রাসূলুল্লাহ সল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যিনি ছিলেন পরম সত্যবাদী এবং সবার কাছে সত্যবাদী হিসেবে স্বীকৃত, তিনি বলেছেন, “তোমাদের প্রত্যেকের গঠন প্রক্রিয়া হলো, প্রথম চল্লিশ দিন সে তার মাতৃগর্ভে শুক্ররূপে একত্রিত হয়। পরবর্তী ৪০ দিনে জমাট রক্তপিণ্ডরূপে। এবং তার পরবর্তী ৪০ দিনে পরিণত হয় মাংসপিণ্ডে। তখন আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে পাঠান এবং চারটি বিষয় নির্ধারণ করে দেন। আর ফেরেশতাটি তার (আগত সন্তানের) কর্ম, মৃত্যুর সময়, রিজিক, ভালো অথবা মন্দ হওয়া প্রভৃতি লিখে দেয়। সবশেষে তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দেন।

এরপর তিনি (সল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই সত্তার কসম নিলেন যিনি ব্যাতিত অন্য কোন ইলাহ নেই এবং বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ জান্নাতিদের মতো ভালো কাজ করতে থাকে, এমনকি তার ও জান্নাতের মধ্যে এক হাত দূরত্ব থাকে। কিন্তু এমন সময়ে তার তাকদীরের লিখন এগিয়ে আসে আর সে খারাপ কাজ করতে থাকে এবং পরিণামে জাহান্নামে প্রবেশ করে। অনুরূপভাবে তোমাদের কেউ জাহান্নামীদের মতো খারাপ কাজ করতে থাকে , এমনকি তার ও জাহান্নামের মাঝে একহাত দূরত্ব থাকে। এমন সময়ে তার তাকদীরের সেই লিখন এগিয়ে আসে আর সে ভালো কাজ করতে থাকে আর জান্নাতে প্রবেশ করে। (হাদীসটি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ হতে বর্ণিত এবং সহিহ মুসলিমে লিপিবদ্ধ)

হাদীসটি আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে এপিডেমোলোজিস্ট ডেভিড বার্কারের সমীক্ষা। ১৯৯০ সালে “Fetal Origin Hypothesis” নামে ব্রিটিশ এই এপিডেমোলোজিস্ট তার তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। যেখানে তিনি বলেন, শিশুদের মনস্তত্ত্বের প্রায় ৯০ শতাংশ গঠিত হয় গর্ভে থাকতে এবং বাকী ১০ শতাংশ গঠিত হয় প্রাথমিক শৈশবে। পাশাপাশি, গর্ভাবস্থায় মায়েদের মানসিক উৎফুল্লতা, বিষন্নতা কিংবা অবসাদ সমানভাবে প্রভাব ফেলে গর্ভে থাকা সন্তানের বুদ্ধির বিকাশেও। গর্ভাবস্থায় মায়েরা অতিরিক্ত বিষাদে ভুগলে সেই সন্তান এমনকি সংখ্যাতত্ত্ব বুঝতেও অপারগ হয়।

মনস্তত্ত্ববিদ আনা ফ্রয়েডের শিশুর মনঃসমীক্ষণ, এটাচমেন্ট থিওরি ও সোশিও-ইকোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট থিওরির মতে কোন বড় মানুষের ব্যাক্তিত্ত্ব, দাম্পত্যজীবন, আবেগ-অনুভূতি সম্পূর্ণ নির্ভর করে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলোর উপর। মানুষের ব্যাক্তিত্ত্ব ও মনস্তত্ত্বের গঠনে শৈশবের প্রভাব কেমন এবং তা নিয়ে আমার ভাবিত হয়ে উঠার উপাখ্যানটি খুবই জীবনঘনিষ্ঠ ও আমার ব্যাক্তিগত- যাপিত জীবনের সাথে সম্পর্কিত।

আমাদের সমাজে সাধারণত দেখা যায়, কোন মানুষের মনস্তাত্বিক পরিস্থিতি ও অবস্থানকে সম্পূর্ণ ব্যাক্তির নিজস্ব দায় হিসেবে দেখা হয়। পরিবারে কোন একটা মেয়ে মিশুক না হয়ে চুপচাপ হলে বলতে শুনা যায় ‘ও এমনি’। অর্থাৎ, পরিবার তার পক্ষ হয়ে তাকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে। স্বভাবগতভাবে আমিও ছিলাম ইন্ট্রোভার্ট ও চুপচাপ স্বভাবের। কিন্তু আমার পরিবার কখনোই এই ব্যাপারে আমাকে সাপোর্ট করেনি। আমার পরিবার মনে করতো আমি যেখানেই যাই না কেন কখনোই মানুষের সাথে মিশতে পারবোনা৷ এই চিন্তা থেকে তারা আমাকে নিয়ে একপ্রকার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। প্রথমত, পরিবারের এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে গিয়ে আমি নিজের দিকে অধিক মনোযোগী হয়ে এসবের কারণ খুঁজতে শুরু করি। আমার মনস্তত্ত্ব কীভাবে গঠিত আর কীভাবে তা অতিক্রম করা যাবে, মনস্তত্বের কেমন গঠন সত্য হয় আর কেন সত্য হয় ইত্যাদি প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরতো সারাক্ষণ।

দ্বিতীয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে আমার বন্ধুমহল। পিয়ার প্রেশার বলতে সমাজে যা বুঝানো হয় আমার ক্ষেত্রে তার একটা পজিটিভ প্রভাব পড়েছিলো। বান্ধবীদের সাথে যখন কথা বলতাম, তখন খেয়াল করতাম তারা হাসিঠাট্টা বা মজাও করছে খুব সম্মান ও বিনয়ের সাথে। ওরা যা বলতো আমিও তা নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমার বর্ণনায় তা হয়ে উঠতো ঘৃণিত, অসম্মানজনক। আমরা একই বয়সের ছিলাম, একই বই পড়তাম, একই পরিবেশে থেকে বড় হয়েছিলাম। তবুও আমাদের চিন্তাভাবনা ও উপস্থাপনায় এত বিরাট পার্থক্য কী করে তৈরী হলো আমি তা বুঝতে পারতাম না। এই পার্থক্যের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে সেটাও আমার চিন্তার বিষয় হয়ে উঠে। আর মানুষের মনস্তত্ত্বের জটিলতাই আমাকে এদিকে টেনে নিয়ে এসেছে।

একই সময়ে তৃতীয় যে প্রভাবক কাজ করে তা হলো, পড়াশুনাকে ভালোবেসে বসা। ছোটবেলা থেকে পড়াশুনাকে খুব একঘেয়ে, বিরক্তিকর কাজ হিসেবেই দেখে আসছিলাম। কিন্তু অষ্টম শ্রেণির পরে আমি আবিষ্কার করলাম পড়াশুনা খুব মজাদার আর প্রশান্তির একটা বিষয়। নতুন একটা জিনিসকে জানতে পারা সেটাকে মনে রাখতে পারা খুবই প্রশান্তিদায়ক। পড়াশুনাকে ভালোবাসার ও জ্ঞানানুরাগী হওয়ার এই উপলব্ধিটা সম্পূর্ণ ছিলো আমার ব্যাক্তিগত। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম চাইলেই অন্য বাচ্চাদের মাঝেও পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ তৈরী করা সম্ভব। এতো প্রশান্তির একটা বিষয়কে কেউ ভালোবাসতে পারছেনা এটা তার ব্যর্থতা আর এই ব্যর্থতার শুরুটা করছে আমাদের স্কুলিং সিস্টেম ও হাতেখড়ি দেয়ার একঘেয়ে প্রক্রিয়া। ২০১৭ সালে আমার কাছে সম্বল বলতে ওই এতোটুকু উপলব্ধিই ছিলো। আশেপাশের মানুষদের দেখতাম, প্রতিবেশীদের দেখতাম বাচ্চাদেরকে বসিয়ে নিয়মতান্ত্রিক অ,আ,ক,খ শিখিয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য আমার মায়া লাগতো। কখনো তাদেরকে বুঝানোর এক আধটু চেষ্টা করতাম কিন্তু খুব জোরদার এক্টিভিস্ট হইনি। আমি ভাবতাম, আমার সন্তানকে এসব থেকে দূরে রাখবো। এই চিন্তাতে “3 Idiots” আর “Taare Zameen Par” মুভি দুটোও সাহায্য করেছিলো বেশ। [যখন আমি সেগুলো দেখি তখন দ্বীনের বুঝ অতো ছিলোনা। কিন্তু যা শিখেছি ও উপলব্ধি করেছি তার ফায়েদা এখনো পেয়ে যাচ্ছি]

চতুর্থত, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় কোন একটা গড়বড় আছে তা নিয়ে ভাবিত হই একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে। সম্ভবত ২৮ কি ৩০ তম বিসিএস ক্যাডার যিনি হন তার এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ছিলো যথাক্রমে 2 ও 3 পয়েন্ট। এই সামান্য জিপিএ নিয়েও তিনি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যাবস্থায় অন্যতম মর্যাদার আসনে বসেছেন। অথচ এদিকে ভালো জিপিএ তুলার জন্য আমি রাতদিন পরিশ্রম করে যাই। আমার মনে হলো, জিপিএ খারাপ হলেও জীবনের শেষ ঘটে যায়না। মনে হলো, জন্ম নেয়া-পড়াশুনায় ভালো ফলাফল করা- ভালো চাকরি পেয়ে অনেক টাকা কামাই করা- মরে যাওয়া, জীবনের চিত্রটা এমন হতে পারেনা। এর বাহিরে ভিন্ন কোন চিত্র রয়েছে জীবনের। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম, জিপিএর পিছনে দৌঁড়ানোকে Rat race বলা হয়। আর জীবনের সত্যিই ভিন্ন এক উদ্দেশ্য রয়েছে, জান্নাতের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া।

আমার এই সমস্ত চিন্তাভাবনাকে একত্রে করলে দেখা যায়, মূলে রয়েছে মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আমার ঔৎসুক্য। গত ৫ বছর ধরে মনস্তত্ত্বের এইসব জটিলতার পিছনেই আমি ঘুরেছি দিনরাত। আল্লাহর কী মহিমা, তিনি আমাকে কুরআনিক ও ইসলামিক সাইকোলজির সাথেই পরিচিত করিয়েছেন। একেকটা আয়াতের মাঝে মানুষের মনস্তত্ত্ব কী সুন্দর রূপে নিহিত, সেই বিষয়গুলোকেই তিনি আমার সামনে এনেছেন। সুবহানাল্লাহ!আমার এই সমস্ত চিন্তার জট খুলতে শুরু করে এবছরই। যখন হোমস্কুলিং নামক ফিলসফির সাথে পরিচিত হই। শিশুদের পড়াশুনাকে আকর্ষণীয় করে তুলার ব্যাপারটিকে যে “Homeschooling” বলে তা জানতে পেরেছি খুব বিষ্ময়সূচক ভূমিকার মাধ্যমে। ফেসবুক পেজ Homeschool with noor এর একটা পোস্ট থেকে। অথচ আমি পেজটাকে ফলো করতাম অনেক আগে থেকে! শব্দটার সাথেও পরিচিত ছিলাম প্রায় একবছর ধরে। কিন্তু তার ব্যাখ্যা জানতাম না! ব্যাখ্যা জানার এই ভূমিকাটা তাই বিষ্ময়সূচক। আর জানার পর থেকেই গত ৮ মাস শিশুদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমার ভাই-বোন রয়েছে দুইজন, যাদের একজন মাঝ শৈশবে অপরজন প্রিস্কুলার। তাদেরকে দিয়েই আমার হোমস্কুলিং চলে। প্রতিবেশীদের মাঝেও এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছি। আলহামদুলিল্লাহ। কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে হোমস্কুলিংয়ের জন্য একটা প্রসপেক্টাস, সিলেবাস ও কারিকুলাম তৈরীও করেছিলাম। কিন্তু কাজ করার সময়ে সব ঠিক থাকা সত্বেও কিছু একটার শূণ্যতা অনুভব করি। আমার বুঝা ও কথায় কোথাও গ্যাপ রয়ে গিয়েছে বলে মনে হতে থাকে। এই শূণ্যতার অবসান ঘটাতেও আল্লাহর সুন্দর একটা পরিকল্পনা ছিলো। সুবহানাল্লাহ।

৪ মাস আগে, ফেসবুকে টিনএজারদের মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যা করে একটা সিরিজ লিখতে শুরু করেছিলাম। যেটাতে টিনএজকে ব্যাখ্যা করতে মানুষের বয়সভিত্তিক বিকাশের আলোচনা করি। ঘটনাচক্রে, আমার বন্ধুতালিকায় একজন প্রকাশক ছিলেন যিনি টিনএজ সিরিজটা পড়েন এবং শিশুদের জ্ঞানবিকাশের ধারা সম্পর্কিত পান্ডুলিপি তৈরী করে দিতে বলেন। তখনও আমি এতোটা আত্মবিশ্বাসী হইনি যে শিশুদের বিকাশ সম্পর্কে আস্ত একটা বই লিখে ফেলবো। কিন্তু তিনি আশ্বাস দেন পান্ডুলিপি তৈরী করতে যত বইয়ের সাহায্য দরকার হবে তিনি করবেন। বই দিয়ে সাহায্য করবেন- এটা শুনেই মূলত আমি তার প্রস্তাবে রাজি হই। এবং আলহামদুলিল্লাহ তিনি যথেষ্ট সাহায্য আমাকে করেছেন। এখনো অবধি প্রায় ৫০ টার মতো বই, শতাধিক আর্টিকেল, ম্যাগাজিন, লেকচার, ভিডিও ইত্যাদি দেখেছি। বইটার কাজ করতে গিয়েই বিস্তারিত গবেষণা করতে হয়েছে আমাকে আলহামদুলিল্লাহ। এবং, এই কাজটি আমার যাপিত জীবনের সকল প্রশ্ন, অমীমাংসার সমাধান করেছে। আমার জীবনের যে কয়েকটা প্রশ্ন নিয়ে আমি যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেই সকল প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়েছি এবং সেসবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও কারণ বুঝতে পেরেছি।

বইটার কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম এটা খুবই জীবন্ত একটা বিষয়। চারপাশে অনেক অনেক গ্রুপ, চ্যানেল এবিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমিও তাই কাজগুলোকে কোথাও আবদ্ধ করতে চাইনি; সীমাবদ্ধ করতে চাইনি বইয়ের পাতায়। চেয়েছিলাম সক্রিয় এক্টিভিস্ট হয়ে এব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরীতে কাজ করে যাবো, ওয়ামা তাওফিকী ইল্লা বিল্লাহ। মনের এই তামান্না থেকেই মাতৃত্বের সাথে পথচলার অঙ্গিকার করেছি, ইন শা আল্লাহ বিইযনিল্লাহ।

আল্লাহর অনুগ্রহ হলে কালজয়ী প্রকাশনা থেকে আমার প্রথম তাত্ত্বিক/মৌলিক/গবেষণাপত্র প্রকাশিত হবে ফেব্রুয়ারির বইমেলায়। ওয়ামা তাওফিকী ইল্লা বিল্লাহ। মাআস সালাম। দুআয় রাখবেন ইন শা আল্লাহ। ফি আমানিল্লাহ।

তথ্যসুত্রঃ

১) Prenatal Development: What babies learn in the womb- Sprouts (ইউটিউব চ্যানেল)

২) শিশুর মনঃসমীক্ষণ- রিফ্ফাত আহমেদ অনূদিত

৩) Development psychology- Jeana Overby .

৪) Development psychology- Jeana Overby.

৫) Rich Dad Poor Dad- Robert Kiyosaki

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা