপ লেগে যেতে পারে এতে শ্বাস বন্ধ হয়ে শিশুমৃত্যু ঘটে।

দোলনা ব্যাবহার করা যেতে পারে।

কেউ চাইলে বেবি কট ব্যাবহার করতে পারেন তবে আমাদের দেশে এই পদ্ধতি তেমন প্রচলিত নয়। তাই কেনার আগে এতে অভ্যস্ত হবার ব্যাপারে একটু শিখে নিতে হবে।

খেলনা ও মেধা বিকাশের অনুষঙ্গ

শিশুর জন্য খুব বেশি আওয়াজের ঝুনঝুনি ঠিক নয়।

খেলনা হিসেবে সফট টয় দেয়া যায়, বাবুর বিছানার উপরে কালারফুল কিছু ঝুলানো যায়, আর বই দেয়া যায়। তবে এসব কিছুই বাচ্চার ৩-৪ মাস পর থেকে লাগতে পারে।

শিশুর জন্য আসবাব

বাচ্চার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখার জন্য কাপড় রাখার ছোট ঝুড়ি, ময়লা কাপড়/ কাঁথা রাখার জন্য ঢাকনা দেয়া বিন, কাপড় শুকানোর হ্যাঙ্গার, ক্লিপ, গোসলের জন্য গামলা , বিছানায় বাচ্চার ছোট কিছু জিনিস রাখার ছোট বাস্কেট ইত্যাদিও লাগবে।

সন্তানের কেনাকাটা সংক্রান্ত ধর্মীয় বিধি

*“বাচ্চা জন্মের আগে কেনাকাটা করা ঠিক নয়, জন্মের পরে করা উচিত”-অনেক মুরুব্বি এটা বলেন।

তবে, ধর্মীয়ভাবে এতে কোন বাঁধা নেই। আল্লাহর উপর ভরসা করে সন্তানের সুস্থতার জন্য দুয়া করতে হবে ও স্বাভাবিক কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে।

*ইসলাম অনুসারে, বাচ্চা ও বড়দের কোন কিছুতেই প্রাণীর ছবি থাকা উচিত নয়, আমাদের ঘরেও প্রাণীর ছবি বা প্রাণীর চেহারাসহ খেলনা থাকা উচিত নয়। তাই কেনাকাটায় এই ব্যাপারটি খেয়াল রাখতে হবে।

*প্রয়োজন ও অপচয়ের পার্থক্য বুঝে কেনাকাটা করতে হবে।

সন্তানের কেনাকাটায় একটু আহ্লাদ দোষের কিছু নয়, বরং এটি মায়ের মাতৃত্ব অনুভুতিকে শানিয়ে তোলে, আর স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে কেনাকাটায় দাম্পত্যেও নতুন স্বাদ আসে। তবে খেয়াল রাখতে হবে আহ্লাদে যেন অপচয় না হয়, আর বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর কিছু না কেনা হয়।

সন্তানের জন্য খরচের আগে নিজের জন্য বিনিয়োগ করুন। প্রিনাটাল কোর্স করুন। আপনার সাধ্যমতন কেনাকাটা করুন সন্তানের জন্য আর নজর রাখুন নিজেদের সুস্থতার দিকে।

তথ্যসূত্র