জন্মের পরে নতুন শিশুর শরীরবৃত্তীয় বিভিন্ন বিষয় যেমন সে ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা, বারবার প্রস্রাব পায়খানা করছে কিনা এসব বিষয় নিয়ে বাবা মায়েরা সজাগ দৃষ্টি রাখেন। বলার অপেক্ষায় রাখে না, একটা শিশুর সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। একটা সময় পর্যন্ত আমাদের সমাজে শিশুর মনস্তাত্ত্বিক উন্নতির বিষয়টি অ-গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়েছিল। সময় পাল্টেছে। বাবা-মায়েরা আগের যেকোনো সময় চেয়ে শিশুর মনোজাগতিক বিকাশের ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন। শূন্য থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময়কে ইংরেজিতে বলে ডেভেলপমেন্ট উইন্ডো, যে সময় একটা শিশুর মস্তিষ্ক সুগঠিত হয় এবং তা সারা জীবনের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়ে যায়।
এসময় বাচ্চার সাথে যতো বেশি interaction করা হবে সেটি বাচ্চার মানসিক উন্নতিতে ততো বেশি সহায়ক হবে। বাচ্চাকে আদর করা, কথা বলা, সময় ও সঙ্গ দেয়া, বয়স উপযোগী খেলনা দেয়া- এসব কিছুই বাচ্চার মেধার বিকাশে সহায়ক।
শিশুর বিকাশ বিষয়ক অসংখ্য গবেষণা আমাদের জানাচ্ছে, বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য “বই” খুবই উপকারী। সাধারণত আমরা বই পড়া ব্যাপারটির সাথে স্কুলে যাওয়াকে অবধারিত ভেবে নিয়েছি। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরুর আগে শিশুতোষ বই বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
শিশুদেরকে বই দেয়ার উপকারিতা
আপনার সন্তানকে খুব অল্প বয়স থেকেই যদি বই পড়ায় অভ্যস্ত করতে পারেন, তাহলে আপনার আকাঙ্ক্ষিত অনেক উপকারই পেয়ে যাবেন। যেমন-
১। যেসব বাচ্চারা খুব ছোট বয়েস থেকে বই পড়ে, তাদের যোগাযোগ দক্ষতা ভালো হয়।
২। বাচ্চাদের শব্দ ভাণ্ডার বাড়ে।
৩। মনোযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
৪। ছোট বাচ্চাদের ব্রেন গঠিত হবার সময় বই পড়ে শোনালে তাদের ব্রেনে সিমুলেশন ঘটে, যা তাদের মেধা শক্তিকে বিকশিত করে।
৫। বাচ্চারা বই ধরে, বইয়ের ছবি দেখে, রঙ দেখে, ছবি বুঝতে চায়- এগুলো সম্মিলিতভাবে বাচ্চার সেন্সরি ও মোটর স্কিল উন্নত করতে সাহায্য করে।
শিশুর হাতে কখন বই দেবো?
“বাচ্চা বই পড়বে স্কুলে যাওয়া শুরু করলে” – এমনটা দেখে আমরা অভ্যস্থ। ধরেই নেই যে, এর আগে বাচ্চাদেরকে বই দেবার কোন দরকার নেই। কিন্তু শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাচ্চার বয়স ৩-৬ মাস হলেই তাকে বইয়ের সাথে পরিচয় করানো উচিত। এসময় বাচ্চার দৃষ্টিশক্তি পরিষ্কার হয়, তাদের সামনে বই দিলে চোখ দিয়ে অনুসরণ করতে পারে এবং হাত দিয়ে বই ধরতে পারে।
আপনি যদি আপনার বাচ্চাকে বইয়ের আনন্দময় ভুবনের সাথে পরিচয় করাতে চান, তবে বাচ্চার ৩-৬ মাস বয়স থেকেই তাকে বই দিন। এমনকি আপনি চাইলে বাচ্চা জন্মের প্রথম সপ্তাহেও বই দিতে পারেন। এতে লাভ ছাড়া ক্ষতির কিছুই নেই।
কেমন ধরনের বই দেবো
অনেক অভিভাবক দ্বিধায় থাকেন ছোট বাচ্চাকে কেমন বই দিয়ে শুরু করবেন। ছোট বাচ্চাদের বই দিতে চাইলে তাদের বয়স অনুযায়ী বই নির্ধারণ করতে হবে। এখানে সংক্ষেপে একটি ধারণা দিয়ে দিচ্ছি-
১। (০- ৬) মাস বয়স- রঙ্গিন ও বড় ছবিযুক্ত বই, একটু মোটা কাগজের বই, ক্লথ বুক, আওয়াজ করে এমন বই। এখানে ছবির প্রাধান্য থাকবে।
২। (৭-১২) মাস- ছোট্ট ও সহজ গল্প ও ছড়া, রঙিন ছবির বই দেয়া যেতে পারে।
৩। (১৩- ২৪) মাস- ফুল, ফল, প্রাণী, যানবাহন ইত্যাদির পরিচিতি বই, সহজ ধর্মীয় গল্প ও ছড়ার বই এ বয়সে দেয়া যায়।
৪। (২৫-৩৬) মাস- বোর্ড বুক এর পাশাপাশি রেগুলার পেজের বই দেয়া যায় , মজার ও শিক্ষণীয় গল্প ও ছড়ার বই দেয়া যায়।
মোট কথা হচ্ছে, বাচ্চার বয়স ও আগ্রহ বুঝে আনন্দের সাথে বই পড়তে ও বই নিয়ে খেলতে দিতে হবে। বয়সের সাথে সাথে বাচ্চার নিজের পছন্দ তৈরি হবে, তখন তাকে সেরকম বই দিতে হবে। দরকারমতো তার পছন্দকে গাইড করতে হবে।
বাচ্চাদেরকে বইয়ের সাথে অভ্যস্ত করাবো কিভাবে
বাচ্চাকে বই দিলেই সে আনন্দ নিয়ে বই পড়বে বা পছন্দ করবে, এমনটা নাও হতে পারে। প্রতিটি শিশুই তার নিজের মতন করে আলাদা। তবে এখানে কিছু পরামর্শ উল্লেখ করছি, যেগুলো আপনার সন্তানকে বইয়ের সাথে অভ্যস্ত করতে সাহায্য করবে-
১। ছোট বাচ্চারা বড়দের দেখেই শেখে। আপনার বাচ্চা যতো ছোটই হোক না কেন, সে তার আশেপাশের মানুষ/ বস্তু খেয়াল করে। বয়সের সাথে সাথে এটা আরও বাড়ে। তাই বাচ্চাকে বইয়ের সাথে অভ্যস্ত করানোর পূর্বশর্ত হচ্ছে, আপনি নিজে বই পড়ুন। এতে বাচ্চাও বইয়ের প্রতি আগ্রহী হবে।
২। বইকে একটা আনন্দের খেলা হিসেবে উপস্থাপন করুন। বাচ্চাকে প্রথম বই দেবার সময় খুব হাসিখুশি স্বরে কথা বলুন। এতে বাচ্চা মেসেজ পাবে যে বই একটি আনন্দের বস্তু।
৩। যেহেতু ৩-৬ মাস বয়স থেকে বাচ্চাকে বই দেয়া যায়, তাই এসময় বাচ্চাকে অল্প সময়ের জন্য বই দেবেন। আস্তে আস্তে বাচ্চার বয়স ও আগ্রহ বুঝে সময় বাড়াবেন।
৪। বাচ্চার খেলনা রাখার জায়গায় বই রাখুন, এতে বাচ্চারা খেলার সময়ও বই কাছে পাবে।
৫। বাচ্চার বই টেবিলে সামলে না রেখে বাচ্চার নাগালে রাখুন, যেনো সে তার ইচ্ছেমতন সময়ে বই নিতে পারে।
৬। বাচ্চাকে সাথে নিয়ে বই কিনুন। বাচ্চার পছন্দ অনুযায়ী বই কিনে তাকে পড়তে উৎসাহ দিন।
৭। সুযোগ থাকলে বাসায় বাচ্চার জন্য আলাদা একটি কর্নার রাখতে পারেন, যেখানে ছোট্ট চেয়ার টেবিল রাখা যায়, এতে বাচ্চার “নিজের জিনিশ” (ownership feelings) এধরনের অনুভুতি তৈরি হবে এবং বই পড়ায় মনোযোগী হবে।
৮। বইকে বাচ্চার দিনযাপনের একটি অংশ বানিয়ে ফেলুন। যেমন, বাচ্চাকে খাওয়ানোর সময় বই থেকে ছড়া শোনানো, ঘুমানোর আগে দুয়া পড়ার পাশাপাশি ধর্মীয় গল্প শোনানো ইত্যাদি।
৯। বাচ্চার হাতে বই দিয়ে পড়তে বলবেন না বরং আপনি নিজে পড়ে শোনান। বাচ্চা আগ্রহ না দেখালে আপনি একা একাই পড়ুন, মিটিমিটি হাসুন। দেখবেন একটু পর সে নিজেই আগ্রহ প্রকাশ করবে।
১০। যেটা সবচে গুরুত্বপূর্ণ, বইটিকে বাচ্চার সামনে জীবন্ত করে তুলুন, বইয়ের গল্পকে বাচ্চার পরিচিত জগতের সাথে মিলিয়ে পড়ে শোনান এবং বাচ্চাকেও প্রশ্ন করুন বইয়ের গল্প সম্পর্কে। গান, অভিনয় ও ছন্দ মিলিয়ে বই পড়ুন, আপনার সন্তান নিজের কল্পনাশক্তির চর্চা করতে শিখবে।
অভিভাবকের করণীয়
আপনার বাচ্চাকে বই দেবার সময় কিছু ব্যাপার খেয়াল রাখবেন-
১। বই পড়ার জন্য চাপ দেয়া যাবেনা। বাচ্চার কাছে বই মানে একটা খেলনা, আপনিও বইকে খেলনা হিসেবেই দেখুন।
২। ছোট বাচ্চারা বই পড়া কী জিনিস সেটা বোঝে না। তারা বইয়ের পাতা ছিঁড়বে, খেয়ে ফেলবে- ছোট বাচ্চাদের অভ্যাসই এমন। তাই, বই নষ্ট করলে সন্তানকে বকাঝকা করবেন না। বই ছিঁড়তে ছিঁড়তেই পড়তে শিখবে।
৩। ছোটবেলায় বই দিলেই বাচ্চা বড় হয়ে খুব মেধাবী বা পড়ুয়া হবে, এরকম আশা করবেন না বা বাচ্চাকে সেই লক্ষ্যে বই দেবেন না। বই আপনার বাচ্চাকে নানান ভাবে সাহায্য করবে, কিন্তু সরাসরি মেধাবী বানিয়ে দিবেনা। বইকে বাচ্চার জন্য একটি আনন্দের মাধ্যম হিসেবেই রাখুন।
অভিভাবকের অভিজ্ঞতা
শিশুর হাতে বই দেয়া প্রসঙ্গে মাতৃত্ব কো-ফাউন্ডার আফিফা রায়হানা বলেন “ আমি আমার বাচ্চার জন্য বই কিনেছি হসপিটাল ব্যাগ রেডি করার সময়। বাচ্চার জন্মের প্রথম সপ্তাহেই বই দিয়েছি। দুই বছর বয়স পর্যন্ত বোর্ড বুক দিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ্ মেয়ে এখন বইপোকা!”
আরেকজন অভিভাবক সানিয়া তাসনিম বলেন, “ আমার মেয়ের ৬ মাস বয়স থেকে রঙিন বই দিয়েছি। আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি, আমি যখন পড়ি সেও তখন বই খুলতে চায়। বাচ্চাকে বই পড়ায় আগ্রহী করে তুলতে চাইলে আগে নিজেদের পড়ার রুটিন ঠিক করতে হবে।“
তিন সন্তানের মা ও লেখিকা নাবিলা নোশিন সেঁজুতি বলেন, “ বাচ্চাদেরকে বই পড়ায় আগ্রহী করে তুলতে চাইলে নিজেদের পড়ার অভ্যাস করতে হবে, বাচ্চাকে ছোট বয়স থেকে বই দিতে হবে এবং অভিনয়ের মাধ্যমে বইকে সন্তানের সামনে জীবন্ত করে তুলতে হবে।“
মুসলিমদের ধর্মীয় গ্রন্থ ও জীবন বিধান আল-কোরআনের প্রথম বাণী-ই হলো “ইকরা”- অর্থাৎ “পড়ো”। আপনার সন্তানকেও “ইকরা”র মাধুর্য চিনিয়ে দিন ছোট বয়স থেকেই। বয়সের সাথে সাথে যেন তারা পড়াশোনার গুরুত্ব ও আনন্দ পুরোপুরি আস্বাদন করতে পারে, তার বীজ বুনে দিতে হবে যতো দ্রুত সম্ভব।
তথ্যসুত্র
মাতৃত্ব ওয়েবসাইট
How to Introduce Books to Your Baby and Young Child
Read Early and Often