মেয়ের যখন ১১ মাস বয়স তখন একদিন হঠাৎ শরীর খুব খারাপ লাগছিল। বমি আসছিল, মাথা ঘুরছিল, শরীরে কোন শক্তি পাচ্ছিলাম না। অফিসে যখন গেলাম তখন চেহারা ছবি দেখে আমার সহকর্মীরা বলল প্রেগনেন্সি কিট দিয়ে টেস্ট করে দেখো। খুব অবাক হয়ে প্রেগনেন্সি কিট দিয়ে টেস্ট করে দেখলাম পজিটিভ আসছে। অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ।
ভয় লাগছে, খুশি লাগছে, শংকা ও বোধ করছিলাম। বড় বাচ্চাটা এখনো এত ছোট। আমার খালার বাসায় ওকে রেখে অফিস করতে যাই। এখন আবার আরেকজন আসবে শুনে কেমন যেন ভয় করে উঠলো। সবকিছু সামলাতে পারবে তো ঠিক ভাবে? শরীরে কি কুলাবে?
সাধারণত শরীরটা সকালের দিকে বেশি খারাপ থাকতো। বমি আসতো প্রচুর। আর অনেক অনেক খিদা লাগতো। পেট খালি হলেই বমি চলে আসতো। কি যে কষ্ট হোত!! তাই বারবার ভারী খাবার খাওয়া লাগত।
প্রেগনেন্সির পুরোটা সময় মোটামুটি স্বাস্থ্যকর খাবার দাবার খেয়েছি, হাঁটাচলা করার চেষ্টা করেছি, ঘর সংসারের কাজ, অফিসের কাজ ইত্যাদি করে মোটামুটি সার্বিকভাবে সক্রিয় থাকতাম সব সময়।
২০ মাস বিরতিতে দ্বিতীয় জন আসবে। তাই বেশ সন্দিহান ছিলাম নরমাল ডেলিভারি হবে কিনা… প্রথম ডেলিভারির সাথে গ্যাপ এতো কম এবং প্রথমবারো সিজারিয়ান ডেলিভারি ছিল। খোঁজখবর করছিলাম এদিক সেদিক।
মোটামুটি বেশিরভাগ মতামত পেলাম দুই বাচ্চার গ্যাপ যদি অল্প হয় সেক্ষেত্রে নরমাল ডেলিভারি টা একটু বিপদজনক হতে পারে। তাই দ্বিতীয়বার নরমাল হবার সম্ভাবনা অনেকখানি কমে গেছে।
বড় মেয়ে ক্রমাগত ব্রেস্টফিডিং করতে। শেষের দিকে মানসিকভাবেও অনেক বিরক্ত থাকতাম এবং শারীরিক ভাবে বেশ ব্যথা পেতাম। তখন শুধু মনে হতো কত দ্রুত পেট থেকে আরেকজনকে বের করে দিতে পারব।
নিয়মিত বিরতিতে ডাক্তারের কাছে গেছি। শারীরিকভাবে মোটামুটি ভালোই ছিলাম। বাচ্চার মাথা ও নিচের দিকে ছিল। বড় সন্তানের সময় ওর মাথা সব সময় উপরের দিকে ছিল। পরে সেটা আর নামেনি। এবার যেহেতু সব সময় বাচ্চার মাথা নিচের দিকে ছিল তাই আশা করেছিলাম হয়তো নরমাল ডেলিভারি হতে পারে।
বাবার বাড়ি চট্টগ্রামের হওয়ার এবং ঢাকাতে বাবু এবং আমাকে দেখাশোনা করার কেউ না থাকায় চট্টগ্রামে আম্মুর কাছে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। আগের বাচ্চাও চট্টগ্রামে হয়েছে। এবারও ডেলিভারির বেশ কিছুদিন আগে ছুটি নিয়ে চট্টগ্রামে চলে গিয়েছিলাম।
আগেরবার যে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম তার কাছেই আবার দেখাতে গেলাম। তিনি আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট নিয়ে দেখা করতে বললেন। বাচ্চার ইডিডি ছিল ১৪ ই অক্টোবর ২০১৬। সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখে যখন আল্ট্রাসনোগ্রাম করলাম, রিপোর্টে আসলো ফ্লুইড কমে বিপদসীমার কাছাকাছি চলে গেছে।
তখন আবার কোরবানি ঈদের সময় ছিল। তাই ডাক্তার সেপ্টেম্বর মাসের শেষে এসে ভর্তি হতে বলেছিল।
মেয়েকে তখন বুকের দুধ ছাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ক্রমাগত দুই তিনদিনের চেষ্টায় মেয়েটাকে দুধ ছাড়াতে পেরেছিলাম। কিন্তু মেয়েটা তখন মাঝরাতে চিৎকার করে কেঁদে উঠতো। এভাবে প্রায় দশ পনেরো দিন কান্না করেছে। তার সেই সময়কার কষ্টে আমি যেন আরো ভেঙে পড়ছিলাম।
ঈদের পরে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। আম্মু এবং শাশুড়ি দুজনই খুব অবাক। কেন কোন ধরনের জটিলতা ছাড়াই এত আগে ডাক্তার সিজার করার কথা বলছে। ফ্লুইড লেভেল কমে গেছে -এটার গুরুত্ব কতখানি সেটাও আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
যাই হোক মাসের শেষে সেই ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। দুর্ভাগ্য ক্রমে সবচেয়ে খারাপ রুমটা বরাদ্দ পেলাম।(বাথরুমের গন্ধ রুমে আসতো। অন্য কোন রুম ও খালি ছিল না।)
সেদিন সকাল ১০টায় ওটিতে নিয়ে গেল। যাবার আগে মনটা খারাপ হয়ে ছিল অনেক। দোয়া পড়ছিলাম শুধু। এতো ছোট্ট মেয়েটা একা থাকবে কেমন করে, মা-বাবা ছাড়া- ভাবতেই কাঁদছিলাম শুধু। তাদের বাবাকে বলে দিলাম, আমার কিছু হয়ে গেলে বাচ্চাদের যেন ওদের নানুর কাছে দিয়ে দেয়। ওদের বাবা আমার কথাবার্তা শুনে শকড হয়ে গেল।, আমাকে আর কি সান্তনা দিবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা।
ওটি তে নেয়ার পর ডাক্তার সেখানকার সিস্টারদের রোগীকে রেডি করতে নির্দেশ দিল। নার্স এসে আমাকে চেক করে ক্যাথেটার পরিয়ে দিল। এরপর ক্যানোলা করল, স্যালাইন দিল, আনেস্থেশিয়া দিল।
ডাক্তার এসে যখন সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখছিলো তখন তিনি টের পান যে আমাকে ভুল জায়গাতে ক্যাথেটার পরানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রস্রাবের রাস্তায় ক্যাথেটার না দিয়ে জরায়ুর রাস্তায় দিয়েছে।
ডাক্তার সমানে নার্সদের বকা দিচ্ছে। বলছিল আমি না দেখলে এই রোগীর অবস্থা তো খারাপ হয়ে যেত। সারাক্ষণ পেট ব্যথা, পেট ব্যথা করে চিৎকার করতো আর কেউ কোনো কারণ খুঁজে পেত না। মাঝখান থেকে ডাক্তারের বদনাম হোত। আমি চুপচাপ সব শুনছিলাম কিছুই বললাম না। কিছুক্ষণ পর আমার ছেলেকে বের করল। আলহামদুলিল্লাহ।
ওকে বের করার পর শুনলাম পানি একদমই ছিল না। ও প্রায় শুকনো অবস্থায় বের হয়েছে। সারা গায়ে থকথকে আঠালো হয়েছিল। আমার আম্মু দেখে বলছিলো এরকম বাচ্চা কখনো তিনি দেখেননি।
কিছুক্ষণ পর আমাকে রুমে পাঠানো হলো। ডাক্তার এসে দেখে গেল সবকিছু ঠিক আছে কিনা। রুমে আসার কিছুক্ষণ পর কাঁপুনি শুরু হলো। স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লেগেছিল। সন্ধ্যার পর এনেস্থিসিয়ার প্রভাব যখন কেটে যাচ্ছিল তখন প্রচন্ড ব্যথা টের পাওয়া শুরু করলাম। খেয়াল করলাম আমার জামাকাপড় সব ভিজে আছে। হাসপাতলে আমার সাথে বাচ্চাদের বাবা ছেলে। তাকে বললাম এরকম কেন হচ্ছে? নার্সদের ডেকে আনো। পরে দেখা গেল ক্যাথেটার ঠিকভাবে প্লেস করা হয়নি বলে লিক হচ্ছিল। প্রচন্ড কষ্ট করে সমস্ত কিছু পাল্টানো লেগেছে।
দুই ঘন্টা পর আবার দেখলাম বিছানা ভিজে গেছে। আবার ক্যাথেটার সরে গেছে। বুঝলাম ওদের সার্ভিস প্রচন্ড খারাপ। কেননা আগেরবার অন্য হাসপাতলে আমার এত বাজে অভিজ্ঞতা হয়নি সিজারের সময়। পরদিন ক্যাথেটার খুলে দেওয়ার পর যখন ওয়াশরুমে যাওয়ার শুরু করলাম গিয়ে দেখি ভাঙ্গা কমোড যেখানে বসা যায় না।
আবার সেটা চেক করানোর ব্যবস্থা হল। এরপর বিল দেয়ার সময় দেখা গেল তারা অনেক কিছুর দাম বেশি রেখেছে। তার বাবা সোজা ভোক্তা অধিদপ্তরের কমপ্লেন করেছে প্রমান সহ। পরবর্তীতে ভোক্তা অধিদপ্তর তাদের হাজার পাঁচেক টাকা জরিমানা করে এবং আমাদের জরিমানার একটা অংশ আমাদের দেয়া হয়।
প্রসব পরবর্তী সময়ে ৮ থেকে ১০ দিন প্রচন্ড ব্যাথায় কষ্ট পেয়েছিলাম, কারণ সম্ভবত ঔষধ যথাযথ ছিল না । সাপোজিটরি/পেইন কিলার দিয়েও ব্যাথা কমতো না। ব্যাথায় প্রায় প্রতি রাতেই জ্বর আসতো। এই পুরোটা সময় কারো সাহায্য ছাড়া বিছানায় উঠানামা করতে পারতাম না। এই কষ্টের কথা মনে হলে এখনো খারাপ লাগে।
এই কষ্টকর অভিজ্ঞতার কোন ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত আমার কাছে নেই, কারণ একই ডাক্তারের অধীনে ভিন্ন অথচ ব্যয়বহুল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলাম। প্রথমবার এত কষ্ট হয়নি। আর এই বাজে অভিজ্ঞতা ও ছুটি না থাকায় তৃতীয় বাচ্চার ডেলিভারির সময় ঢাকায় বারডেম মা ও শিশু হাসপাতালে যাই।
এই হাসপাতাল ঠিক করার সময় আমরা বেশ খোঁজ নেই যাতে দ্বিতীয়বারের অভিজ্ঞতা আর না হয়। আল্লাহর রহমতে খুব দ্রুত রিকভার করেছিলাম, ব্যাথা সংক্রান্ত কোন সমস্যা হয়নি। দ্বিতীয় বাচ্চার সময় হওয়া কষ্টগুলোর পূর্ণ দায়ভায় হাসপাতালে অব্যবস্থাপনার বলে আমাদের ধারণা।
নরমাল ডেলিভারি বা c-section যেটাই হোক না কেন আগে থেকে ডাক্তার এবং হাসপাতাল দুটো সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নেওয়া উচিত। যদি এভাবে খোঁজখবর নেওয়া হয় তবে ডেলিভার পরবর্তী মায়েদের ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমে যাবে আশা করা যায়।
আপু আপনাকে সিজার করেছেন কোন ডাক্তার? তার নামটা বলবেন প্লিজ