মায়া ও রনির বিয়ের ৬ বছর হয়েছে। তাদের সংসারে ৪ বছরের একটি সন্তানও আছে। এই সময়ে তারা তাদের পরিবারকে একটু বড় করার কথা চিন্তা করেন এবং মায়া কনসিভও করে। তারা খুব খুশি হয়ে যায় কারণ সব কিছু তাদের মনমতো হচ্ছিল। মায়ার ৮ সপ্তাহের চেকাপেও সব ঠিক ছিল। তারা তাদের অনাগত সন্তানের প্রথম হার্টবিট শুনতে পায় এবং খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে।
সব কিছুই ঠিক মতো চলছিল। কিন্তু ১২ সপ্তাহের কিছুদিন আগেই মায়া খেয়াল করে তার অল্প অল্প ব্লাড যাচ্ছে। মায়া সাথে সাথেই তার স্বামীকে জানায় এবং ডাক্তারের এ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়। ডাক্তার তাদেরকে ঘাবড়ে যেতে নিষেধ করে এবং জানান, অনেকের এমন হতে পারে, তবে চেকআপ করে নেওয়া ভাল। ডাক্তারের পরামর্শে তারা চেকআপ এ যান এবং ডাক্তার তাদের জানায় তিনি অনাগত সন্তানের হার্টবিট পাচ্ছেন না। হঠাৎই তাদের সব আনন্দ যেন বিষাদে পরিণত হয়। তারা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হন কিন্তু তিনিও একই কথা বলেন। মায়া একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়, তার অনুভূতি যেন ভোতা হয়ে গেছে!

মিসক্যারেজের পর মানসিক স্বাস্থ্য
গর্ভপাত বা মিসক্যারেজের অভিজ্ঞতা একেক জনের জন্য একেক রকম হতে পারে। কেউ অনেক বেশি ভেঙ্গে পরে, কেউ অতটা ভেঙ্গে নাও পরতে পারেন। অনেকে আবার মাঝে অপরাধবোধে ভুগেন।
জেনে রাখা ভালো, প্রতি ৫ জনের মাঝে ১ জনের গর্ভপাত হতে পারে। মিসক্যারেজের পরে অনেকেই শোকগ্রস্থ হয়ে পড়েন, এবং শোকাহত নারী বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া দেখান। কেউ শোকে অনেক কান্নাকাটি করেন, কেউবা আবার একেবারে চুপচাপ হয়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে পারেন।
সাইক্রিয়াটিস্ট Kubler Ross এর মতে মানুষ শোকে ৫টি ধাপের মধ্য দিয়ে যায়। সবার ক্ষেত্রেই যে ধাপগুলো ঠিক ক্রমানুসারে ঘটে বা সবগুলোই যে ঘটে এমনটি নয়। মিসক্যারেজের পর একজন নারী শুধু কয়েকটি ধাপের মধ্য দিয়ে যেতে পারেন বা সবগুলো ধাপের মধ্য দিয়ে যেতে পারেন। আবার কারো ক্ষেত্রে সবগুলো ধাপের মধ্য দিয়ে গেলেও পর্যায়ক্রমে ধাপগুলো অতিক্রম করে না।
এই ধাপগুলো সম্পর্কে তাই জানা জরুরী। কারণ আপনি নিজেই প্রাথমিকভাবে বুঝতে পারবেন যা অনুভব করছেন, সেটা কেন করছেন। এছাড়া স্বামী, মা, বোন হিসেবে আপনার প্রিয় মানুষ, যার গর্ভপাত হয়েছে, তাকে আপনি সাহায্য করতে পারেন।
Denial (অস্বীকার করা)
প্রথম দিকে অনেকেই মেনে নিতে পারে না যে তারগর্ভপাত হয়েছে। তারা এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে।
Anger ( রাগ করা)
এই ধাপে এসে দেখা যায় তাদের মধ্যে রাগের অনুভূতি হয়। অনেকেই তাদের ডাক্তার, নিজের আশেপাশের মানুষ, এমনকি নিজেকে দোষারোপ করে তাদের গর্ভপাতের জন্য। কিন্তু এমনটা নাও হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় গর্ভপাতের জন্য কারো কোন দোষ থাকে না এবং অনেক ক্ষেত্রেই কারোর কিছু করার থাকে না।
Bargaining (দরকষাকষি )
যারা ধার্মিক হন তারা দেখা যায় সৃষ্টিকর্তার কাছে বিভিন্ন নিয়ত করে। যেমনঃ পরবর্তী গর্ভধারণ সব ঠিকঠাক মতন হলে এটা করবে ওটা করবে ইত্যাদি। অনেকেই আবার কি করলে গর্ভপাত এর ঝুঁকি কমতো সেটা নিয়ে অনেক গবেষণা করে। গর্ভকালীন সময়ে নিজের যত্ন নেওয়া, স্বাস্থ্যকর দৈনন্দিন জীবন যাপন করা জরুরি। তবে এমনটা মনে করা উচিৎ না যে এটা করলে বা ওটা না করলে গর্ভপাত হতো না। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই নিজের হাতে কিছুই থাকে না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় অনাগত সন্তানের ক্রোমোসোমাল অস্বাভাবিকতার কারণে গর্ভপাত হয়ে থাকে।
Depression ( বিষণ্ণতা)
এই ধাপে এসে দুঃখবোধ হতে পারে এবং আশাহীনতায় ভুগতে পারে। অনেকে দুশ্চিন্তা করে তারা আর কখনো মা হতে পারবে কিনা। অনেকে আবার গর্ভধারণ করার পরও আবার গর্ভপাত হওয়ার দুশ্চিন্তা করে। এক্ষেত্রে সুখবর হল যাদের গর্ভপাত হয় তাদের ৮৫%-৯০% পরবর্তীতে আবার গর্ভধারণ করতে পারে এবং সুস্থ সন্তান প্রসব করে থাকে।
Acceptance ( মেনে নেওয়া )
গর্ভপাতের ক্ষতিটা যদিও অনেক বেদনাদায়ক কিন্তু সবশেষে তারা তাদের এই ক্ষতিটাকে মেনে নিতে শিখে এবং এটিকে মেনে নিয়ে নিজেদের জীবনে এগিয়ে যাওয়া শিখে। কারোর যদি এই ধাপে আসতে অনেক সংগ্রাম করতে হয় এবং কেউ যদি মনে করেন তারা তাদের এই পরিস্থিতি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তাহলে সাইকোলজিস্ট এর সহযোগিতা নিতে পারেন।
আসলে গর্ভপাতজনিত শোকে অনেকেই ভেঙ্গে পরতে পারেন। এসময় প্রচণ্ড দুঃখবোধ থেকে যদি কান্না আসে তাহলে কান্না আটকে না রেখে কান্না করা উচিৎ। অনেকে কান্না করাটাকে মনে করেন নিজের দুর্বলতার প্রকাশ কিন্তু কান্নাটা হল দুঃখবোধ অনুভূতির বাহ্যিক প্রকাশ। আবেগতাড়িত হয়ে যখন কেউ কান্না করে তখন অক্সিটোসিন (oxytocin) এবং এন্ডোরফিন ( endorphins) হরমন শরীরে মুক্তি পায় যার কারণে আমরা ভাল বোধ করি।
কীভাবে সামলে উঠবেন?
নিজেকে সামলিয়ে উঠতে এসময় নিচের পদক্ষেপ গুলো গ্রহণ করা যেতে পারে-
১) আপনি যখন মনে করবেন যে আপনি আপনার এসময়কার অনুভূতিগুলো শেয়ার করতে চান আপনি তখন আপনার অনুভূতিগুলো আপনার জীবনসঙ্গী অথবা কাছের কোন বন্ধুর সাথে শেয়ার করতে পারেন। নিজের দুঃখের অনুভূতিগুলো কাছের মানুষদের সাথে শেয়ার এর মাধ্যমে মনের কষ্টগুলো বের হবার পথ পাবে এবং মন হালকা লাগবে।
সম্পাদকের নোটঃ আপনি চাইলে মাতৃত্ব’র ব্লগ অংশে আপনার মিসক্যারেজের অভিজ্ঞতা লিখতে পারেন। এতে আপনার মন হালকা হবে, এবং আপনার লেখা পড়ে অন্য একজন মা উপকৃত হবেন।
২) এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অনেক ধরনের সাপোর্ট গ্রুপ আছে। মাতৃত্ব’র ফেসবুক কমিউনিটি এরকমই একটি সাপোর্ট গ্রুপ যেখানে শুধু নারীরা অংশগ্রহণ করেন। চাইলে এই ধরনের সাপোর্ট গ্রুপ এ যুক্ত হতে পারেন।
৩) দুঃখের অনুভূতিগুলো কাটিয়ে উঠতে নিজেকে এবং নিজের জীবনসঙ্গীকে সময় দিন, নিজের যত্ন নিন, ডাক্তারের পরামর্শে কিছু শরীরচর্চা শুরু করতে পারেন, সুষম খাবার গ্রহণ করুন, পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন- এগুলোর মাধ্যমে আপনি আস্তে আস্তে ভাল অনুভব করবেন।
মনের মধ্যে যদি অনেক বেশি নেতিবাচক চিন্তা আসে তাহলে পসিটিভ সেলফ টক করতে পারেন। বিভিন্ন ইতিবাচক উক্তি কাগজে লিখে সেগুলো নিজের রুমের বিভিন্ন জায়গায় রাখতে পারেন যাতে সেগুলো আপনার চোখে পরে।
একজন মুসলিম হিসেবে কীভাবে মিসক্যারেজের শোককে সামলাবেন তা জানতে এই লেখাটি পড়ুন।
অতীতের মধ্যে আটকে না থেকে এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুশ্চিন্তা না করে বর্তমানে নিজের মনোনিবেশ করার চেষ্টা করুন।এর জন্য আপনি মাইন্ডফুলনেস এক্সারসাইজ এর অনুশীলন করতে পারেন। যেমনঃ খাবার সময় খাবার এর রং, গন্ধ, টেস্ট সব কিছুই প্রতিটি গ্রাসে খেয়াল করুন; নিজের ধর্মীয় চর্চার সময় মন দিয়ে করার চেষ্টা করুন; এভাবে আরো অনেক কিছু।
সবশেষে যদি আপনি মনে করেন যে, আপনার অনুভূতিগুলো আপনাকে অনেক বেশি কষ্ট দিচ্ছে, আপনার দৈনন্দিন কাজকর্মেও এর প্রভাব পড়ছে, এবং আপনি কোন ভাবেই খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন না তাহলে একজন সাইকোলজিস্ট এর সহযোগিতা নিতে পারেন।
শময়িতা আলম
অ্যাসিস্ট্যান্ট কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট,
ডিপার্টমেন্ট অফ এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
You must be logged in to post a comment.