গর্ভবতী হবার পর মায়েরা খুব উত্তেজিত থাকেন,  কখন পেটের ভেতর বাবুটি নড়ে উঠবে, কখন সেটা বুঝতে পারা যাবে। সাধারণত বাবুটি  ৭ থেকে ১০ সপ্তাহ বয়স থেকেই নড়াচড়া শুরু করে, কিন্তু সেটা বুঝতে বুঝতে মায়েদের ১৬ থেকে ২০ সপ্তাহ লাগে। তাই প্রথমবার বাবুর নড়ে ওঠা মা-বাবার জন্য খুব আনন্দময় একটি অনুভূতি। হবু মা খুব আগ্রহ ও আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করে কখন প্রথমবারের মতো বাবুর নড়াচড়া অনুভব করা যাবে।

বাচ্চা কেন লাথি মারে?

জায়গা হিসেবে জরায়ু খুব ছোট একটি বসবাসের স্থান । তাই বাচ্চা নড়াচড়া করার সময় পেটের বাইরে থেকে সেটা বুঝা যায় । বাচ্চার স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধি, শক্তিশালী হাড় গঠন ও হাড় সন্ধিস্থল গুলোর জন্য এই নড়াচড়া বা লাথি মারা খুব উপকারী। বলতে গেলে এই লাথি মারার মাধ্যমে বোঝা যায় বাচ্চা তার মায়ের পেটে সুস্থভাবে বেড়ে উঠছে।

৭ সপ্তাহ পর থেকে বাচ্চা পেটের ভেতর আঙুল চুষে , হাত-পা নাড়ায়, হেঁচকি তোলে, হাই তোলে। সময়ের সাথে সাথে বাচ্চার ওজন বৃদ্ধি পায় সাথে সাথে তাদের এই নড়াচড়াও ভালোভাবে বেড়ে যায় । তাই সেটা বাইরে থেকেও অনুভব করা যায়। যদিও ২০  সপ্তাহ পর্যন্ত সাধারণত এই নড়াচড়া খুব বেশি একটা বোঝা যায় না। শুরুর দিকে (১৮-২০ সপ্তাহের ভিতরে) এই বাবুদের নড়ে উঠার অনুভূতিটি যেন পেটের ভিতর একটি প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে অথবা কিছু একটা ভেসে চলেছে। হবু মা বাবাদের জন্য এটি খুবই সুখকর একটি মুহূর্ত।

বাচ্চাদের জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক অনুশীলন

বাচ্চার নড়াচড়ার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় তার মস্তিষ্ক কতখানি কার্যকরভাবে তৈরি হচ্ছে। বাচ্চারা তাদের মস্তিষ্কে ব্যবহারের মাধ্যমে শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে আর যদি এই নড়াচড়া টা মস্তিষ্কের মাধ্যমে না হয় তবে হয়তো সেটা খুব সাধারন রিফ্লেক্স যেটা মেরুদন্ড (স্পাইনাল কর্ড) থেকে আসে।

বিশেষজ্ঞরা এখনো জানেনা যে বাচ্চার নড়াচড়া ঐচ্ছিক না অনৈচ্ছিক । কিন্তু তারা খুব ভালো ভাবে নিশ্চিত হয়েছেন যে এই নড়াচড়া বাচ্চার সুস্থতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর উপর ভিত্তি করে বাচ্চার হাড় গঠিত হয়, মজবুত হয় তার মাংসপেশি এবং হাড় সন্ধিস্থল সবল ভাবে তৈরি হয়।

পেটের ভেতর বাচ্চার নড়াচড়া স্বল্পতা একটি বাচ্চার বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিকতা নির্দেশ করে। যেমন: পাতলা হাড় , দুর্বল হাড় সন্ধিস্থল ইত্যাদি । এসব কারণে খুব সহজে বাচ্চার শরীরে হাড় ভেঙে (ফ্র্যাকচার) হতে পারে।

গর্ভবতী মায়েরা একটা বিষয় নিয়ে বেশ চিন্তিত থাকে যে , বাচ্চা কি খুব বেশি নড়ছে বা লাথি দিচ্ছে অথবা খুব কম নড়ছে। অথচ বাচ্চা কতবার নড়লে সেটা সুস্থতার লক্ষণ হিসেবে ধরে নেওয়া যাবে, সেটা নিয়ে এখনো কোনো ঐক্যমত নেই। তাই গর্ভবতী মাকে বাচ্চা ঘন্টায় বা সারাদিনে কতবার নড়াচড়া করে তা খেয়াল রাখতে বলা হয়। 

বাচ্চা কতবার কোন ধরনের মুহূর্তে বেশি নড়বে সেটা জানা গবেষকদের জন্য বেশ কঠিন। কেননা গর্ভবতী মহিলারা খুব কম সময়ের জন্য হাসপাতালে এসে পরীক্ষা করে থাকে। টানা অনেক সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করতে না পারলে গবেষকদের জন্য কোন উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন। তাই গবেষকরা পরীক্ষামূলক একটি ডিভাইসের সাহায্যে ২৪ থেকে ৩৪ সপ্তাহের গর্ভবতী ৪৪ জন নারীদের শরীরের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেন।

২০০১ এ প্রকাশিত একটি জার্নালে বলা হয় ছেলে বাচ্চা মেয়ে বাচ্চার চাইতে বেশি নড়াচড়া করে দেখা গেছে ২০, ৩৪ ও ৩৭ সপ্তাহে ছেলে বাচ্চার পায়ের নড়াচড়া মেয়ে বাচ্চার চাইতে বেশি হয়। মাত্র ৩৭ টা বাচ্চার ওপর গবেষণাটি হয়েছিল। যেহেতু এই গবেষনার নমুনার আকার (স্যাম্পল সাইজ) ছোট, তাই গবেষকরা লিঙ্গ অনুযায়ী বাচ্চার নড়াচড়ার ব্যাপারটি নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলেননি।

বাচ্চা ঘুষি ও মারতে পারে

সাধারণত বাচ্চার নড়াচড়া নিয়ে সব মায়েদের একই রকম অনুভূতি হয় না। গর্ভবতী ভেদে অনুভূতির ধরণ, তীব্রতায় তারতম্য ঘটে। যেমন প্রথম গর্ভকালীন সময়ে যেরূপ অনুভূতি হয় বা অসুস্থতা বোধ হয়, দ্বিতীয় গর্ভকালীন সময়ে একই মায়ের সেই ধরনের অনুভূতি নাও হতে পারে। গর্ভকালীন যাত্রাটি সবার ক্ষেত্রে কখনোই একরকম হবে না অথবা একই রকম উপসর্গ সবার ক্ষেত্রে দেখা যাবে না । অনেক মায়েদের বেলায় দেখা যায় দ্বিতীয় বা তৃতীয় গর্ভের সময় বাচ্চার মাথা, পা কোথায় অবস্থান করছে তা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন, যেটা প্রথম বাচ্চার সময় বোঝা যায়নি । বিশেষজ্ঞরা মনে করেন পরের গর্ভকালীন সময়ে চামড়া কিছুটা পাতলা হয়ে যায় তাই এমন ভাবে বোঝা যায় ।

বাচ্চার ওজন যখন ২ কিলোগ্রাম থাকে তখন থেকে হালকা ভাবে তার লাথি টের পাওয়া যায়। পা’র পাশাপাশি বাচ্চারা হাতও নাড়াতে পারে, বাইরে থেকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে বাচ্চা ঘুষি মারছে! আস্তে আস্তে তার ওজন বৃদ্ধির সাথে সাথে লাথি দেওয়ার মাত্রা বৃদ্ধি পায়। যখন বাচ্চার ওজন বৃদ্ধি পায় (দুই কেজি+),  তখন থেকে তার নড়াচড়া কমে যায় । এসময় সে বড় হচ্ছে আর তার থাকার জায়গাটি ছোট হয়ে আসছে।

বাচ্চা পেটের মধ্যে কি কি করে 

বাচ্চারা পেটের শুধু লাথি মারে না বরং আরো বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড করে। ১৫ সপ্তাহ বয়স থেকেই তারা ঘুষি মারা শুরু করে, মুখ খোলে এবং বন্ধ করে, মাথা নাড়ায়, বৃদ্ধাঙ্গুল চোষে, হেঁচকি তোলে। আরো কয়েক সপ্তাহ পরে তারা চোখ খোলা এবং বন্ধ করা শুরু করে। তবে মা শুধুমাত্র বড় ধরনের নড়াচড়া গুলা টের পান, যেমন লাথি মারা ঘুষি মারা বা বড় হেঁচকি।

বাচ্চারা “শ্বাস নেওয়ার” জন্যও নাড়াচাড়া করে। তবে যেহেতু গর্ভের ভেতর সত্যিকারের শ্বাস নেয়ার মতো বাতাস নেই, বাচ্চা গর্ভস্থ তরল (অ্যামনিওটিক ফ্লুইড) দিয়ে শ্বাস নেয়ার ব্যায়াম করে। যেসব বাচ্চা এই প্রক্রিয়ায় যায় না, তারা জন্মানোর পর তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যায় ভোগে, কারণ তাদের বুকের পেশিগুলো প্রস্তুত হয়নি।

কিভাবে বাচ্চার নড়াচড়া বাড়ানো যায়

বাচ্চা যাতে স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করে সেজন্য বয়স্ক মা, খালা, বোন অথবা বিশেষজ্ঞগণ বেশ কিছু পরামর্শ দেন। দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলো কাজ করে। যেমন : জুস বা শরবত খাওয়া, ভয়ের কোন ঘটনা বা মুভি দেখা। এতে শরীরে অ্যাড্রেনালিন হরমোন বেড়ে যায় এবং বাচ্চার নড়াচড়া বেড়ে যায়।

তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে যখন বাচ্চার চোখ এবং কান মোটামুটি গঠন হয়ে যায় তখন মায়ের পেটে যদি আলো ফেলা হয় অথবা গান শোনা হয় তখন সেটা বাচ্চাকে নড়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করে।

অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মায়েরা যখন এক কাত হয়ে শুয়ে থাকে তখন বাচ্চারা নড়ে ওঠে । কিন্তু চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে বাচ্চা নাড়াচাড়া করতে পারে না। কেননা এতে অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয় এবং বাচ্চা তখন নড়তে পারে না। সাধারণত শেষ ট্রাইমেস্টারে এটা ঘটে থাকে । কেননা এই সময়ে বাচ্চা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে । তাই গর্ভবতী মায়েদের জন্য ডান বা বাম কাত হয়ে শোয়া’ই উত্তম।

বাচ্চার নড়াচড়া এবং লাথি মারা একটি অদ্ভুত সুখকর অনুভুতি। কিন্তু এটি আসলে সুস্থভাবে বাবুটা বেড়ে ওঠার চিহ্ন।

তথ্যসূত্র

১। ফাদারলী
২। লাইভ সায়েন্স

লেখাটি রিভিউ করেছেন –

ডাঃ সারওয়াত জাবীন আনিকা
এমবিবিএস
KMC (IMCS) – এ বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা