বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে একুশ শতকের একটি মহামারীর নাম স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা। শারীরিক বা আবেগিক চাপের যে অনুভুতি, এর অপর নাম হল স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা। যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জিং অবস্থার প্রতি শরীরের প্রতিক্রিয়াকেও স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা বলে আখ্যায়িত করা যায়

অতিরিক্ত চিন্তা যখন “দুশ্চিন্তা”য় রুপ নেয়, তখন এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আমাদের শরীর ও মনে। এমনকি, গর্ভধারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও এর প্রভাবের বাইরে নয়। 

দুশ্চিন্তা কী?

সংক্ষেপে বলা যায়, কোন বিশেষ অবস্থা বা ঘটনার প্রেক্ষিতে চিন্তা যখন নেতিবাচকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং মনকে কষ্টের অনুভূতি দেয়, মনকে অস্থির ও ভীত করে তোলে, তখন তাকে দুশ্চিন্তা বলা যায়। সাধারনত আমরা সবাই জীবনে দুশ্চিন্তার মুখোমুখি হই। দুশ্চিন্তা আমাদের কঠিন অবস্থা মোকাবেলায় সাহায্য করে। তবে, এটি বেড়ে গেলে এর ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বাধাগ্রস্থ করে।

গর্ভধারণে দুশ্চিন্তার প্রভাব

বেশ অনেক বছর ধরে নানান রকম গবেষণায় দেখা গেছে, স্ট্রেস/ দুশ্চিন্তার সাথে গর্ভধারণের সম্পর্ক রয়েছে এবং এই সম্পর্কটি নেতিবাচক। অর্থাৎ, দুশ্চিন্তা গর্ভধারণকে বাঁধা দেয়/ বিলম্বিত করে। আপনি যদি নিয়মিত দুশ্চিন্তায় ভুগেন, তাহলে এটি আপনার যৌন স্বাস্থ্য ও সন্তান ধারণক্ষমতায় (Fertility) প্রভাব ফেলবে। নারী ও পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্টের ভিত্তিতে গর্ভধারণের ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তার প্রভাব কিছুটা আলাদা হয়। 

নারীর উপর দুশ্চিন্তার প্রভাব

বন্ধাত্য চিকিৎসা বিষয়ে হওয়া বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত দুশ্চিন্তায় ভুগেন যেসব নারী, তাদের তুলনায় মানসিকভাবে প্রফুল্ল নারীদের গর্ভধারণের হার বেশি। বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় যেসকল নারী শুধু শারীরিক বিষয়ে জোর দিয়েছেন , তাদের তুলনায় যারা শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসায় জোর দিয়েছেন, তাদের সাফল্যের হারও বেশি।

নারীর ঋতুস্রাব, ঘুম, পুষ্টি, যৌন স্বাস্থ্য, হরমোন ও গর্ভধারণজনিত সামগ্রিক অবস্থার সাথে দুশ্চিন্তার সম্পর্ক এখন প্রমাণিত।

পুরুষের উপর দুশ্চিন্তার প্রভাব

নারীর গর্ভধারণের অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে পুরুষের শুক্রানু, যেটি সঠিকভাবে নারীর ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করলে একটি সফল গর্ভধারণ সম্পন্ন হয়। কিন্তু, দুশ্চিন্তা পুরুষের শুক্রানুর উপরেও প্রভাব ফেলে যে কারণে গর্ভধারণ বাধাগ্রস্থ হয়।

স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা যেভাবে পুরুষের উর্বরতায় প্রভাব ফেলে তা হচ্ছে-

  • ক্রনিক স্ট্রেস ঘুম কমিয়ে দেয় যা হরমোনাল ভারসাম্য নষ্ট করে এবং উর্বরতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
  • সিমেন/স্পার্ম এর আকার ও পরিমাণে প্রভাব ফেলে।
  • লিবিডু (Libido)বা যৌন আকাঙ্ক্ষা কমিয়ে দেয়, যার ফলে যৌন সম্পর্ক ও যৌন স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ে, ফলস্বরূপ পুরুষের উর্বরতা হুমকির সম্মুখিন হয়।
  • পুরুষ হরমোন হিসেবে পরিচিত টেস্টস্টেরনে প্রভাব ফেলে দুশ্চিন্তা, যেটি পুরুষের উর্বরতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ চলক হিসেবে কাজ করে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা টেস্টস্টেরনের মাত্রা কমিয়ে দেয়।

সন্তান পালনে দুশ্চিন্তার প্রভাব

আপনি যদি একজন দুশ্চিন্তায় ভোগা অভিভাবক হন, তাহলে মনে রাখবেন, নিজের পাশাপাশি আপনার সন্তানদের উপরেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রচুর গবেষণা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে যে, দুশ্চিন্তায় ভোগা অভিভাবকেরা সন্তানদের সাথে যেসব আচরণ করেন, সেগুলো সন্তানদের মানসিক বিকাশে বাঁধা দেয়। বাচ্চাদের ব্যক্তিত্ব যেহেতু বড়দের দেখেই তৈরি হয়, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অভিভাবকের বাচ্চারা তুলনামূলক দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষ হিসেবে বড় হয়।

এছাড়াও আরও যেসব সমস্যা দেখা দেয় তা হচ্ছে-

  • দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অভিভাবক প্যারেন্টিং উপভোগ করতে পারেন না।
  • বাচ্চাদের সাথে সুন্দর বন্ধন (Bonding) ও মানসম্মত সময় (Quality time) কাটাতে পারেন না।
  • বাচ্চাদের সাথে চিৎকার চেচামেচি করেন, মন্দ ব্যবহার করেন।
  • পোস্টপারটাম ডিপ্রেশনে ভোগেন অনেকেই, বিশেষ করে নারী অভিভাবকগণ এই সমস্যায় ভোগেন বেশি।
  • অভিভাবকের অবহেলার ফলে বাচ্চারাও মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকেনা।
  • ছোট বাচ্চারা যেহেতু বড়দের মানসিক অবস্থা আঁচ করতে পারে, তাই ওরা নিজেদের নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগে, যার ফলে বাচ্চাদের আচরণগত সমস্যা (Behavioral issues) দেখা দেয়।
  • প্যারেন্টাল স্ট্রেস এর ফলে পারিবারিক অশান্তি, দাম্পত্য কলহ এবং সন্তানদের লালন পালনে ভারসাম্য নষ্ট হবার পাশাপাশি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাও দেখা যায়।

দুশ্চিন্তা মোকাবেলার উপায়

দুশ্চিন্তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতে চাইলে এটিকে অবহেলা করে এড়িয়ে যাওয়া চলবে না, বরং সাহস ও পর্যাপ্ত জ্ঞানের সাথে এর মোকাবেলা করতে হবে।

 দুশ্চিন্তা মোকাবেলায় প্রথাগত উপায়

মানসিক দৃঢ়তা

দুশ্চিন্তা মোকাবেলায় সবার আগে দরকার আপনার “মানসিক দৃঢ়তা”। অর্থাৎ যে সমস্যার/ঘটনার ফলে দুশ্চিন্তা হচ্ছে, সেটিকে ভয় না পেয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সমস্যা এড়িয়ে না গিয়ে সেটির সমাধানের চিন্তা করতে হবে। এতে করে আমাদের ব্রেইন ভয় পাওয়া কমিয়ে সমাধান খুঁজতে ব্যাস্ত হয়ে যাবে। তাই মনকে দৃঢ় করতে হবে এই বলে যে “ আমি ভয় না পেয়ে সমস্যার মুখোমুখি হবো”। এতেই প্রাথমিক সমাধান চলে আসবে।

লিখে ফেলা

যা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে, তা লিখে ফেলা আরেকটি কার্যকরী সমাধান। মাথার চিন্তা খাতায় তুলে ফেললে সমস্যা সমাধানের জন্য সহজ হবে।  যেই সমস্যা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে, সেটি সমাধানের পরিকল্পনা, সেটির সম্ভাব্য সমাধান ও সমাধানের ক্ষেত্রে আপনার শক্তি ও দুর্বলতা কী কী আছে, সেসব একটি খাতায় লিখে ফেলুন। এতে আপনার ব্রেনের উপর চাপ কমে যাবে ও সমাধানের পথ সহজ হবে।

ব্যায়াম করা

দুশ্চিন্তা মোকাবেলায় আরেকটি দারুণ উপায় হচ্ছে ব্যায়াম করা। যখন আপনি দুশ্চিন্তায় ভুগবেন, তখন চেষ্টা করবেন শারীরিক ব্যায়াম করতে। অনেকেই আছেন দুশ্চিন্তায় ভেঙ্গে পড়ে শুয়ে থাকেন। এতে আপনার ব্রেইন দুশ্চিন্তার জন্য আরও সুযোগ পায়। কিন্তু আপনি যখন ব্যায়াম করবেন, তখন হরমোনের বিভিন্ন পরিবর্তনের ফলে আপনার ব্রেনের সিগন্যাল অন্যদিকে চলে যাবে ও আপনার দুশ্চিন্তার ফোকাস কমে যাবে। এতে আপনি রিলাক্সড অনুভব করবেন। তাই দুশ্চিন্তা মোকাবেলায় আপনি আপনার জন্য সহজ ও পছন্দনীয় কোন ব্যায়াম করতে পারেন। হাঁটাহাঁটি করা এক্ষেত্রে বেশ ভালো অপশন হতে পারে।

ব্যস্ত থাকা

দুশ্চিন্তা মোকাবেলায় আরেকটি হাতিয়ার হচ্ছে, কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। বলা হয়ে থাকে, “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা”। আপনি যদি খুব ফ্রি থাকেন, তখন আপনার ব্রেন তার পুরো শক্তি ব্যয় করবে দুশ্চিন্তা করতে গিয়ে। কিন্তু আপনি যখন কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়বেন, তখন ব্রেইন বাধ্য হয়ে অন্যদিকেও মনোযোগ দেবে। এতে করে মানসিক চাপ অনেকটা কমে যাবে।

পছন্দের কাজে লেগে পড়া

পছন্দের যে কোন কাজেই দুশ্চিন্তা কমে। যেমন বই পড়া, প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা, পেইন্টিং, পছন্দের মানুষের সঙ্গ, ইবাদাত অথবা হালাল যে কোন কাজ আপনাকে দুশ্চিন্তা থেকে আরাম দেবে।

পুষ্টিকর খাবার

পরিমিত ও পুষ্টিকর খাবারের মাধ্যমেও দুশ্চিন্তা থেকে আরাম পাওয়া যায়। বিশেষ করে, ভিটামিন ডি এর অভাবের সাথে দুশ্চিন্তা বা ডিপ্রেশনের সম্পর্ক তো প্রমাণিত। তাই আপনার দৈনিক খাদ্যতালিকা সুষম রাখার চেষ্টা করুন। 

দুশ্চিন্তা মোকাবেলায় ধর্মীয় পরামর্শ

আল্লাহ্‌তায়ালা এবং আমাদের রাসুল (সাঃ)  দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির উপায় বলে দিয়েছেন।

রিজিক, ভবিষ্যৎ, অসুস্থতা, যেকোনো বিপদ অথবা যে কারণে আপনি দুশ্চিন্তা করছেন, সেটা থেকে মুক্তির জন্য আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। দোয়া মুসলমানের জন্য আল্লাহর বিশেষ নিয়ামাত। কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত দোয়া ছাড়াও আপনি মনের মতন করে আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন।

নিয়মিত ইস্তেগফার ও দুরুদ পড়লে সওয়াব অর্জনের পাশাপাশি মানসিক শান্তি পাবার ব্যাপারে হাদিস বর্ণিত আছে। তাই দুশ্চিন্তা মোকাবেলায় বেশি বেশি ইস্তেগফার ও দুরুদ পাঠ করতে চেষ্টা করুন।

আমরা দুশ্চিন্তা করি কারন আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, অজানা। শয়তান আমাদেরকে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় দেখায়, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের ভয় দেখায়। এগুলো মোকাবেলায় শক্তিশালী হাতিয়ার হচ্ছে আল্লাহর উপর তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) ও তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর ভরসা) করা। নিয়মিতভাবে তাকওয়া ও তাওয়াককুলের চর্চা করে যেতে পারলে দুশ্চিন্তা মোকাবেলায় সাফল্য নিশ্চিত ইনশা আল্লাহ্‌।

শেষ কথা

দুশ্চিন্তা আমাদের জীবনের স্বাভাবিক অনুভূতি। তাই এটিকে ভয় পেয়ে এড়িয়ে যাওয়া চলবেনা বরং উপযুক্ত জ্ঞান ও অভ্যাসের মাধ্যমে দুশ্চিন্তা মোকাবেলা করে সমস্যা সমাধান করা শিখতে হবে। জীবনের সর্ব অবস্থায় আল্লাহর বিধি নিষেধ মেনে চলতে হবে।

তথ্যসূত্র