পারিবারিক সুশান্তি বজায় রাখতে কাজ করা এক কর্মীর জবানবন্দী-
১। আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের বড় করার সময় তাদের পেট (খাওয়া দাওয়া) নিয়ে বাবা-মা যতোটা সচেতন, ওদের মনে কী আছে, ওরা কী ভাবছে, কীভাবে ভাবছে সেসব নিয়ে ততোটা নন। অথচ সন্তানের রিজক আল্লাহর তরফ থেকে আসে আর তার ফিতরাত, চরিত্র, মন-মানসিকতা তৈরী করা বাবা মায়ের দায়িত্ব। মন-মানসিকতার পরিচর্যা করতে হলে সন্তানের চিন্তা ভাবনার খেয়াল রাখতে হবে।
২। মোটামুটি বারো বছরেই বাচ্চাকে তার নিজের শারীরিক পরিবর্তন, অন্য লিঙ্গের শারীরিক পরিবর্তন, এসবের পেছনের কারণ জানানো উচিত। তারা এমনিতেও জানার জন্য আগ্রহী থাকে। পরিবার থেকে সাপোর্ট না পেলে তাদের জ্ঞানপিপাসা বাহির থেকে মিটাবে। এটা তাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। অথবা অজ্ঞ থাকার কারণে জীবনে স্ট্রাগল করবে। সেজন্য মা, বাবা বা বড় ভাইবোনের মুখ থেকে প্রজনন ও তার ব্যাখ্যা, এটা কী, কেন, কিভাবে, ভার্জিনিটি সবার সম্পদ ইত্যাদি বিষয়গুলো আপনার মুখ থেকে জানা উচিত। ব্যপারগুলা শরীয়ত মোতাবেক জানাবেন, তাহারাত (পবিত্রতা) বুঝিয়ে দিবেন। মনে রাখবেন সন্তানকে জীবনের যাবতীয় মাসায়েল শিখানোর দায়িত্ব আপনার। আপনি যেভাবে পারেন অন্য কেউ সেটা পারবেনা।
৩। বয়স পনেরোর কাছাকাছি হলে বিয়েশাদী, পরিবার, সংসার ইত্যাদি নিয়ে বাচ্চার সাথে খোলাখুলি ও সিরিয়াস আলাপ করা প্রয়োজন। স্বামী-স্ত্রীর হক, সম্পর্কের গুরুত্ব, এসবের প্রতিদান, উত্তম জীবনসঙ্গী ও সন্তানের জন্য দুআ করা ইত্যাদি বুঝিয়ে দিবেন। দয়া করে চেষ্টা করবেন এমন আলোচনা জারি রাখার, বন্ধ করবেন না। তার তরফ থেকে নানারকম কৌতুহল ও প্রশ্ন আসতে পারে, সেসব প্রশ্নের নিরপেক্ষ ও সুচিন্তিত জবাব দিন।
৪। জীবনসঙ্গী কি? কেন লাগে? আপনি কী দেখে যাচাই করেছিলেন? আপনার নির্বাচন কেমন ছিলো? সাহাবীদের জীবনসঙ্গী কেমন ছিলেন, রাসূলুল্লাহ কেমন জীবনসঙ্গী নির্বাচন করার আদেশ দিয়েছেন ইত্যাদি বুঝিয়ে বলবেন। বলার সময়ে উদাহরণ দিতে পারেন, তবে উদাহরণ দিলেও সম্পর্কের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা রাখবেন। অমর্যাদা হয় এমন কিছু বলবেন না। কোন আত্নীয়কে ওর চোখে খারাপ করবেন না। একান্ত প্রয়োজন হলে নাম গোপন রেখে বা ছদ্মনামে বলুন।
৫। প্রেফারেন্স। কি চাই আমরা? কখন কোনটা আগে চাইতে হয়, জানান। আমাদের সবারই কিছু পরিকল্পনা, কিছু আশা থাকে। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা আমাদের পরিকল্পনার সাথে না-ও মিলতে পারে। আল্লাহর পরিকল্পনার আগে বিনয়ী হতে শেখান। আল্লাহর কাছে সমর্পণ ও তাঁর কাছে চাওয়ার আদব শেখান। চেষ্টা করুন জীবনের কোন করুণ সত্যের মুখোমুখি করার, বাস্তবতাকে অনুভব করতে দিন। তারপর পরামর্শ দিন। উপদেশের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার চেয়ে ক্ষুধা জাগিয়ে দিন। খাবার তখনই সুস্বাদু লাগবে।
৬। সিদ্ধান্ত নিতে শেখান, এটা অনেক জরুরি। পরামর্শ নেয়া যায় অনেকের থেকে, তবে সাহায্যটা চাইতে হবে আল্লাহর কাছে। তারপর সিদ্ধান্তটা নিতে হবে নিজেকে, সেটার ওপর অটল থাকতে হবে, বদলাতে হলে বুঝেশুনে বদলাবে, যাতে পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকত পারে, পরে যেন কাউকে দোষারোপ করতে না হয়, আফসোস করতে না হয়। যথাযথ ব্যাক্তিত্ব অর্জন করতে এই সতর্কতাগুলো খুবই জরুরি। এটা ছেলেমেয়ে উভয়কেই খুব সচেতনভাবে শিখিয়ে চর্চা করানো উচিত।
৭। নিজের শরীরের যত্ন নেয়া, নিজের সহায় সম্পত্তি গুছিয়ে ব্যবহার করতে পারা, তা যত অল্পই হোক না কেন। একটা সময়ে এই যত্ন নেয়ার অভ্যেসটা যোগ্যতা হয়ে দাঁড়ায়। এই যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যাটালিয়ন লাগে না, দিনের অল্প একটুখানি সময়ই যথেষ্ট।
৮। যে কোন মুহুর্তে, দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে ফাসাদ দেখা গেলে কখনোই সব পক্ষের কথা না শুনে মন্তব্য করা ঠিকনা। সব শুনলেও, সম্ভব হলে, মন্তব্য করার আগে একটু সময় নেয়া। মীমাংসা করার চেষ্টা করবেন। অযথা গীবত, ফাসাদ বাড়াবেন না।
৯। ডাক্তার বা উকিল ছাড়াও, কখনো কখনো কাউকে সব লুকানো কথা বলে ফেলতে ইচ্ছা করে। ক্ষেত্রবিশেষে এটা খুব ভালো কাজে দেয়। একটা দিকই খুঁজতে হয়, মানুষ হিসেবে যেমন হয় হোক, অন্তত আমার মাথায় হাত রাখার যোগ্যতাটা থাকুক। এটা বুঝার উপায় কী? আমার জানা নেই। এর কোন ফিক্সড রুল নেই। তবে মানুষের কাছে নির্ভরশীল না থেকে আল্লাহর প্রতি সমর্পিত হতে হবে। আর নিজের আপনজনদেরকে চিনতে থাকুন, বিপদে যেন কাউকে কাছে পান।
পরিবার ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের ঘরগুলো যেমন গোছানো থাকে, টানটান করা থাকে চাদর, পর্দা, বাক্সে-বয়ামে তোলা থাকে হঠাৎ আসা মেহমানের জন্য নাশতা। তেমনি আমদের সম্পর্কগুলোও গোছানো থাকুক। যে যেখানেই থাকি, নিজেদের সংস্পর্শে নিজেরা যেন শান্তি পাই, অল্প সময়ের জন্য কেউ এলেও যেন শান্তির পরশ পেয়ে ফিরে যায়।
-মারদিয়া মমতাজ
এসিস্ট্যান্ট প্রজেক্ট ডিরেক্টর
BILRC ফ্যামিলি এইড