বাচ্চাদের শারিরীক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য প্রকৃতির সান্নিধ্য কতখানি জরুরী তা লিখে শেষ করা যাবে না। প্রকৃতির সান্নিধ্য ছাড়া বড় হওয়া শিশুর মধ্যে তার নিজের বাবা মাও অনেক সময় আপাতদৃষ্টিতে ‘কোন সমস্যা দেখতে পান না’। আসলে সমস্যা দেখতে পান ঠিকই, কিন্তু এটার সাথে প্রকৃতির সান্নিধ্যের সম্পর্ক থাকতে পারে এটা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেন না।
খাঁচায় বন্দী বাচ্চাদের একটা সময় বিভিন্ন শারিরীক, মানসিক ও আচরণগত সমস্যা দেখা যায়, এক এক বাচ্চার এক এক রকম। কেউ হয়তো খুব ঘন ঘন নানা অসুখে ভোগে। কেউ আবার খুব জেদী, মাত্রাতিতিরিক্ত চঞ্চল, কেউ আবার খুব ‘দুষ্টুমি করে’, কলম দিয়ে ছোট বোনকে খোঁচা দিয়ে পালায়, লুকিয়ে বাথরুমে যেয়ে শ্যাম্পুর বোতলটা থেকে সবটা টয়লেটে ঢেলে দেয় ইচ্ছা করে, মা যখন শ্যাম্পু পাবেন না তখন কেমন মজা হবে তাই দেখার আশায়, সারাদিনই তার একটা নানেকটা দুষ্টুমি লেগেই থাকে। এগুলোকে বাবা মা নিছক স্বাভাবিক রোগ ব্যাধি বা বয়সের দোষ বলে গুরুত্ব দেন না, বা গুরুত্ব দিলেও সেগুলোর চিকিৎসা নিয়ে যত চিন্তাই তাঁদের মাথায় আসুক, প্রকৃতির সান্নিধ্যকে তাঁরা চিকিৎসক এর ভুমিকায় রাখার কথাটা চিন্তাও করেন না।
আমরা অনেকেই মনে করি, হোমস্কুলিং মানে হলো ‘পয়সা বাঁচানো’। স্কুলে যাতায়াতের খরচ নেই, মাসে মাসে বেতনের টাকা গোণা লাগে না। অনেকের ক্ষেত্রে এটা বাস্তব হতেই পারে যে তাঁরা স্কুলে পড়ানোর সামর্থ না রাখার কারণেই মূলত হোমস্কুলিং করাচ্ছেন, কিন্তু যাঁদের সুযোগ ও আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে তাঁদের পয়সা বাঁচানোর চেয়ে বরং বাচ্চার সার্বিক উন্নতিই প্রাধান্য পাওয়া উচিত। সপ্তাহে অন্তত একবার পার্ক বা প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে কাটানোর মত যেকোন যায়গা। সম্ভব হলে সেটা পাহাড় বা সমুদ্রও হতে পারে। সম্ভব হলে সেটা একদিনের যায়গায় প্রতিদিন হতে পারে। যাঁর যতটুকু সাধ্যে কুলায়। এটা যদি কারো কাছে অতিরিক্ত পয়সা খরচ বলে মনে হয়, এ কথাটাও মাথায় রাখতে হবে যে, শিশুর পরবর্তীতে বিভিন্ন রোগ ব্যাধি সমস্যা দেখা দিতে থাকলে(যেটা প্রায় অবশ্যম্ভাবী) চিকিৎসার টাকা আরো বেশি গুণতে হতে পারে।
আমি ব্যাক্তিগত ভাবে এমিউজমেন্ট পার্কের বিপক্ষে। এমিউজমেন্ট পার্কের ক্ষতিকর দিক আছে কিছু। ইঞ্জিনচালিত রাইডগুলোতে বাচ্চারা এক্টিভলি খেলে না। সে নিজে আনন্দ খুঁজে নিতে শেখে না, সে প্যাসিভ থাকে, তাকে আনন্দ দেয়া হয়। যেটা তাকে লং রানে মানসিকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আর এমিউজমেন্ট পার্কের জগতটা স্বাভাবিক না, কৃত্রিম। এখানে ডোপামিন হরমন নিঃসরণকারী উপকরণ প্রচুর, যা মানুষকে সাময়িক আনন্দ দিলেও লং টার্মে বিষণ্ণতার কারণ হয়। যার ফলে বাচ্চার মনে হতে পারে, আনন্দ মানেই কৃত্রিমতা। তার প্রাকৃতিক পার্ক আর তখন ভালো লাগতে পারে। বরং ভালো হয় যদি আমরা এই ধারণা দিতে পারি যে, আনন্দ মানে প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়া। যেখানে সত্যি সত্যিই লং টার্ম সুখের হরমোন অক্সিটোসিন ক্ষরণ হয়।
তারপরেও নিয়মিত পার্ক সাধ্যের অতিরিক্ত হয়ে গেলে কী করণীয়?
ঘরের মধ্যেই প্রকৃতির সান্নিধ্য আছে এরকম যায়গায় বাচ্চাকে বেশি বেশি থাকার সুযোগ করে দিতে হবে। বাচ্চার পড়ার জায়গাটা রুমের এক কোণাতেই হতে হবে এমন কোন কথা নেই। বারান্দায় সূর্যের আলো, খোলা বাতাসে চেয়ার টেবিল বা মাদুর বিছিয়েও বসা যায়। বারান্দায় সম্ভব হলে দু’ চারটা বা আরো বেশি গাছের টব থাকতে পারে, সেগুলোর যত্ন বাচ্চা নিজে নেবে। মাঝে মাঝে হয়তো চড়ুই পাখি বা প্রজাপতি উড়ে এসে সেখানে বসবে। বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকালে হয়তো এক টুকরো আকাশ দেখা যাবে। বারান্দায় কাপড় শুকাতে দেওয়া থাকলে পড়তে বসার সময়ে অন্তত সেগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। বারান্দাকে পারতপক্ষে ‘স্টোররুমের বিকল্প’ হিসেবে ব্যবহার না করাই ভালো। এই খোলামেলা জায়গা, সূর্যালোক, বাতাস, অল্প সবুজ, এক দুটো পাখি বা প্রজাপতিও নিয়মিত সান্নিধ্যে আসলে বাচ্চার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। অথচ এর জন্য আলাদা খুব একটা কষ্টও করা লাগে না। এরকম পরিবেশে পড়তে বসলে বাচ্চার মনোযোগের পরিধিও বৃদ্ধি পায়।
বারান্দা যদি না থাকে, অথবা যদি খোলামেলা না হয়? তাহলে বাসার ছাদ। অদ্ভুত শোনালেও যদি সম্ভব হয়, বাচ্চাকে নিয়ে বাসার ছাদে পড়তে বসা যেতে পারে। বরং সেটা বারান্দার চেয়েও ভালো। এক দেড় ঘন্টার বেশি তো সে এমনিতেও পড়বে না। এতটুকু সময়ের জন্য আপনার নিয়মিত ছাদে ওঠাটা আশা করা যায় কারো কাছে দৃষ্টিকটু লাগবে না। ছাদের পরিবেশও যতটা সম্ভব ‘প্রাকৃতিক’ হলে ভালো। বারান্দায় যদি দুটো টব থাকে তো ছাদে দশটা অনায়াসেই রাখা যায়। পড়তে বসতে হবে গাছপালার একটু কাছাকাছি। মৃদু বাতাসে যেন মাঝেমাঝেই পাতার নড়াচড়া পড়া থেকে বাচ্চার ‘মনোযোগ সরিয়ে’ সেদিকে নিয়ে যায়। এই মনোযোগ হারানো থেকে কখনও কখনও দারুন ফলাফলও হতে পারে।
পড়ার সবচেয়ে সুন্দর সময় ভোর, সূর্য ওঠার আগের বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিয়ে ফুসফুস আর রক্তকে বিশুদ্ধ করার সুযোগ হেলায় হারানো উচিত না। প্রতিদিন সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য যে বাচ্চার হয়, তার শৈশব কি সুন্দর না হয়ে পারে? সূর্যোদয়ের সময়টাতে পড়ায় বিরতি দিয়ে মা-শিশু একসাথে সূর্যোদয় দেখাই ভালো। সকালের স্নিগ্ধ বাতাস আর মিষ্টি রোদে পড়তে বসাটা নিয়মিত হলে ওর মস্তিষ্ক ‘পড়াশোনা’ ব্যাপারটার সাথে ‘সুন্দর আবহাওয়া’কে একত্রিত করে সুমধুর দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি তৈরি করবে। বড় হলে কেউ যখন জিজ্ঞেস করবে, শৈশবের সবচেয়ে মধুর সময়ের কথা, হয়তো চোখের সামনে মায়ের সাথে পড়তে বস্র মুহুর্তগুলোই আগে ভেসে উঠতে পারে চোখের সামনে, কে জানে?
বাচ্চাদের বিকেলে খেলার ব্যবস্থা করতে হবে, ভিডিও গেমস না, লেগো বা পুতুল না, ছাদে, সম্ভব হলে প্রতিদিন। অন্তত দুই ঘন্টা হলে ভালো। মাঝে মাঝে সূর্যাস্ত, অন্ধকার নেমে আসাটা উপভোগ করতে পারলে আরো ভালো। তবে অবশ্যই বড় কারো উপস্থিতিতে, এই সময়ের দোয়া, যিকর, বাচ্চাদের সুরক্ষার ব্যাপারটাতে ছাড় না দিয়ে।
বিকেলে যদি মাকে সময় দেয়া না লাগে, রাতে শোয়ার কিছুক্ষণ আগে আরেকবারের জন্য ছাদে যেতে পারলে খুব ভালো। সেটা পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও। অথবা একটু বড় বাচ্চার ক্ষেত্রে ফজরের আগে বা ঠিক পরপর অন্ধকার থাকতে। যদি বাচ্চা সজাগ থাকে আর ছাদ খোলা থাকে ঐ সময়ে।
বিড়াল বা কবুতর পোষা ভীষণ ভালো, যদি সম্ভব হয়। বাচ্চার উপর এর সুপ্রভাব অপরিসীম।
( মিশরের লোকেদের ছাদে যাওয়ার সংস্কৃতি নেই, ছাদ তাদের গণ ডাস্টবিন। একটু বড় বাচ্চারা খোলামেলা বা ব্যস্ত অলিতে গলিতে, রাস্তায় খেলে। বাংলাদেশের বাস্তবতা কল্পনা করে এর চেয়ে বেশি কিছু মাথায় আসছে না। যা বললাম তাও কতটা বাস্তব, জানি না। কারো কোন সুন্দর আইডিয়া থাকলে কমেন্টে জানানোর অনুরোধ।)
প্রথম প্রকাশ: ফেসবুক
ছবি কৃতজ্ঞতা: ফ্রিপিক