“বাচ্চা কিছুই খেতে চায় না” এই নিয়ে মায়েদের যেন চিন্তার অন্ত নেই। আজকাল প্রায় সব মায়েদেরই এই একই আক্ষেপ – খাবারে অনীহা। বিভিন্ন অভিজ্ঞ ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া কিছু দিক নির্দেশনা রয়েছে সেগুলোর উপর ভিত্তি করেই আসুন দেখে নেই বাচ্চার অরুচির ক্ষেত্রে  কি কি পদক্ষেপ আমরা গ্রহন করতে পারি।

বাচ্চার শারীরিক সুস্থতা

বাচ্চা খেতে না চাইলে সবার আগে পরীক্ষা করতে হবে বাচ্চার কোন শারীরিক অসুস্থতা বা অস্বস্থি আছে কি না। যেমন: বাচ্চার পেটে গ্যাস জমে থাকলে খাবারে অরুচি হয় এছাড়াও কোষ্ঠকাঠিন্যে, পেটে কৃমি অথবা ওরাল থ্রাসের সমস্যাতেও বাচ্চাদের খাবারে অনীহা হয়। এ ধরনের সমস্যা থাকলে তা আগে সমাধান করতে হবে।

এসব সমস্যা থেকে থাকলে সেগুলো সমাধান না করে জোর করে বার বার বিভিন্ন খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করলে বাচ্চাতো খাবেই না, বরং উল্টো খাবারের প্রতি আতংকিত হয়ে উঠবে। এটা একদমই অনুচিত এবং দীর্ঘমেয়াদে বাচ্চার উপর শারীরিক এবং মানসিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কোন অবস্থাতেই বাচ্চাকে জোর করে খাওয়ানো উচিত নয়।

এবার অনেকেই হয়তো বলবেন এভাবে কি বাচ্চা সারাদিন না খেয়ে থাকবে? এটার উত্তরে আমি বলতে চাই যে, আল্লাহ মানুষকে এমন ভাবে সৃষ্টি করেছেন যে তার খিদে পাবেই এবং সে খাবেই– যদি না সে অসুস্থ হয়। বাচ্চা খাবেই। খেতেই হবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। অস্থির না হয় একটু ধৈর্য্য ধরুন বাচ্চাকেও একটা স্পেস দিন। যদিও সে আপনার সবচেয়ে প্রিয়, আপন এবং আদরের, তারপরও মনে রাখতে হবে সে একজন আলাদা মানুষ, আলাদা শরীর, আলাদা তার খাবারের রুচি, চাহিদা এবং পছন্দ।

আপনার শরীরের ভেতরে আপনার রক্তে মাংসে বেড়ে উঠলেও  শিশুর পছন্দ, শারীরিক চাহিদা, দেহ ঘড়ি, খাবারের রুচি আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। আপনার শিশুকে বোঝার চেষ্টা করুন।

খাবারের মাঝে সময়ের ব্যবধান

একটা মিল থেকে পরবর্তী মিলের সময়ের ব্যবধান খুব গুরুত্বপূর্ণ। সব বাচ্চাই যে ২ ঘন্টা পর পর খাবে এমনটা মনে করা উচিত হবে না। কেননা সব বাচ্চার পরিপাকতন্ত্র, হজমের ক্ষমতা, মেটাবোলিজম, শারীরিক গঠন এবং খাদ্যাভ্যাস এক নয়। তাই যে বাচ্চাটা শারীরিকভাবে খুব সক্রিয়, তার খাবার যতটা দ্রুত হজম হবে তার থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি শান্ত বাচ্চা বা যে খুব বেশি ছুটোছুটি পছন্দ করে না তার খাবার কিছুটা দেরি করে হজম হবে বা একটু দেরিতে খিদা পাবে এটাই স্বাভাবিক।

উদাহরন হিসেবে বলা যেতে পারে দুটো বাচ্চার এক জনকে এক বাটি নরম খিচুড়ি দেয়া হলো অন্য জনকে ২ পিস মাছ ভাজি আর কিছু মাখনে ভাজা সবজি দেয়া হলো। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে ২য় বাচ্চাটি কিছুই খেলো না। কিন্ত আপনি যদি খাবারের ক্যালরি হিসাব করেন তাহলে দেখা যাবে ২য় বচ্চাটির খাবারের ক্যালরি বেশি হবে এবং হজম হতেও বেশি সময় লাগবে ১ম বাচ্চাটির তুলনায়। কেননা  আমিষ,আশঁযুক্ত খাবার এবং চর্বি হজম হতে সময় বেশি নেয় সাধারণ কার্বোহাইড্রেট এর তুলনায়।

আপনার বাচ্চা যদি ২ ঘন্টা পর পর খেতে না চায় তাহলে ৩ ঘন্টা পর ট্রাই করুন অথবা ৪ ঘন্টা। এই বিরতির মাঝখনে কোন স্ন্যাকস দিবেন না। ঘন ঘন স্যানক্সিং ক্ষুদা মন্দার কারণ।

শিশু কতবার খাচ্ছে?

বাচ্চাদের মিলের (meal) সংখ্যার উপরও খেয়াল রাখতে হবে যদি সঠিক খাদ্যাভ্যাস তৈরি করতে চান। বাচ্চাদের সাধারনত ৩ বার মূল খাবার (সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার) এবং ২ টা জলখাবার (snacks) দেয়াই শ্রেয়। স্ন্যাক্স হতে হবে স্বাস্থ্যকর। কম পুস্টির মুখোরোচক খাবার বাচ্চার সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার পিছনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। 

নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট বিরতিতে খাবার দিলে ইনশাআল্লাহ বাচ্চার একটা ভালো খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠবে। সকালের নাস্তা এবং দুপুরের খাবারের মাঝখানে একটা স্ন্যাকস (ফল জাতীয় খাবার অথবা রাতে খেলে হজমে সমস্যা হবে এমন খাবার দিনের প্রথম স্ন্যাক্স হিসেবে দিতে পারেন)। বিকেলে আরেকটা ঘরে বনানো স্বাস্থ্যকর নাস্তা দিতে পারেন।

কোন বেলায় বাচ্চা একটা মিল না খেলে জোরাজোরি না করে পরবর্তী মিলের জন্য অপেক্ষা করুন। তবে এর মাঝে যদি বাচ্চা নিজে তার খাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে, তাকে খাবার দিন।

বাইরের খাবার এড়িয়ে চলা

বাচ্চাকে বাইরের খাবার একদমই দেয়া উচিত না। বাইরের খাবারে স্বাদ বৃদ্ধির জন্য নানারকম রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় যা বাচ্চার শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং বাইরের খাবারে অভ্যস্ত হয়ে গেলে বাসার খাবার খেতে চাইবে না।

সুন্দর পরিবেশনা এবং খাবারে বৈচিত্র

ছোট বাচ্চাদের প্লেটে খাবার সাজিয়ে দিলে খাবারের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। শুরুর দিকে খুব এলোমেলো করে ফেলবে, কাপড় নষ্ট করবে, ঘর নষ্ট করবে কিংবা পেট ভরে খাবে না হয়ত,  কিন্ত আস্তে আস্তে নিজে খাওয়াটা শিখে যাবে।

বাচ্চারা একই খাবার বার বার খেতে পছন্দ করে না। কিছুটা ভিন্নতা সবাই ভালোবাসে এবং বাচ্চারাও এর ব্যতিক্রম নয়। খাবারের প্লেটে যদি ভিন্ন স্বাদ এবং রং এর খাবার সাজানো থাকে বাচ্চা স্বেচ্ছায় হাত বাড়াবে প্লেটের দিকে। রঙীন খাবারের প্রতি আকর্ষণ বাচ্চাদের বেশি।

প্রতিদিন সাদা ভাত না দিয়ে মাঝে মাঝে সামান্য বিটরুটের জুস দিয়ে হালকা নুন আর মাখন দিয়ে ভাতটা ভেজে দিতে পারেন অথবা তেলের উপর সামান্য জিরা ফোড়ন দিয়ে লেবুর রস, লেমন জিস্ট আর হালকা হলুদ গুড়া দিয়ে বানিয়ে দিতে পারেন লেমন রাইস। খেতে যেমন ভাল লাগবে তেমনি কিছুটা বাড়তি পুস্টিও যোগ হবে।

শিশুর খাবারে অনীহা
খাবার সুন্দর করে পরিবেশন করুন

খাওয়ার সময় ডিভাইস পরিহার করা

খাওয়ার সময় বাচ্চার হাতে মোবাইল বা টিভি দেয়া যাবে না, এতে আছে নানা রকমের ক্ষতিকর দিক। বাচ্চার সাথে গল্প করতে পারেন।

সর্বোপরি বাচ্চার খাওয়ার ব্যাপারে অস্থির না হয়ে আমাদের ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। শিশু কতটুকু খেলো সেটা নিয়ে চিন্তিত না হয়ে একটা সঠিক এবং স্থায়ী খাদ্যভাস তৈরির প্রতি আমাদের বেশি মনোযোগী হতে হবে।

তথ্যসূত্র

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা